আদালতে তখন তিলধারণের জায়গা নেই। যৌন নির্যাতন করে পড়শির ৭ বছরের মেয়েকে খুন করার অভিযোগে ক্লাউস গ্রাবাউস্কির বিরুদ্ধে মামলার শুনানি সবে শুরু হয়েছে। হঠাৎই ভরা আদালতে পর পর ৮টি গুলির শব্দ। তত ক্ষণে রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেয় লুটিয়ে পড়েছেন মামলার অভিযুক্ত ৩৫ বছরের ক্লাউস।
১৯৮১ সালের ৬ মার্চ। ওই দিন ভরা আদালতে পরের পর গুলি করে ক্লাউসকে খুন করেন আনা বাখমায়ার নামে এক শিশুকন্যার মা মারিয়ান বাখমায়ার। ক্লাউসকে লক্ষ্য করে ৮টি গুলি চালালেও তাঁর পিঠে ৬টি গুলি লাগে। আদালতেই মৃত্যু হয় ক্লাউসের।
পেশায় কসাই ক্লাউস ছিলেন মারিয়ানের পড়শি। ঘটনার দিন মায়ের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি হওয়ায় স্কুলে যাবে বলে বেরিয়েও স্কুল যায়নি আনা। এর পর ক্লাউসের খপ্পরে পড়ে সে। অভিযোগ, আনাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজের ঘরে আটকে রেখে তার উপর যৌন অত্যাচার চালান ক্লাউস। এর পর তাকে শ্বাসরোধ করে খুন করেন। দিনটি ছিল ১৯৮০ সালের ৫ মে।
তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির লুবেক শহরের এই খুনের ঘটনায় দেশ জুড়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। আদালতকক্ষে ক্লাউসের খুনের পর তা নিয়ে আরও হইচই পড়ে যায়। ঘটনার প্রায় ৪২ বছর পরে একে যুদ্ধ পরবর্তী যুগে জার্মানির সবচেয়ে চর্চিত প্রতিশোধের উদাহরণ হিসাবে তকমা দেওয়া হয়।
এই মামলায় তদন্তকারীদের দাবি ছিল, খুনের পর আনার ছোট্ট দেহটি বাক্সবন্দি করে একটি খালের ধারে রেখে এসেছিলেন ক্লাউস। তবে ঘটনার রাতেই ধরা পড়ে যান তিনি। ক্লাউসের বান্ধবীই পুলিশকে সতর্ক করেন, কোনও কিছু একটা গোলমাল ঘটেছে এবং তাতে জড়িত ক্লাউস। এর পর তাঁকে গ্রেফতার করে লুবেক পুলিশ।
পুলিশি জেরায় আনাকে খুনের কথা স্বীকার করেছিলেন ক্লাউস। যদিও তার উপর যৌন নির্যাতনের কথা অস্বীকার করেন তিনি। উল্টে তাঁর দাবি ছিল, ৭ বছরের আনাই তাঁকে যৌন প্রলোভন দেখানোর চেষ্টা করেছিল। এমনকি, সে ব্ল্যাকমেল করে অর্থ আদায় করতে চেয়েছিল বলেও দাবি করেন ক্লাউস। অর্থ না দিলে মায়ের কাছে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করবে বলে ক্লাউসকে হুমকিও দেয় সে।
শিশুদের উপর যৌন হেনস্থার অভিযোগে আগেও দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন ক্লাউস। ফলে বছরখানেকের মধ্যে আনার খুনের মামলার তদন্ত গুটিয়ে ফেলে পুলিশ। যদিও আনার উপরে যৌন নির্যাতন চলেছিল কি না, তা স্পষ্ট ভাবে বলতে পারেননি তদন্তকারীরা।
’৮১-র ৬ মার্চ ছিল এই খুনের মামলার শুনানির তৃতীয় দিন। লুবেকের জেলা আদালতে হাজির ছিলেন আনার মা মারিয়ানও। সঙ্গে তাঁর হাতব্যাগে ভরে এনেছিলেন একটি .২২ ক্যালিবারের বেরেতা পিস্তল। তা থেকেই পর পর ৮টি গুলি করেছিলেন মারিয়ান।
