তিরিশের দশকে এমু পাখিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করেছিল অস্ট্রেলিয়া। না, একেবারেই রসিকতা নয়। ১৯৩২ সালে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় এমু পাখিদের বিরুদ্ধে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চলেছিল মেশিনগান থেকে। কিন্তু সেই অসম যুদ্ধে হার মানতে হয়েছিল অস্ট্রেলীয় বাহিনীকে। অবাস্তব মনে হলেও এটাই সত্যি!
তিরিশের দশকের অস্ট্রেলিয়ায় ওই যুদ্ধকে ‘দ্য গ্রেট এমু ওয়ার’-এর তকমা দেওয়া হয়। অন্য পাখিদের মতো উড়তে পারে না এমু। অস্ট্রিচ বা কিউয়ি পাখির মতো হেঁটেই খাবার সংগ্রহ করে। এক জায়গা থেকে অন্যত্র পাড়ি দেয় হেঁটেই।
উড়ানে অক্ষম এমু পাখিরা কী ভাবে অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে জয় পেয়েছিল? অস্ট্রেলীয় সরকারই বা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করতে গেল কেন? এ সব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে ফিরে তাকাতে হবে তিরিশের দশকে।
১৯২৯ সালে আমেরিকার শেয়ারবাজারে ধসের জেরে সে দেশে মহামন্দা শুরু হয়েছিল। তিরিশের দশকে তার আঁচ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেনি অস্ট্রেলিয়াও। তীব্র আর্থিক অনটনে সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছিল অনেকের।
মহামন্দার সময় অস্ট্রেলীয় কৃষকদের ক্ষেতে হানা দিয়েছিল এমু পাখিরা। একটি দু’টি নয়, ঝাঁকে ঝাঁকে প্রায় ২০ হাজার এমুর হানায় ক্ষেতের ফসল নষ্ট হতে বসেছিল। প্রজননের সময় ঝাঁকে ঝাঁকে এমুর ঢল নেমেছে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন ক্ষেতে। তাদের রুখতে অস্ত্র তুলে নেন কৃষকেরা।
১৯২২ সাল পর্যন্ত সংরক্ষিত প্রজাতি হিসাবে মর্যাদা পেত অস্ট্রেলিয়ার এমু। তবে তিরিশের দশকে তাদের কাণ্ডকারখানায় সে ‘সম্মানে’ ধাক্কা লেগেছিল। ফসল নষ্টকারী পোকাদের ধ্বংস করার মতোই এমুদের বিরুদ্ধে মেশিনগান তুলে নিয়েছিলেন কৃষকেরা। আক্ষরিক অর্থেই!
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লড়াই করা অস্ট্রেলিয়ার বহু সেনাই রুজিরুটির টানে লাঙল হাতে মাঠে নেমে পড়েছিলেন। তবে একে মহামন্দা, তায় এমুর হানা— দুইয়ে মিলে তাঁদের রোজগারে টান ধরতে শুরু করেছিল।
সরকারের কাছে সেই কৃষকদের আর্জি ছিল, এমু পাখিদের হঠাতে আবারও অস্ত্র তুলে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হোক তাঁদের। কৃষকদের আর্জিতে সাড়া দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া সরকার।
১৯৩২ সালের নভেম্বরের গোড়ায় শুরু হয়েছিল ‘দ্য গ্রেট এমু ওয়ার’। প্রথম রাউন্ডে সাময়িক জয়ের স্বাদ পেলেও পরের দিকে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিলেন অস্ত্রধারীরা।
প্রথম রাউন্ডে খান পঞ্চাশেক এমু পাখির ঝাঁক লক্ষ্য করে মেশিনগান চালিয়েছিলেন কৃষকেরা। বেশ কতগুলি এমুকে মেরেও ফেলেন তাঁরা। এর পর এমুর দল ছড়িয়েছিটিয়ে গিয়েছিল।
দ্বিতীয় রাউন্ডে শত্রুপক্ষের কড়া মোকাবিলার মুখে পড়েছিলেন অস্ট্রেলীয় কৃষকেরা। দিন কয়েক পরে হাজারখানেক এমু হানা দেয় পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেতে। তবে মেশিনগান বিকল হয়ে পড়ায় সে যাত্রায় এমুদের জয় হয়।
অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যমে তখন এমু পাখিদের শত্রুপক্ষ হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্ষেতেখামারে মেশিনগান হাতে ধরা ‘সেনাবাহিনীর’ তুলনায় যারা বেশ চতুর। বিশালাকায় উঁচু গলার পাখিগুলির তীক্ষ্ণ দৃষ্টির কাছে যে সেনারা অসহায়।
তিরিশের দশকে অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, ‘আগুয়ান শত্রুপক্ষ তীক্ষ্ণদৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন... ভুট্টার ক্ষেতের উপর পেরিস্কোপের মতো চোখ উঁচিয়ে তারা আমাদের দেখে।’
অস্ত্রধারী কৃষকদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রয়্যাল অস্ট্রেলিয়ান আর্টিলারির সেফেন্থ হেভি ব্যাটারির মেজর জিপিডব্লিউ মেরিডিথ।
যুদ্ধের শেষ পর্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে অস্ট্রেলীয় পক্ষিবিদ ডিএল সার্ভেন্টি লিখেছিলেন, ‘পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলিচালনার স্বপ্ন অধরাই থেকে গিয়েছিল মেশিনগানারদের।’
অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের কৌশল নিয়েছিল এমু পাখিরা। অস্ট্রেলীয় পক্ষিবিদ আরও লিখেছেন, ‘এমুদের নেতৃত্ব গেরিলা যুদ্ধের পথে এগোনোর নির্দেশ দিয়েছিল। নড়াচড়ায় অসুবিধা হলেও এমুদের আর্মি ছোট ছোট ইউনিটে বিভক্ত হয়ে যায়। এই ভাবে তারা অস্ত্রধারীদের আক্রমণকে অর্থহীন করে দেয়। মাসখানেকের মধ্যে ক্ষেতের সেনাবাহিনী হতাশ হয়ে পড়ে যুদ্ধ প্রত্যাহার করে নেয়।’
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত লিউয়িস মেশিনগানের সামনে পড়ে ছত্রভঙ্গ হলেও হাল ছাড়েনি এমুরা। বরং যুদ্ধের কৌশল পাল্টে পরাস্ত করেছিল অস্ট্রেলীয় ‘সেনাবাহিনীকে’। আজও পারথের আশপাশে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুড়ে বেড়ায় এমুর দল।
মেশিনগানধারীদের বিরুদ্ধে উড়ানে অক্ষম এমুর বিজয়গাথার গল্প সিনেমাতেও ঠাঁই নিয়েছিল। ২০২১ সালে সেই কমেডি-অ্যাকশন সিনেমার নামও নাম ছিল, ‘দ্য গ্রেট এমু ওয়ার’।