অনশন আন্দোলনে বসা টেট চাকরিপ্রার্থীদের চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। রাত তখন সাড়ে ১২টা। মাত্র ১৫ মিনিটে সুনসান হয়ে গিয়েছিল এপিসি ভবনের সামনের রাস্তা। কিন্তু সকাল হতেই সেখানে আবার ফিরে এলেন আন্দোলনকারীরা।
তখনও পিচের রাস্তায় সাদা রঙে ‘আমরণ অনশন’ লেখাটা মিলিয়ে যায়নি। তবে গাড়ি চলাচল শুরু হয়ে গিয়েছে। সাতসকালে সাফাইকর্মীরা এসে ঝেঁটিয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছেন রাস্তা। চাকরির দাবিতে লেখা পোস্টার-ফেস্টুন-প্ল্যাকার্ড সব গিয়ে জড়ো হয়েছে রাস্তার এক পাশে। বাজে কাগজের মতোই দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে রয়েছে।
চাকরির আন্দোলনকারীরা এলেন ১১টা নাগাদ। রাতটুকু কারও কেটেছে থানার লক আপে, কারও বা প্রিজন ভ্যানে, কাউকে আবার ভোররাতে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে জনমানবহীন শিয়ালদহ স্টেশনে।
আগের দিনই আন্দোলনকারীরা বলেছিলেন, ‘‘যদি বেঁচে থাকি আবার ফিরে আসব।’’ শুক্রবার তাঁরা এলেনও। তবে ১৪৪ ধারার কথা মাথায় রেখে, ছোট ছোট দলে ভেঙে। কোনও দল থামল সল্টলেকের করুণাময়ীর বাসস্ট্যান্ডে। কেউ মেট্রো স্টেশনে। ছোট একটি দল এসে থামল এপিসি ভবনের সামনেও। যেখানে গত চার দিন ধরে অনশন আন্দোলন চলছিল, ঠিক সেখানেই।
তখনও এলাকায় পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। বৃহস্পতিবার রাত থেকে র্যাফও রয়েছে। আন্দোলনকারীদের দলটিকে আটকানো হলে তারা জানায়, টেটে নিয়োগের আসন সংখ্যা বৃদ্ধির দাবিতে ডেপুটেশন জমা দিতে এসেছে তারা। পুলিশ যদিও তাদের অনুমতি দেয়নি। দলের অনেককেই আটক করা হয়। আবার শুরু হয় গোলমাল।
এর পর করুণাময়ী বাসস্ট্যান্ড এবং মেট্রো স্টেশনে অপেক্ষারত আন্দোলনকারীদের অন্য দলগুলিকেও খুঁজে বের করে আটক করে পুলিশ। তবে বিক্ষোভ বাড়তে শুরু করে এসএফআই এবং ডিওয়াইএফআই নেতৃত্ব বিক্ষোভস্থলে এসে পড়ায়। বৃহস্পতিবার রাতের পর শুক্রবার দুপুরে আবার ধুন্ধুমার বাধে সল্টলেকের করুণাময়ীতে।
এক দিকে নতুন করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে আসা টেট চাকরিপ্রার্থীরা, অন্য দিকে, বৃহস্পতিবার রাতে তাঁদের ‘বলপ্রয়াগ’ করে উৎখাত করার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করা এসএফআই-ডিওয়াইএফআই। দু’পক্ষকেই ছত্রভঙ্গ করতে আবার সক্রিয় হয় পুলিশ। সব মিলিয়ে নতুন করে পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ বাধে বিক্ষোভকারীদের।
রাস্তায় বসে বিক্ষোভ শুরু করেছিলেন ডিওয়াইএফআই-এর রাজ্য সভাপতি মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর সঙ্গীরা। তাঁদের টেনে-হিঁচড়ে সরানো হয়। বেশ কয়েক জনকে তোলা হয় প্রিজন ভ্যানে।
সেই শুরু। তার পর থেকে দিন ভর দফায় দফায় উত্তপ্ত হয়েছে করুণাময়ী। বাম ছাত্র-যুবদের আটক করার পর পুলিশের পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানাতে ঘটনাস্থলে পৌঁছন এবিভিপি-র সদস্যরাও। আবারও অশান্তি শুরু হয় করুণাময়ী চত্বরে।
দুপুরে প্রতিবাদ মিছিলে নামে বিজেপিও। আসানসোল দক্ষিণের বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পালের নেতৃত্বে মিছিল করেন বিজেপি কর্মীরা। চাকরিপ্রার্থীদের উপর পুলিশ ‘আগ্রাসনে’র প্রতিবাদ জানিয়ে বিধায়ক বলেন, ‘‘হয় চাকরি দিন, না হয় পদত্যাগ করুন। আন্দোলনকারীদের উপর যে ভাবে অত্যাচার হয়েছে, সেই নৃশংসতা চোখে দেখা যায় না।’’
