গত ৩০ ডিসেম্বর হাওড়া থেকে নিউ জলপাইগুড়িগামী বন্দে ভারত এক্সপ্রেস উদ্বোধন হওয়ার পর থেকেই তা চর্চার কেন্দ্রে। চালু হতেই পর পর দু’বার পাথর ছোড়া হয়েছে সেই ট্রেনে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ট্রেনের বাইরের কাচ। রাজনৈতিক রংও লেগেছে এই ঘটনায়। উত্তাল হয়েছে রাজ্য। তবে বৃহস্পতিবার পূর্ব রেলের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বাংলা নয়, বন্দে ভারতে পাথর ছোড়া হয়েছিল বিহার থেকে।
পশ্চিমবঙ্গে চালু হওয়া প্রথম বন্দে ভারত এক্সপ্রেসে ঢিল ছোড়া নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। তবে বিতর্ক হলেও জন্মলগ্ন থেকেই পাথরবাজদের নিশানায় থেকেছে এই ট্রেন। বার বার পাথর ছোড়া হয়েছে বন্দে ভারতে।
জন্মলগ্নে বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের নাম ছিল ‘ট্রেন-১৮’। ২০১৯-এ ভারতে প্রথম চালু হয়েছিল এই ট্রেন। তার পর থেকে একে একে সাতটি বন্দে ভারত ট্রেন চালু হয়েছে দেশে। নবতম সংযোজন হাওড়া-নিউ জলপাইগুড়ি বন্দে ভারত।
নয়াদিল্লি থেকে কানপুর এবং এলাহাবাদ হয়ে বারাণসী পর্যন্ত প্রথম বন্দে ভারত ট্রেনটি চালু হয়েছিল ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু ‘ট্রেন-১৮’ নামে এই ট্রেনের পরীক্ষামূলক যাত্রার সময়েই তাতে ঢিল পড়েছিল। ভেঙে গিয়েছিল জানলার কাচ।
এর পর ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল, এই দু’মাসে কমপক্ষে ১২ বার ঢিল মেরে প্রথম বন্দে ভারত ট্রেনের কাচ ভাঙা হয়েছিল। তা-ও আবার বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশে। দিল্লি থেকে বারাণসীর দিকে যাত্রা করার সময়।
বিজেপির শাসনকালে এই ট্রেন চালু করে রেলমন্ত্রক। ট্রেনের উদ্বোধন করেছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। উত্তরপ্রদেশে তখন গেরুয়া ঝড়। মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে যোগী আদিত্যনাথ। তার পরেও কেন্দ্রের সেই ‘স্বপ্নের’ ট্রেনে পাথর ছোড়া হয়েছিল বিজেপি রাজ্য থেকেই।
প্রথম বন্দে ভারত চালুর প্রথম দু’মাসেই সেই ট্রেনের বিপুল ক্ষতি হয়। রেলকে বার বার ট্রেনটির কাচ বদলাতে হয়। সেই আবহে বন্দে ভারতের প্রতিটি কামরার বাইরের দিকে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় রেল।
মূলত পাথর ছোড়ার ঘটনা রুখতে এবং অভিযুক্তদের চিহ্নিত করতে ক্যামেরা লাগানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বন্দে ভারতের প্রতিটি কামরায় ছ’টি করে সিসিটিভি লাগানো হবে। রেলের নেওয়া সেই সিদ্ধান্তের জেরেই বৃহস্পতিবার বাংলায় চালু হওয়া বন্দে ভারতে পাথর ছোড়া অভিযুক্তদের চিহ্নিত করেছে রেল।
তবে বন্দে ভারতের প্রতি কামরায় ক্যামেরা বসিয়েও বিশেষ লাভ হয়নি। দিল্লি-বারাণসী বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের পর একে একে আরও ছ’টি বন্দে ভারত এক্সপ্রেস ভারতে চালু হয়েছে। পাথরের হামলা থেকে রক্ষা পায়নি এই ট্রেনগুলিও।
বন্দে ভারতের দ্বিতীয় ট্রেন চালু হয়েছিল ২০১৯-এর অক্টোবরে। কিন্তু এই ট্রেনের পরীক্ষামূলক যাত্রার সময়ও একই ঘটনা ঘটে। পাথর মেরে ভেঙে দেওয়া হয় ট্রেনটির সামনের কাচ।
