কখনও বিদেশের স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছেন, কখনও বা বিশ্বের সেরা পত্রিকায় পৃথিবীর প্রথম সারির মহিলা শিল্পপতিদের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন ৭৮ বছর বয়সি শাহনাজ হুসেন। ২০০৬ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হয়েছেন শাহনাজ। তাঁর জীবনে কখনও এসেছে পুত্রশোক, কখনও জুটেছে পরিবারের কটাক্ষ। বর্তমানে ২৫০ কোটি টাকা সম্পত্তি রয়েছে তাঁর।
১৯৪৪ সালের ৫ নভেম্বরে বিত্তশালী পরিবারে জন্ম শাহনাজের। তাঁর বাবা ইলাহাবাদ হাই কোর্টের বিচারপতি ছিলেন। হায়দরাবাদ সেনার কমান্ডার-ইন-চিফের কন্যা ছিলেন শাহনাজের মা। শাহনাজের ঠাকুরদাও হায়দরাবাদ হাই কোর্টের বিচারপতি ছিলেন।
হায়দরাবাদ থেকে স্কুলের গণ্ডি পার করেছিলেন শাহনাজ। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয় তাঁর। তাঁর স্বামী নাসির হুসেনও পেশায় বিচারক ছিলেন। শাহনাজ এবং নাসিরের পরিবারের মধ্যে ভাল সম্পর্ক ছিল। সেই সূত্রেই বিয়ে ঠিক হয় দু’জনের।
শাহনাজের সঙ্গে বিয়ের পর পেশার কারণে ইরানে বদলি হয়ে যান নাসির। শাহনাজের আগ্রহ জন্মায় আয়ুর্বেদের প্রতি। তা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। ‘কস্মেটিক থেরাপি’র প্রশিক্ষণ নেন তিনি।
বিয়ের দু’বছরের মধ্যে দুই সন্তানের জন্ম দেন শাহনাজ। স্বামী এবং দুই সন্তান নিয়ে সুখের সংসার ছিল শাহনাজের। কিন্তু কিছু দিন সংসার করার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে তাঁর। জীবনে তিনি ঠিক কী করতে চান তা ঠাহর করতে পারছিলেন না।
রূপটানজগৎ নিয়ে আরও পড়াশোনা শুরু করেন শাহনাজ। তার পর ইরান থেকে ভারতে ফিরে নয়াদিল্লিতে নিজের বাড়ির নীচে একটি পার্লার তৈরি করেন তিনি। সেই পার্লারে নিজস্ব প্রসাধনীও বিক্রি করতে শুরু করেন তিনি।
কোনও রকম বিজ্ঞাপনের প্রচার ছাড়াই লোকমুখে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকেন শাহনাজ। ১৯৭১ সালে তিনি যে পার্লার তৈরি করেছিলেন, তার সাফল্যও তরতর করে বাড়তে থাকে। এমনকি তাঁর প্রসাধনীর প্রশংসাও ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
ব্যবসা এবং সংসার নিয়ে শাহনাজের জীবন ব্যস্ত ছিল। ১৯৯৯ সালে তাঁর জীবনে ঝড় ওঠে। হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান নাসির। নিজেকে শক্ত হাতে সামলান শাহনাজ। সংসার সামলাতে ব্যবসার দিকে আরও মন দেন তিনি।
স্বামীর মৃত্যুর পর পুত্রকেও হারিয়ে ফেলেন শাহনাজ। ২০০৮ সালে শাহনাজের পুত্র সমীর আত্মহত্যা করেন। পেশায় র্যাপার ছিলেন সমীর। পুত্রশোকে ভেঙে পড়েন শাহনাজ।
সন্তান এবং ব্যবসা নিয়ে থাকলেও একা হয়ে পড়েন শাহনাজ। রাজকুমার পুরী নামে এক জনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় শাহনাজের। রাজকুমারের সঙ্গে সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়েন তিনি। সাতপাকে বাঁধা পড়ার সিদ্ধান্ত নেন শাহনাজ এবং রাজকুমার। তার পরেই পরিবারের কটাক্ষের শিকার হন শাহনাজ।
শাহনাজ যে আবার নতুন ভাবে তাঁর জীবন শুরু করতে চান তা জানার পর আপত্তি জানান শাহনাজের শ্বশুরবাড়ির সদস্যেরা। কিন্তু সব কটাক্ষ উপেক্ষা করে রাজকুমারের সঙ্গে বিয়ে করেন তিনি।
নয়াদিল্লিতে বাড়ির নীচে পার্লার থেকে কেরিয়ার শুরু করেছেন শাহনাজ। জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৭৯ সালে কলকাতায় নিজের ব্যবসার প্রসার ঘটান শাহনাজ।
ধীরে ধীরে সারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে নিজের ব্যবসা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে লন্ডনেও পার্লার খোলেন শাহনাজ। নিজের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও গড়ে তোলেন তিনি।
নিজ গুণের জন্য অসংখ্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরের পুরস্কার পেয়েছেন শাহনাজ। কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘রেড কার্পেট’-এও হাঁটতে দেখা যায় তাঁকে।
পাঁচ দশক আগে একটি ছোট পার্লারের মাধ্যমে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন শাহনাজ। আজ সেই স্বপ্নই আকাশ ছুঁয়েছে। দেশ-বিদেশে যথেষ্ট নামডাক হয়েছে তাঁর। বিনা প্রচারে নিজস্ব সংস্থা বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিয়েছেন বলে মহিলা শিল্পপতিদের তালিকায় প্রথম সারিতে জ্বলজ্বল করছে শাহনাজের নাম।