এসএসসি দুর্নীতি মামলার তদন্তে নেমে শুক্রবার রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালায় ইডি। এর মধ্যে ছিল রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাকতলার বাড়িও। তালিকায় ছিল প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মানিক ভট্টাচার্য এবং রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশচন্দ্র অধিকারীর বাড়িও। শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ পার্থের বাড়ি পৌঁছন ইডি আধিকারিকেরা। এর পর টানা প্রায় ২৭ ঘণ্টার প্রশ্নোত্তর। তার পরেই ইডির হাতে গ্রেফতার হন পার্থ। আটক করা হয়েছে ‘পার্থ-ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়কেও। অর্পিতার বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে নগদ ২১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা এবং বহুমূল্যের গয়না।
তবে এই প্রথম নয়। এর আগেও বিভিন্ন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা হানা দিয়েছে বিভিন্ন রাজ্যের একাধিক নেতা-মন্ত্রীর বাড়ি এবং দফতরে। ঘটনাচক্রে, সিংহভাগ ক্ষেত্রে সে সব রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল না বিজেপি। গত পাঁচ বছরে এই তল্লাশি-অভিযানের সংখ্যা আরও বেড়েছে।
পার্থ ছাড়াও তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির কড়া নজর রয়েছে। কয়লাপাচার মামলায় অভিষেক এবং তাঁর স্ত্রীকে একাধিক বার তলব করা হয়। এমনকি, তাঁর বাড়িতেও যায় সিবিআই।
বার বার তলব করা সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত তৃণমূল সাংসদ অভিষেকের সঙ্গে কয়লা-কাণ্ডের যোগ প্রমাণ করতে পারেনি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি এক নির্বাচনী সমাবেশে বিরোধী কংগ্রেসকে সতর্ক করে হুঙ্কার ছেড়েছিলেন, তাঁর কাছে সকলের দুর্নীতির হিসাব রয়েছে এবং তিনি তা খুব শীঘ্রই সামনে আনবেন।
চলতি বছরের ১ জুন ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’-এর সঙ্গে যুক্ত একটি আর্থিক তছরুপ মামলায় কংগ্রেসের সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীকে তলব করে ইডি। তলব করা হয় রাহুল গাঁধীকেও।
তার ঠিক দু’দিন আগে ইডি আধিকারিকরা হাওয়ালা মামলায় দিল্লির মন্ত্রী তথা আম আদমি পার্টির নেতা সত্যেন্দ্র জৈনকে গ্রেফতার করে। অরবিন্দ কেজরীবালের আপ সরকারের স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, স্বরাষ্ট্র-সহ একাধিক দফতরের মন্ত্রী ছিলেন সত্যেন্দ্র।
সত্যেন্দ্রর গ্রেফতারের পর আপ নেতা সঞ্জয় সিংহ বলেন, মন্ত্রীর বাড়িতে ইডি সাত বার হানা দেয়। দাবি করেন, আপ-কে বদনাম করার উদ্দেশ্যে কেন্দ্র চক্রান্ত করছে।
আর্থিক তছরুপ মামলায় শিবসেনার মন্ত্রী অনিল পরবের বাড়িতেও ইডি অভিযান চালায়। সেই সময় সরকারে থাকা মহাবিকাশ আঘাডী জোট সরকার এর ব্যাপক সমালোচনা করে। দাবি করা হয়, মহারাষ্ট্রে সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হওয়ার পর বিজেপি এই ভাবে ‘রাজনৈতিক প্রতিশোধ’ নিচ্ছে।
এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে মহারাষ্ট্রের সংখ্যালঘু মন্ত্রী নবাব মালিককেও আর্থিক তছরুপের মামলায় গ্রেফতার করা হয়।
তবে মহারাষ্ট্রের জোট সরকারের দাবি ছিল, মন্ত্রীকে তাঁর নির্ভীক মনোভাব এবং কেন্দ্রের বিরুদ্ধে একাধিক বার তোপ দাগার কারণেই গ্রেফতার করা হয়েছে। শিবসেনার তরফে দাবি করা হয়, আরিয়ান খান মাদক মামলায় এনসিবি-র বিরুদ্ধে মুখ খোলাতেই তাঁর এই পরিণতি।
যদিও বিজেপি নেতা এবং মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডনবীস দাবি করেছিলেন, আর্থিক তছরুপের সঙ্গে জড়িত থাকার পাশাপাশি মালিক এবং তাঁর পরিবারের আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে।
২০২১-এর নভেম্বরে মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনিল দেশমুখের বাড়িতেও হানা দেয় ইডি। তোলাবাজি এবং আর্থিক তছরুপের মামলায় দেশমুখকে ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেফতার করে ইডি। মুম্বই পুলিশের প্রাক্তন কমিশনার পরমবীর সিংহের আনা অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর উপর একযোগে তদন্ত শুরু করে ইডি এবং সিবিআই। তিনি এখনও জেলে রয়েছেন।
২০১৫ সাল থেকে কংগ্রেস নেতা তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের ছেলে তথা কংগ্রেস সাংসদ কার্তি চিদম্বরমকে একাধিক বার বিভিন্ন মামলায় জেরা করেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি। কার্তি গ্রেফতারও হয়েছেন।
২০২০-র একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের ইতিহাসে কার্তির উপরেই এখনও পর্যন্ত সব থেকে বেশি জোর দিয়েছে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি।