এর পর আরও সাবধান হয় রেল। যাত্রীদের নিয়ে যাত্রা শুরুর প্রথম কয়েক দিন যে কোনও পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য দিল্লি-কাটরা বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের ৬৫৪ কিলোমিটার রুটে, জম্মু এবং পাঠানকোটের মতো সংবেদনশীল স্টেশনগুলিতে ভারতীয় সেনার বিশেষ কম্যান্ডোদের মোতায়েন করা হয়। তবে এত করেও পাথর ছোড়া আটকানো যায়নি। বন্দে ভারতে পাথর ছোড়ার একাধিক ঘটনা ঘটেছে এর পরেও।
গুজরাতের গান্ধীনগর থেকে মুম্বইগামী বন্দে ভারতের তৃতীয় ট্রেনেও একাধিক বার পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে। নভেম্বরে এই ট্রেনে চেপে আমদাবাদ থেকে সুরত যাচ্ছিলেন ‘অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ (মিম)-এর প্রধান আসাউদ্দিন ওয়েইসি। সঙ্গে ছিলেন দলের একাধিক নেতা।
মিম-এর নেতা ওয়ারিস খান দাবি করেন, তাঁদের যাত্রা করার সময় কিছু অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি কামরা লক্ষ্য করে পাথর ছোড়া শুরু করে। যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওই কামরার জানলার কাচ। এই ঘটনায় গুজরাতের শাসকদল বিজেপি কর্মীদের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলে মিম।
তবে গুজরাত সরকারের তরফে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। পশ্চিম রেলের পুলিশ সুপার জানান, এটি আদপেও পাথর ছোড়ার ঘটনা ছিল না। ভারুচ জেলার অঙ্কলেশ্বরের কাছে রেললাইনে কাজ চলছিল। বন্দে ভারত ট্রেনটি ওই জায়গা দিয়ে যাওয়ার সময় কিছু ছোট পাথর রেলের কাচে এসে লাগে। আর সেই কারণেই রেলের কাচ ভেঙে যায়।
এর পরের তিনটি বন্দে ভারত অর্থাৎ, দিল্লি-উনা, চেন্নাই-মাইসুরু এবং বিলাসপুর-নাগপুরগামী বন্দে ভারতেও বিক্ষিপ্ত ভাবে পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে।
পাথর ছুড়ে বন্দে ভারতের কাচ ভাঙার প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করতে আরও একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল রেলের তরফে। রেল মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছিল, বন্দে ভারতে এমন কাচ লাগানো হবে যা পাথরের আঘাত সহজেই সহ্য করে নেবে।
রেলের তরফে এ-ও জানানো হয়েছিল, নতুন কাচ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে। এই নয়া প্রযুক্তির কাচে রজনের প্রলেপ ছাড়াও ভিনাইলের আবরণ থাকবে বলেও জানিয়েছিল রেল।
বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বন্দে ভারতের গায়ে চাপে অপেক্ষাকৃত শক্ত এবং পাথরের আঘাতরোধী পলিকার্বনেটের জানলা। তবে তাতেও যে বিশেষ লাভ হয়নি তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হাওড়া-নিউ জলপাইগুড়িগামী বন্দে ভারত।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে গত ৩০ ডিসেম্বর উদ্বোধন করা হয় দেশের সপ্তম তথা বাংলার প্রথম বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের। সেই ট্রেন যাত্রা শুরু করতেই পর পর দু’বার পাথর খেয়েছে। যদিও কোনও যাত্রী আহত হননি।
বিজেপির দাবি ছিল, শাসকদলের কর্মীরা এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। যদিও প্রথম থেকেই রাজ্যের শাসকদল জোর গলায় বলেছিল, এই কাণ্ডে দলীয় কর্মীদের হাত নেই। সেই কথাই সত্যি প্রমাণিত করে রেলের তরফে বৃহস্পতিবার জানানো হয়, বাংলার বন্দে ভারতে পাথর ছোড়া হয়েছিল, কিন্তু সেই পাথর বিহারের ধূলাবাড়ি এবং মানগুরজান স্টেশনের মাঝামাঝি কোনও জায়গা থেকে এই পাথর ছোড়া হয়েছিল।