শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের পর হালে চিন। কোভিড অতিমারি বিশ্বের অধিকাংশ দেশের অর্থনীতিরই কোমর ভেঙে দিয়েছে। ছোট, বড় কোনও দেশ সঙ্কটের হাত থেকে রেহাই পায়নি।
এমনকি, বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি আমেরিকাও কোভিড পরবর্তী সমস্যায় ভুগছে। দেশে দেশে মাথা চাড়া দিয়েছে মূল্যবৃদ্ধি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস তুলেছে।
এই পরিস্থিতিতে ফিরে তাকানো যায় প্রায় এক শতাব্দী আগের পর্তুগালের দিকে। ১৯২৫ সালে এক অদ্ভুত অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছিল পশ্চিম ইউরোপের এই ছোট্ট দেশটি।
তবে পর্তুগালের সেই অর্থনৈতিক সঙ্কট কোনও মহামারি, যুদ্ধ কিংবা বিশ্ব বাণিজ্যের পতনের ফল ছিল না। তার নেপথ্যে ছিলেন এক জন মাত্র প্রতারক। যাঁর কারসাজিতে ভেঙে পড়তে বসেছিল গোটা দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো।
আলভেস দোস রেইস। বিশ শতকের ইউরোপে সাড়া ফেলেছিল এই নাম। অপরাধ তো অনেকেই করেন। তার শাস্তিও হরেক রকম। কিন্তু আলভেসের চালাকি, ষড়যন্ত্রের কাছে হার মেনেছিল রাষ্ট্র।
কী করেছিলেন আলভেস? পর্তুগালের ভুয়ো নোট ছাপিয়ে সরকারকে বোকা বানিয়েছিলেন তিনি। সুকৌশলে নিজের কাজ হাসিল করে নিয়েছিলেন অন্য এক সংস্থার মাধ্যমে।
একটি প্রতারণার মামলায় জেল খাটতে খাটতেই নোট দুর্নীতির ছক কষেছিলেন আলভেস। জেলে থাকাকালীন তিনি ব্যাঙ্ক অফ পর্তুগালের কাজকর্ম সম্পর্কে অনেক কথা জানার এবং পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছিলেন।
আলভেস জানতে পারেন, ১৮৯১ সাল থেকে পর্তুগাল সরকার অতিরিক্ত নোট ছাপাচ্ছিল। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কটি গোপনেও নোট ছাপার কাজ চালাত। এই নোটগুলির কোনও হিসাব রাখা হত না। সরকারও হিসাব চাইত না।
নকল নোট চিহ্নিত করার কোনও প্রযুক্তিও ব্যবহার করত না পর্তুগাল সরকার। দেশের মুদ্রা ব্যবস্থার এই বিরাট ফাঁক জেলে বসেই লুফে নিয়েছিলেন আলভেস। তিনি অঙ্ক কষে দেখেন, অন্তত ৩০ কোটি এসকুডো (পর্তুগিজ মুদ্রা) তিনি সরকারি হিসাবে ব্যাঘাত না ঘটিয়েই নয়ছয় করতে পারেন।
১৯২৪ সালের অগস্ট মাসে জেল থেকে মুক্তি পান আলভেস। বেরিয়েই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজে লেগে পড়েন। এই কাজে তাঁকে সহায়তা করেন ডাচ ব্যবসায়ী কারেল মারাং, জার্মান ব্যবসায়ী অ্যাডল্ফ হেনিস এবং জোসে ব্যান্দেরিয়া, যাঁর দাদা একসময় পর্তুগাল সরকারের মন্ত্রী ছিলেন।
পর্তুগালের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক নিজে থেকে নোট ছাপাত না। তারা একটি ব্রিটিশ মুদ্রণ সংস্থাকে নোট ছাপার বরাত দিত। সেই ওয়াটারলু অ্যান্ড সন্স লিমিটেডকে বোকা বানিয়ে সরকারকে বিপদে ফেলেছিলেন আলভেসরা।
ওয়াটারলু অ্যান্ড সন্স লিমিটেডে ডাচ ব্যবসায়ী মারাংকে পাঠিয়েছিলেন আলভেস। তিনি ব্যাঙ্ক অফ পর্তুগালের প্রতিনিধি হিসাবে নিজের পরিচয় দেন এবং জানান, পর্তুগিজ উপনিবেশ অ্যাঙ্গোলার জন্য অর্থ প্রয়োজন।
