ভারত-কানাডার সম্পর্কের সাম্প্রতিক রসায়নের সূত্রে নতুন করে শিরোনামে উঠে এসেছে খলিস্তানি আন্দোলন। এই আন্দোলনের সমর্থনকারীরা ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিখদের নিয়ে আলাদা রাষ্ট্রের দাবি জানান।
১৯৮৪ সালে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল খলিস্তানি আন্দোলনের। এর পরেই প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেন ইন্দিরা-পুত্র রাজীব গান্ধী। খলিস্তানিদের ঠেকাতে পদক্ষেপ করেছিলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর খলিস্তানিদের দমন করতে ভারতের গুপ্তচর সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং ওরফে র-কে ব্যবহার করেছিলেন রাজীব। র আধিকারিকদের তিনি প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরে ভারতে খলিস্তানি আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদের তকমা দেওয়া হয় এবং নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। অভিযোগ, তার পরেও খলিস্তানিদের মদত দিচ্ছিল পাকিস্তান।
শোনা যায়, আশির দশকের গোড়া থেকে খলিস্তানি জঙ্গিদের নিয়মিত অস্ত্র জোগাতে শুরু করেছিল পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশ এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে খলিস্তানিদের আলাদা করে প্রশিক্ষণও দেওয়া হত বলে অভিযোগ।
পাকিস্তানে খলিস্তান আন্দোলনকে মদত দেওয়ার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহে ভারতকে সাহায্য করেছিল আফগানিস্তান। সে দেশের গুপ্তচর সংস্থা ‘খাদ’-এর সঙ্গে এই সময় র-এর ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গিয়েছিল। খাদ পাকিস্তান সম্পর্কে অনেক তথ্য র-কে দিত।
খলিস্তানিদের ঠেকাতে র-কে প্রত্যাঘাতের নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব। নির্দেশ পেয়ে র দু’টি গোপন দল তৈরি করেছিল। তাদের হাতেই ছিল খলিস্তান আন্দোলনকে দমন করার ভার।
র-এর অভ্যন্তরে যে দু’টি দল তৈরি করা হয়েছিল তাদের নাম কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স টিম-এক্স (সিআইটি-এক্স) এবং কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স টিম-জে (সিআইটি-জে)।
টিম-এক্স-এর কাজ ছিল, খলিস্তানিদের মদত দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে উস্কানোর জবাবে পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দেওয়া। শোনা যায়, লাহোর-করাচিতে গোপন হামলা চালাতেন এই দলের সদস্যেরা।
দ্বিতীয় দল টিম-জে। এদের কাজ ছিল খলিস্তানি জঙ্গি নেতাদের নিশানা করা। বিদেশের মাটিতে যেখান থেকে হোক তাঁদের খুঁজে বার করে হত্যা করত টিম-জে। বিদেশে পালিয়েও নিস্তার ছিল না কারও।
শোনা যায়, ভারতের মাটিতে খলিস্তানি সন্ত্রাসবাদীদের প্রতিটি হামলার জবাব পাকিস্তানের মাটিতে গিয়ে দিয়েছিল র। তবে সবটাই গোপনে। বিশেষত, লাহোর এবং করাচিতে গোপনে একাধিক বোমা হামলা চালানো হয়েছিল বলে শোনা যায়।
র-এর গোপন অভিযান পাকিস্তানে ব্যাপক শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। ‘টিম-জে’-এর একের পর এক অপারেশনে নাজেহাল হয়ে উঠেছিল পাক গুপ্তচর সংস্থা। শেষমেশ তাদেরই পিছু হঠতে হয়।