প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, ওই দিন আনাকে নিয়ে কুকথা বলেছিলেন ক্লাউস। তা শুনেই গুলি চালান মারিয়ান। জেলা আদালতের বিচারক গুন্থার ক্রোগার জানান, গুলিচালনার পর মারিয়ানের সঙ্গে তিনি কথা বলেছিলেন। বিচারকের দাবি, সে সময় শোকাহত মায়ের মুখ থেকে একটি কথাই বেরিয়েছিল, ‘‘আমি ওকে খুন করতে চেয়েছিলাম।’’
অনেকের দাবি, ক্লাউসকে খুনের পর মারিয়ান বলতে থাকেন, ‘‘ও আমার মেয়েকে খুন করেছে... আমি ওর মুখে গুলি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু গুলি ওর পিঠে গিয়ে লাগে... আশা করি, মারা গিয়েছে ও।’’ দু’জন পুলিশকর্মীর দাবি, গুলি করার পর ক্লাউসকে গালিগালাজও করেন মারিয়ান।
মেয়ের ‘খুনিকে’ খুন করার পর ওই আদালতেই শুনানির মুখোমুখি হয়েছিলেন আনার মা। শুনানির সময় নিজের বয়ানে মারিয়ান দাবি করেন, স্বপ্নে দেখেছেন, ক্লাউসকে তিনি খুন করছেন এবং সে সময় আদালতে দাঁড়িয়ে আনা।
মারিয়ানের মানসিক অবস্থা খতিয়ে দেখার জন্য তাঁর হস্তলিপির নমুনা পরীক্ষা করেছিলেন এক চিকিৎসক। তিনি জানান, সেই কাগজে মারিয়ান লিখেছিলেন, ‘‘আনা, তোমার জন্য এমনটা করেছি।’’ এর পর ওই লাইনের পাশে ৭টি হৃদয়ের ইমোজি এঁকেছিলেন। খুন হওয়ার সময় যা ছিল আনার বয়স।
শিশুকন্যাকে ‘খুনের’ প্রতিশোধের এই কাহিনি ফলাও করে ছেপেছিল তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির সংবাদমাধ্যম। অনেকের দাবি, মামলার খরচ তুলতে ‘স্টার্ন’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় নিজের সম্পর্কে নানা কথা ছাপার স্বত্ব বিক্রি করেছিলেন মারিয়ান। সে জন্য ১৫৮,০০ ডলার (বর্তমান ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১ কোটি ২৮ লক্ষ টাকা)।
ক্লাউসকে খুনের অপরাধে ’৮৩-তে মারিয়ানকে ছ’বছরের জন্য কারাবাসের সাজা দেয় জেলা আদালত।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মারিয়ানের কথা গ্রোগাসে গিলতেন পাঠকেরা। অ্যালেনবাখ ইনস্টিটিউটের তরফে তাঁকে নিয়ে সমীক্ষাও চালানো হয়েছিল। শিশুকন্যার খুনের বদলা নিতে মারিয়ান ঠিক কাজই করেছেন বলে মত দিয়েছিলেন ২৮ শতাংশ জার্মান। ২৭ শতাংশ জানিয়েছিলেন, এই খুনের জন্য এত বছরের সাজা দেওয়াটা বাড়াবাড়ি। অন্য দিকে, ২৫ শতাংশের মতে, অতি অল্পেই পার পেয়ে গিয়েছেন মারিয়ান।
ছ’বছরের কারাবাসের সাজা কাটানোর আগেই জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গিয়েছিলেন মারিয়ান। ’৮৫-র জুনে জেলের বাইরে বার হন তিনি। এর পর দেশ ছেড়ে নাইজিরিয়ায় গিয়ে থাকতে শুরু করেন। সেখানেই সংসার পেতেছিলেন তিনি। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত সে দেশেই কাটান।
নাইজিরিয়ায় থাকাকালীন স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছিল মারিয়ানের। এর পর ইটালির সিসিলিতে বসবাস করতে শুরু করেন। সেখানেই অগ্ন্যাশয়ে ক্যানসার ধরা পড়ে তাঁর। এর পর সংযুক্ত জার্মানিতে ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। ’৯৬-এ লুবেক শহরে ৪৬ বছর বয়সে মারা যান মারিয়ান।