বাজারে চলতি প্রবাদ— নীল আমস্ট্রং যখন প্রথম চাঁদে পা রেখেছিলেন, তখন তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিলেন এক মালয়ালি! বিশ্ব জুড়ে মালয়ালিদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকায় চালু হয়েছিল এই প্রবাদ।
সাম্প্রতিক কালে কেরল ছাড়ার হিড়িক এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে, এর প্রভাব সরাসরি পড়তে শুরু করেছে দক্ষিণের এই রাজ্যটির অর্থনীতিতে। কেরল সরকারের নিজস্ব রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মধ্যে ১৮২টি দেশে কর্মরত কেরলের বহু মানুষ। ২০১৮ সালের ‘কেরল মাইগ্রেশন রিপোর্ট’ অনুযায়ী, ইতিমধ্যেই ২১ লক্ষ মালয়ালি বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। যদিও অনেকের দাবি, আসল সংখ্যাটা এর চেয়ে অনেক বেশি।
মালয়ালম ভাষায় ‘কেরল’ শব্দের অর্থ ‘নারকেলের দেশ’। ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে মালাবার উপকূল জুড়ে গড়ে ওঠা কেরল ভারতের অন্যতম উন্নত রাজ্যগুলির একটি। সৈকতের গায়ে আছড়ে পড়া আরব সাগরের ঢেউ, ভেষজে সমৃদ্ধ সহ্যাদ্রি পর্বত, ঢেউখেলানো সবুজ চা-বাগান, উচ্ছল ঝর্না, ব্যাকওয়াটারের ধারে গ্রামজীবনের ছবি, রাজকীয় হাউসবোট, সংরক্ষিত অরণ্যে পাখি ও বন্যপ্রাণীর বিচরণ, কফি ও মশলার বাগান, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ও স্পা— সব মিলিয়ে কেরল সত্যিই যেন ‘ভগবানের আপন দেশ’!
আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে ভারতের বহু রাজ্যের থেকে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও কেন কেরল ছাড়ার হিড়িক বাড়ছে? কেন ‘ভগবানের দেশ’ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিতে চাইছেন মালয়ালিরা?
এত দিন শোনা যেত, পাখিরা পরিযায়ী হয়। অতিমারিকালে দেখা গিয়েছিল, মানুষের মধ্যে এই স্বভাব রয়েছে। করোনার সময় দেখা গিয়েছিল, শ্রমিকেরা দলে দলে নিজেদের কর্মক্ষেত্র থেকে অন্য রাজ্যে, নিজের দেশ-গাঁয়ে ফিরে যাচ্ছেন। আবার অতিমারির প্রভাব কমতেই তাঁরা দলে দলে ফিরে গিয়েছিলেন ভিন্ রাজ্যে, নিজেদের কর্মক্ষেত্রে।
আবার অন্য রকম পরিযায়ীও আছেন। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের মানুষ, যাঁরা ভাবেন, উন্নত দেশে গেলে হয়তো বাকি জীবনটা সুখে-শান্তিতে কাটবে। ভাবেন, এমন একটি দেশে থাকা ভাল, যেখানে আইনকানুন মানা হয়, মাথার উপর ধর্মান্ধতার খাঁড়া নেই, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ভাল হয়, যেখানে শেষ বয়সে একটি উন্নত স্বাস্থ্যপরিষেবা পাওয়া যাবে। মালয়ালিদের ক্ষেত্রেও বিষয়টা তেমনই।
কানাডায় গত দু’বছর ধরে রয়েছেন কেরলের বাসিন্দা অ্যালান রেগি ভার্গিস। সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘ভাল চাকরি, ভাল বেতনের আশাতেই কেরল ছেড়েছি। কানাডায় পরিকাঠামো অনেক ভাল। জীবনযাত্রার মানও উন্নত। স্বাধীনতাও অনেক বেশি।’’
অভিবাসী মালয়ালিদের মধ্যে যাঁরা অদক্ষ শ্রমিক, তাঁদের পছন্দই হল উপসাগরীয় দেশ সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন। রিপোর্ট বলে, তাঁরা কেরলের অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ। বিদেশে বছরের পর বছর কাজ করে বিপুল টাকা রোজগার করে তাঁরা আবার নিজের দেশেই ফিরে আসেন।
আবার রাজ্যের দক্ষ শ্রমিকদের পছন্দ আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জ়িল্যান্ড ছাড়াও ইউরোপের বহু দেশ। প্রবণতা বলছে, তাঁদের অনেকেই ভবিষ্যতে ওই সব দেশে পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করে দেন।
হিংসায় দীর্ণ দেশগুলিতেও মালয়ালিদের যাতায়াত বেড়েছে সম্প্রতি। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, ইউক্রেন ছাড়াও সোমালিয়া, আফগানিস্তানে মালয়ালিদের দেখা মেলে। সরকারি রিপোর্টে দাবি, যে দু’টি দেশে মালয়ালিদের একেবারেই দেখা মেলে না, তা হল— পাকিস্তান এবং উত্তর কোরিয়া।
মালয়ালিদের মধ্যে কেরল ছাড়ার হিড়িক কতটা, অনেকের মতে এর অন্যতম নির্দেশক— সে রাজ্যের ‘ভূতুড়ে’ বাড়ির সংখ্যা! সরকারি হিসাবে, কেরলে পরিত্যক্ত বাড়ির সংখ্যা ইতিমধ্যেই ১২ লাখের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে।
পূর্বপুরুষের ভেঙে পড়া ভিটে থেকে হাল আমলে তৈরি ঝাঁ-চকচকে বাংলো— কেরলে পরিত্যক্ত বাড়ির তালিকায় রয়েছে সবই। বাড়ির মালিকদের বেশির ভাগই থাকেন প্রবাসে।
২০১১ সালের জনগণনার পরিসংখ্যান বলছে, কেরলে মোট এক কোটি বাড়ির মধ্যে ১১ শতাংশই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। দেশের মধ্যে কেরলেই সবচেয়ে বেশি পরিত্যক্ত বাড়ি রয়েছে বলে দাবি সরকারি রিপোর্টে।
সরকারি রিপোর্টে দাবি, শুধু চাকরির জন্য নয়, রাজ্যের তরুণেরাও বিদেশে চলে যান পড়াশোনা করতে। বিশ্বের অন্তত ৫৪টি দেশে শুধু পড়াশোনা করতেই যান মালয়ালিরা। সেই সব দেশের তালিকায় বাংলাদেশ, জামাইকাও রয়েছে।
এর জেরে রাজ্যের বহু কলেজের অবস্থাও শোচনীয়। হিসাব বলছে, রাজ্যের বিভিন্ন কলেজ মিলিয়ে শূন্য আসনের সংখ্যা ছুঁয়েছে ৮২,২৩০।