তৎকালীন র প্রধানের সঙ্গে দেখা করেন আইএসআই প্রধান। তাঁদের মধ্যে চুক্তি হয়, পঞ্জাবের বিষয়ে আর তারা কেউ নাক গলাবে না। অর্থাৎ, ভারতের পঞ্জাব সমস্যা থেকে দূরে থাকবে আইএসআই। আবার পাক পঞ্জাব থেকেও দূরে সরে যাবে র।
অতীতে পাকিস্তানের তরফেও র-এর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ ছিল। বলা হত, পাকিস্তানের সিন্ধ্রি জাতীয়তাবাদীদের পৃথক রাষ্ট্রের দাবিকে সমর্থন করে ভারত। যদিও নয়াদিল্লি এই অভিযোগ অস্বীকার করে।
অবশ্য, বালুচিস্তানের ‘বিদ্রোহী’দের সমর্থন করার কথা ভারত স্বীকার করে নিয়েছে। আফগানিস্তানে পাক-বিরোধী দলকেও ভারত সমর্থন করেছে। যদিও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দাবি, এখন আর এ সব নিয়ে মাথা ঘামায় না ভারত।
ভারতে নিষিদ্ধ হওয়ার পর খলিস্তানিরা অনেকেই কানাডায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। সহজে সেখানকার নাগরিকত্বও পেয়ে যান তাঁরা। কানাডার বিরুদ্ধে ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় নাক গলানো এবং নিষিদ্ধ আন্দোলনকে মদত দেওয়ার অভিযোগ এনেছে নয়াদিল্লি।
নিষিদ্ধ সংগঠন খলিস্তান টাইগার ফোর্সের নেতা হরদীপ সিংহ নিজ্জরকে গত জুন মাসে কানাডায় গুলি করে খুন করা হয়। এই ঘটনার ভারতের ‘এজেন্ট’দের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।
কানাডার বিদেশ মন্ত্রক সে দেশে ভারতীয় কূটনীতিক হিসেবে নিযুক্ত পবন কুমার রাইকে কানাডায় র’-এর ‘স্টেশন চিফ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাঁকে পদচ্যুত করে দেশে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পবন একসময় পঞ্জাব পুলিশের দাপুটে অফিসার হিসাবে পরিচিত ছিলেন।
শুধু নিজ্জরই নন, গত এক বছরে একের পর খলিস্তানি নেতারা কেউ পাকিস্তানে, কেউ ব্রিটেনে রহস্যজনক ভাবে খুন হয়েছেন। যে পরিসংখ্যান থেকে প্রশ্ন উঠছে, তবে কি আবার জেগে উঠল রাজীবের আমলের সেই ‘টিম-জে’?
গত মার্চ মাসে খলিস্তানপন্থীরা লন্ডনে ভারতীয় হাই কমিশনের দফতর থেকে ভারতের জাতীয় পতাকা নামিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন নিষিদ্ধ সংগঠন খলিস্তানি লিবারেশন ফোর্সের প্রধান অবতার সিংহ খান্ডা। এক মাসের মধ্যে বার্মিংহামের হাসপাতালে বিষক্রিয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়।
২০২১-এ মোহালিতে পঞ্জাব পুলিশের দফতরে হামলায় অভিযুক্ত হরবিন্দর সিংহ সান্ধু। বিদেশের মাটিতে রহস্যমৃত্যু হয়েছে তাঁরও। পাকিস্তানের হাসপাতালে ওষুধের বিষক্রিয়ায় মারা যান তিনি।
ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের আইসি-৮১৪ বিমান অপহরণে জড়িত জ়াহুর মিস্ত্রি গত বছর মার্চে রাওয়ালপিন্ডিতে খুন হন। তার এক মাসের মধ্যে হিজবুল মুজাহিদিন কমান্ডার বশির অহমেদ পিরকে সেই রাওয়ালপিন্ডিতেই গুলি করে মারা হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অল বদরের কমান্ডার সৈয়দ খালিদ রাজাকে করাচিতে খুন করা হয়।
এই ঘটনাপ্রবাহ র-এর গোপন দল ‘টিম-জে’-এর কার্যকলাপকে মনে করাচ্ছে। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের কেউই এ নিয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি। বরং কানাডার অভিযোগের বিরোধিতাই করছে নয়াদিল্লি।