কখনও ভারতের নবাবের দখলে কখনও বা ইটালির রাজপরিবারের মুকুটে শোভা পেয়েছে ফ্লোরেন্টাইন হিরে। কানাঘুষো শোনা যায় যে, লোভে পড়ে নাকি অ্যাডলফ হিটলার এই হিরেটি চুরি করে নিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানে ফ্লোরেন্টাইন হিরে কোন দেশের কাছে রয়েছে? কোটি টাকা মূল্যের এই হিরে নাকি কালের নিয়মে হাতবদল হতে হতে হারিয়েই গিয়েছে।
ফ্লোরেনটাইন হিরে সাক্ষী রয়েছে বিশ্ব ইতিহাসের। রাজার মুকুট থেকে ব্রোচের শোভা বাড়িয়ে এসেছে এই হিরে। ইতিহাসবিদদের মতে, এই হিরের ওজন ১৩৭ ক্যারাটের কাছাকাছি। ভারতীয় মুদ্রায় এর মূল্য আনুমানিক ৬ কোটি ২০ লক্ষ টাকা।
হালকা হলুদ বর্ণের ফ্লোরেনটাইন হিরের মধ্যে ধরা দেয় সবুজ রঙের খেলা। ইতিহাসবিদদের অধিকাংশের দাবি, এই হিরে এমনই দেখতে ছিল যে কেউ কেউ তাকে কাচ ভেবেও ভুল করতেন।
ইতিহাসবিদদের মতে, ফ্লোরেন্টাইন হিরে প্রথম দেখা যায় ডিউক অফ বার্গান্ডি চার্লস দ্য বোল্ডের মুকুটে। গয়না নির্মাতা লোডেউইক ভ্যান বার্কেন এই হিরে কেটে রাজার মুকুটে বসিয়েছিলেন।
ইতিহাসবিদেরা কেউ কেউ মনে করেন যে, ১৪৭৬ সালের ২২ জুন মোরাটের যুদ্ধ চলাকালীন চার্লসের মুকুট থেকে নাকি ফ্লোরেন্টাইন হিরেটি যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে যায়। সেই হিরে আর খুঁজে পাননি চার্লস। যুদ্ধক্ষেত্র থেকেই চিরতরে হারিয়ে যায় হিরেটি।
আদতে ফ্লোরেন্টাইন হিরে হারায়নি। যুদ্ধক্ষেত্রে সেই হিরে খুঁজে পেয়েছিলেন এক সৈন্য। তিনি হিরেটি দেখে ভেবেছিলেন যে, এ কোনও রঙিন কাচের টুকরো। কিন্তু দেখতে অসাধারণ হওয়ার কারণে তা বিক্রি করে দেন তিনি।
হাতবদল হতে হতে ফ্লোরেন্টাইন হিরে সুইৎজারল্যান্ড হয়ে ইটালিতে ঘুরে আসে। ইটালির লুডোভিকো স্ফোরজা হিরেটি দেখে তার আসল মূল্য নির্ধারণ করেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, এটি কোনও কাচের টুকরো নয়। এটি আসলে বহুমূল্য হিরে।
ফ্লোরেন্টাইন হিরেফ্লোরেন্সের মেডিসি রাজপরিবারকে দেন লুডোভিকো। মেডিসি বংশের রাজা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তাঁদের বংশের শেষ পুরুষ উত্তরাধিকারী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করা না পর্যন্ত এই হিরে তাঁদের মুকুটে শোভা পাবে।
১৭৪৩ সাল পর্যন্ত ফ্লোরেন্টাইন হিরে মেডিসি বংশের দখলে থাকে। বংশের শেষ রাজার মৃত্যুর পর মেডিসি বংশের সব গয়নাগাটি তাঁদের এক নিকটাত্মীয়ের দখলে চলে যায়। সেই তালিকায় ছিল মুকুটে থাকা হিরেটিও।
ফ্লোরেন্সের পর অস্ট্রিয়ার রাজপরিবারের মুকুটে শোভা পেতে থাকে ফ্লোরেন্টাইন হিরে। ফ্রান্সিস স্টিভেন যখন সিংহাসনে বসেছিলেন তখন সেই হিরে তাঁর মুকুটে শোভা পেয়েছিল। ১৯১৮ সালে তাঁদের বংশের বিনাশ হয়। তার পর আবার শুরু হয় হিরের হাতবদল।
হাতবদল হতে হতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় একটি হিরের ব্রোচ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অনেকের মতে, ফ্লোরেন্টাইন হিরেটি মুকুট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং তার উপর কারুকার্য করে হিরের ব্রোচ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এই হিরেই যে ফ্লোরেন্টাইন হিরে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
কেউ কেউ মনে করেন যে, অস্ট্রিয়া থেকে ফ্লোরেন্টাইন হিরেটি আমেরিকার হাত ঘুরে ভিয়েনায় গিয়ে পৌঁছয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হিরেটি হিটলারের নজরে আসে। লোভে পড়ে হিরেটি দখল করেন তিনি।
কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল আর্ট মিউজিয়াম অফ আমেরিকার ট্রেজার রুম আবার অন্য নথি দিয়েছে। তাদের মতে, ফ্লোরেন্টাইন হিরেটি দক্ষিণ আমেরিকায় ছিল। সেখানে বার বার হাতবদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছিল হিরের আকৃতিও। তার পর তা আবার আমেরিকায় ফিরে আসে।
ফ্লোরেন্টাইন হিরেটি আমেরিকা থেকে হাতবদল হয়ে জেনেভায় ফিরে আসে। ১৯৮১ সালে নাকি জেনেভায় কম দামে এই হিরের মতো দেখতে অবিকল একটি হিরে বিক্রি করা হয়েছিল।
কিন্তু এই হিরেটি ফ্লোরেন্টাইন কি না, তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ফলে বহু শতকের ইতিহাস বহন করা ফ্লোরেন্টাইন হিরেটি শেষ পর্যন্ত হারিয়ে যায়। এর বর্তমান ঠিকানা কোথায়, সে বিষয়ে কেউ কিছু জানেন না।
ফ্লোরেন্টাইন হিরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভারতের ইতিহাসও। দক্ষিণ ভারতে যখন বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজত্ব চলছিল তখন তাদের সংগ্রহে ছিল এই হিরেটি। পরে নাকি এই হিরে ইটালির এক ব্যবসায়ীর হাতে আসে। তবে এই বিষয়ে ইতিহাসের পাতায় কোনও উল্লেখ নেই। কোনও তথ্যপ্রমাণও পাওয়া যায়নি।