মারাং ওই সংস্থাকে জানান, রাজনৈতিক কারণে এই অর্থসাহায্যের কথা গোপন রাখা হয়েছে। অত্যন্ত সন্তর্পণে অর্থ পাঠানো হবে উপনিবেশে। গোপনীয়তার কারণে পর্তুগিজ ব্যাঙ্ক এবং মুদ্রণ সংস্থার মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী একমাত্র প্রতিনিধি হবেন মারাংই।
ওয়াটারলু কর্তৃপক্ষ স্বাভাবিক ভাবেই পর্তুগিজ সরকারের লিখিত সম্মতিযুক্ত কাগজপত্র দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা একটি ভুল করেন। সরাসরি সরকারের সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগ করেননি। ফলে ভুয়ো কাগজ দেখিয়ে সহজেই প্রতারণা করেন আলভেস।
১৯২৫ সালের শুরুর দিকে ওয়াটারলু অ্যান্ড সন্স লিমিটেড ৫০০ এসকুডোসের দু’লক্ষটি নোট ছাপায়। ভাস্কো ডা গামার ছবি সম্বলিত সেই টাকার মোট অর্থমূল্য ছিল ১০ কোটি এসকুডোস। এই টাকা সরাসরি তুলে দেওয়া হয় আলভেসদের হাতে।
টাকা হাতে পাওয়ার পর আলভেস কয়েক জন ব্যক্তিকে টাকা দিয়ে ভাড়া করেন। তাঁদের কাজ ছিল পর্তুগালের বিভিন্ন স্থানীয় ব্যাঙ্কে নকল টাকা দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলা এবং আসল টাকা তুলে নেওয়া।
অসাধু উপায়ে জোগাড় করা এই আসল টাকাগুলি এ বার আলভেসরা রিয়েল এস্টেট এবং বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। কিছু দিনের মধ্যেই আচমকা ফুলেফেঁপে ওঠে পর্তুগীজ অর্থনীতি।
আলভেসও রাতারাতি বিপুল অর্থ এবং সম্পত্তির মালিক হয়ে যান। বড় বাড়ি, গাড়ি, স্ত্রীর জন্য বিপুল গয়নাগাটি কিনে ফেলেন অল্প সময়ের মধ্যেই। এমনকি, আলভেস একটি আলাদা ব্যাঙ্কও খুলে ফেলেন।
ধীরে ধীরে টাকার জোরে ব্যাঙ্ক অফ পর্তুগালের শেয়ার কিনতে শুরু করেন আলভেস। ওই বছরের শেষে ব্যাঙ্কের ৪৫ হাজারের মধ্যে ১০ হাজার শেয়ার তিনি কিনে ফেলেন। যার ফলে সুদের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা চলে আসে তাঁর হাতে।
তবে আলভেসের এই প্রতিপত্তি বেশি দিন চলেনি। ক্রমে দেশের সংবাদমাধ্যমের আতশকাচের নীচে চলে আসে তাঁর ব্যাঙ্ক। দীর্ঘ তদন্তের পর নকল নোটের কারবারের পর্দাফাঁস হয়।
যাঁরা আলভেসের ব্যাঙ্কে টাকা রেখেছিলেন, যাঁরা সেখান থেকে নকল টাকা তুলেছিলেন, নোট পরিবর্তনের জন্য ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ান তাঁরা। দেশের সরকার এবং ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারান সাধারণ মানুষ। বিশ্বের বাজারেও পর্তুগিজ মুদ্রার দাম পড়ে যায়।
ব্যাঙ্ক অফ পর্তুগাল ৫০০ এসকুডোসের সব ক’টি নোট তুলে নিয়েছিল। তারা ওয়াটারলু অ্যান্ড সন্সের বিরুদ্ধে কাজে অবহেলার মামলা করে। ওই মামলায় মুদ্রণ সংস্থাকে ৬ লক্ষ ১০ হাজার ইউরো ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেয় আদালত। এই ধাক্কায় সংস্থাটি পুরোপুরি ভেঙে পড়ে।
আলভেসের ২০ বছরের সাজা হয়। ১৫ বছর পর জেল থেকে বেরোন তিনি। তার ১০ বছর পর ১৯৫৫ সালে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। আলভেসের সঙ্গীদেরও কঠোর সাজা হয়েছিল।