কর্নাটক কংগ্রেসের সভাপতি ডিকে শিবকুমার চলতি বছরের ১ জুলাই আর্থিক তছরুপের মামলায় তলব করেছিল সিবিআইয়ের বিশেষ আদালত। তবে এর আগে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে শিবকুমারকে টাকা পাচার এবং করফাঁকির অভিযোগে গ্রেফতার করে ইডি। ২০১৭ সালেও শিবকুমারের বেঙ্গালুরুর বাসভবন এবং অফিসে আয়কর দফতর অভিযান চালায়।
শুধু কেন্দ্রের বিরোধী দলের নেতা-মন্ত্রী নন, কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির প্রকোপ পড়েছে সেই সব দলের মুখ্যমন্ত্রীদের উপরেও।
২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি হরিয়ানার জিন্দে উপনির্বাচনের ঠিক এক দিন আগে কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা এবং হরিয়ানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভূপিন্দর সিংহ হুডার বিরুদ্ধে হরিয়ানার গুরুগ্রামে কৃষকদের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণে প্রতারণা এবং দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করে সিবিআই। এর আগেও হুডার বিরুদ্ধে দু’বার মামলা দায়ের করে এই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।
রোহতকে হুডার বাসভবন-সহ ২০টি জায়গায় অভিযান চালায় সিবিআই। ওই অভিযানকে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’ এবং ‘বিরোধীদের কণ্ঠরোধের চেষ্টা’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর ২০১৬ পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন ক্ষমতাসীন অখিলেশ সরকারের বিভিন্ন নেতাদের উপর একাধিক বার অভিযান চালায় সিবিআই। রাজ্য জুড়ে অবৈধ খনি মামলার তদন্ত শুরু করে এই অভিযানগুলি চালানো হয়।
উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব কেন্দ্রের সমালোচনা করে সিবিআইয়ের ওই অভিযানগুলিকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
২০১৮ সালের অগস্টে গুজরাতের রাজ্যসভার কংগ্রেস সাংসদ আহমদ পটেলকে দ্বিতীয় বারের জন্য স্টার্লিং বায়োটেক সংস্থার ঋণখেলাপি এবং অর্থপাচার মামলায় যুক্ত করে ইডি।
২০১৭ সালে ওড়িশায় পঞ্চায়েত নির্বাচন শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগে মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কের দফতরের বিভিন্ন কর্মীদের বাড়িতে হানা দেয় সিবিআই। অভিযান চালানো হয় এক জন বিধায়ক এবং সাংসদের বাড়িতেও।
২০১৬ সালে কয়েক জন বিধায়ক সরকার থেকে সরে গেলে উত্তরাখণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হরিশ রাওয়তের সরকার ভাঙনের মুখে পড়ে। রাওয়তকে বিধানসভায় তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের সুযোগ দেয় উত্তরাখণ্ড হাই কোর্ট। কিন্তু আস্থাভোটের ঠিক আগে বিজেপি নেতা রঘুনাথ চহ্বনের দায়ের করা জনস্বার্থ মামলার ভিত্তিতে রাওয়তকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে সিবিআই। তবে আস্থাভোটের কারণ দেখিয়ে হাজিরা দিতে যাননি হরিশ।
২০১৪-র ১৫ অক্টোবর হরিয়ানায় বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক ১০ দিন আগে সিবিআই ভারতীয় জাতীয় লোকদলের প্রধান ওমপ্রকাশ চৌটালার জামিন বাতিল করার জন্য দিল্লি হাই কোর্টে আবেদন করে। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তবে চিকিৎসার কারণে চৌটালা জামিন পান। দিল্লি হাই কোর্ট সিবিআইয়ের আবেদন মঞ্জুর করে চৌটালার জামিন বাতিল করে। হেফাজতে ফিরতে হয় চৌটালাকে।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলির কড়া নজর ছিল কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন এবং এলডিএফ-এর অন্য নেতা-মন্ত্রীদের উপরেও।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়-সহ বিভিন্ন রাজ্যের একাধিক বিরোধী নেতা অভিযোগ এনেছেন, বিরোধীদের কন্ঠরোধ করতেই কেন্দ্র বার বার কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি দিয়ে বিভিন্ন বিরোধী রাজ্যগুলিকে চাপে রাখছে। এ নিয়ে একাধিক বিতর্কও হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি চাপ বাড়াচ্ছে কি না, তা আপেক্ষিক এবং তর্কসাপেক্ষ। তবে এ কথাও সত্যি যে, এই ক’বছরে বিজেপির শাসনাধীন রাজ্যে সিবিআই বা ইডির হানা খুব একটা দেখা যায়নি।
এই প্রসঙ্গে তেলঙ্গানার ক্ষমতায় থাকা টিআরএস দলের কার্যনির্বাহী সভাপতি কেটি রামা রাওয়ের প্রশ্ন এবং দাবি এই বিতর্ক আরও খানিকটা উস্কে দিয়েছে। একটি টুইটবার্তায় প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, গত আট বছরে কেন্দ্রের এনডিএ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের কত জন নেতা বা তাঁদের আত্মীয়দের উপর ইডি, আয়কর বা সিবিআই অভিযান চালিয়েছে? বিজেপি নেতাদের ‘হরিশ্চন্দ্রের বংশধর’ বলেও কটাক্ষ করেন তিনি।