উল্লেখ্য, সরাসরি নিয়োগের দাবিতে গত সোমবার থেকে আরও সক্রিয় আন্দোলনে নেমেছেন ২০১৪ সালের নন ইনক্লুডেড টেট উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থীরা। সল্টলেটের করুণাময়ীতে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের অফিস এপিসি ভবনের সামনে তাঁরা অবস্থান বিক্ষোভ শুরু করেন।
১৭ অক্টোবর সকালেই সল্টলেকের করুণাময়ী মোড় থেকে মিছিল করে এপিসি ভবনের সামনে যান তাঁরা। চাকরিপ্রার্থীদের একাংশকে পুলিশ সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও তাঁরা নড়েননি। বরং সেখানেই অবস্থান বিক্ষোভে বসে পড়েন তাঁরা।
মঙ্গলবার থেকে শুরু হয় চাকরিপ্রার্থীদের অনশন আন্দোলন, জল, খাবার ফেলে দিয়ে চাকরিপ্রার্থীরা ঘোষণা করেন, নিয়োগপত্র হাতে না পেলে আমরণ অনশন চালিয়ে যাবেন তাঁরা।
অন্য দিকে, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি গৌতম পালও জানিয়ে দেন, তাঁরা নিয়ম ভেঙে চাকরি দিতে পারবেন না তিনি। আন্দোলনকারীরা চাইলে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন। এমনকি, শুক্রবার থেকে টেটের নিয়োগ পরীক্ষার ইন্টারভিউয়ের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে বলেও জানিয়ে দেন তিনি।
চাকরিপ্রার্থীরা অবশ্য সেই শর্ত মানতে চাননি। তাঁরা সরাসরি জানিয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই ২০১৪ সালে প্রাথমিক শিক্ষক পদে নিয়োগের যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষা ‘টিচার এলিজিবিলিটি টেস্ট’ (টেট) পাশ করেছেন। তার পর দু’বার ইন্টারভিউও দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের হাতে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়নি। তাঁরা প্রশ্ন তোলেন, এর পরও আবার কেন তাঁদের ইন্টারভিউ দিতে হবে!
চাকরি দিলে তাঁদের আর কোনও ইন্টারভিউ ছাড়াই সরাসরি নিয়োগপত্র দিতে হবে— এই দাবিতে চলতে থাকে আন্দোলন।
চাকরিপ্রার্থীদের বিক্ষোভ-আন্দোলন নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে। জবাবে ব্রাত্য বলেন, ‘‘এই আন্দোলনকে রাজনীতির সুবিধার জন্য বিরোধীরা উস্কানি দিচ্ছেন।’’
প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। পাল্টা মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, যাঁরা সৎ ভাবে আন্দোলন করেন, তিনি তাঁদের পক্ষে।
বৃহস্পতিবার রাতে আন্দোলনকারীদের উৎখাতের নেপথ্যে ছিল কয়েকটি ঘটনাপ্রবাহ। দুপুরে এ ব্যাপারে কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয় প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ। তারা জানিয়েছিল আন্দোলনকারীদের জন্য পর্ষদের কর্মীদের কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে। তাদের দফতরে ঢোকার ব্যবস্থা করুক হাই কোর্ট।
এর পরই হাই কোর্ট রাজ্যকে নির্দেশ দেয় আন্দোলনস্থলে পুলিশ মোতায়েন করার। যাতে আন্দোলনকারীদের বাধা পেরিয়ে পর্ষদে ঢুকতে অসুবিধা না হয় কর্মীদের। রাজ্য বলেছিল, তারা ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে। কোর্ট সে ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট না করলেও জানিয়ে দেয়, ‘আপনারা বলছেন তাই লিখে দিচ্ছি।’ এই রায়ের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অনশনস্থল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় চাকরিপ্রার্থী আন্দোলনকারীদের।
হাই কোর্টের নির্দেশকে সামনে রেখেই বৃহস্পতিবার ২০১৪ সালের টেট উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন তুলতে প্রথমে অনুরোধ, তার পর হুঁশিয়ারি এবং শেষ পর্যন্ত বলপ্রয়োগ করে বিধাননগর পুলিশ।
তবে পুলিশের টানাটানির মধ্যে চোখের জল ফেলতে ফেলতেও আন্দোলনকারীরা জানিয়ে যান, আবার তাঁরা ফিরে আসবেন এই আন্দোলন স্থলেই।