‘ধোঁয়া, ধোঁয়া, ধোঁয়া’! অভিনেত্রী থেকে নেত্রী হয়েছেন তিনি। হুগলির তৃণমূল প্রার্থী হিসাবে প্রচারে নেমে চারদিকে নাকি ‘শুধু ধোঁয়াই ধোঁয়া’ দেখতে পেয়েছেন রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রচারে বেরিয়ে বলছেন, ‘‘মেয়েরা চাইলে সব করতে পারে। ‘দিদি নম্বর ওয়ান’ও চলবে, রাজনীতিও হবে। সব কিছু হবে।’’ অনেক কিছু ‘হওয়া’র আগে অবশ্য তিনি ভাইরাল হয়ে গেলেন!
প্রচারের চতুর্থ দিন। তার পরেই ফেসবুক থেকে শুরু করে ইনস্টাগ্রাম— চতুর্দিকে ‘শুধুই ধোঁয়া’। ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। অভিনেত্রী-নেত্রী রচনাকে হুগলির বন্ধ কারখানা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি যখন এলাম তখন তো দেখলাম অনেক কারখানা হয়েছে। চিমনি থেকে শুধু ধোঁয়াই ধোঁয়া। অন্ধকার রাস্তাঘাট। শুধু ধোঁয়াই বেরোচ্ছে। এত কারখানা হয়েছে। তা হলে কী করে বলছেন যে, কারখানা হয়নি। কারখানা তো হচ্ছে।’’ আরও কারখানা হবে এমন প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি। এই মন্তব্যের পরেই সমাজমাধ্যমে তাঁর ‘মিম’ ছড়িয়ে পড়ে। কটাক্ষ ধেয়ে আসে তাঁর ‘ধোঁয়া ধোঁয়া’ মন্তব্য ঘিরে।
আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে হুগলিতে এ বার ‘তারকা-যুদ্ধ’। এক দিকে তৃণমূলের প্রার্থী রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিজেপির প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায়— অভিনয় জগতের দুই অভিনেত্রী বর্তমানে ভোটযুদ্ধে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী।
বড় পর্দা থেকে ছোট পর্দা, বিনোদন জগতে রচনা ‘দিদি নম্বর ওয়ান’। রাজনীতির মঞ্চে নেমেছেন নিজের সতীর্থের বিরুদ্ধেই লড়াই করতে। সেই যুদ্ধেও কি ‘দিদি নম্বর ওয়ান’ হবেন রচনা?
রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে ঝুমঝুম বন্দ্যোপাধ্যায়। নব্বইয়ের দশকে তাঁর মাথায় তখন একাধিক সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার জয়ের মুকুট। ওড়িয়া, বাংলা ছবির পাশাপাশি হিন্দি, তেলুগু, তামিল এবং কন্নড় ছবিতেও অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে।
বাংলা ছবিতে অভিনয় শুরুর আগেই ওড়িয়া ফিল্মজগতে আত্মপ্রকাশ করেন রচনা। ১৯৯২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সাগর গঙ্গা’ ছবিতেই প্রথম অভিনয় তাঁর।
১৯৯৩ সালে ‘দান প্রতিদান’ ছবির মাধ্যমে বাংলার সিনেমাজগতে পা রাখেন। তখনও অবশ্য ঝুমঝুম নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। ‘দান প্রতিদান’ ছবির পরিচালক সুখেন দাস নবাগতা অভিনেত্রীর নাম পরিবর্তন করে রাখেন রচনা।
নব্বইয়ের দশকে প্রথম সারির অভিনেত্রীর তালিকায় নাম লিখিয়ে ফেলেছিলেন রচনা। ১৯৯৯ সালে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘সূর্যবংশম’। মুখ্যচরিত্রে, দ্বৈতচরিত্রে অমিতাভ বচ্চন। রচনার কেরিয়ারের প্রথম হিন্দি ছবি। তার পর আর কোনও হিন্দি ছবিতে অভিনয় করতে দেখা যায়নি তাঁকে।
টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বড় পর্দায় জুটি বেঁধে সবচেয়ে বেশি অভিনয় করেছেন রচনা। টলিপাড়া সূত্রে খবর, মোট ৩৫টি বাংলা ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করেছেন রচনা এবং প্রসেনজিৎ।
৪০টির বেশি ওড়িয়া ছবিতে সিদ্ধান্ত মহাপাত্রের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন রচনা। পরে অবশ্য সহ-অভিনেতার সঙ্গেই সাত পাকে বাঁধা পড়েন তিনি। কিন্তু সেই বিয়ে টেকেনি। ২০০৪ সালে সিদ্ধান্তের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায় রচনার।
অভিনয়ের পাশাপাশি সিদ্ধান্তের সঙ্গে যোগ রয়েছে রাজনীতিরও। ২০০৯ সালে নবীন পট্টনায়েকের বিজু জনতা দলে (বিজেডি) যোগ দিয়েছিলেন সিদ্ধান্ত। ২০০৯ এবং ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে ওড়িশার ব্রহ্মপুর থেকে জিতে সাংসদ হয়েছিলেন তিনি।
সত্তরের দশক থেকে ‘কংগ্রেসের গড়’ হিসাবে পরিচিত ব্রহ্মপুর থেকে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ভোটে জিতেছিলেন পিভি নরসিংহ রাও। সিদ্ধান্তই ছিলেন দক্ষিণ ওড়িশায় ওই লোকসভা কেন্দ্রের প্রথম বিজেডি সাংসদ। পরে অবশ্য স্বেচ্ছায় রাজনীতি ছেড়ে দেন তিনি।
সিদ্ধান্তের সঙ্গে বিচ্ছেদের তিন বছর পর ২০০৭ সালে প্রবাল বসুর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন রচনা। পুত্রসন্তানের জন্ম দেন অভিনেত্রী। টলিপাড়া সূত্রে খবর, দু’জনের সম্পর্কের বনিবনা হয়নি। আলাদা থাকলেও এখনও বিবাহবিচ্ছিন্না নন অভিনেত্রী।
বড় পর্দার অভিনেত্রী জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ছোট পর্দাতেও। ‘দিদি নম্বর ওয়ান’ রিয়্যালিটি শোয়ের সঞ্চালনা শুরু করেন রচনা। বাঙালির ঘরে ঘরে ‘দিদি নম্বর ওয়ান’ খুঁজতে গিয়ে তিনি নিজেও হয়ে ওঠেন ‘দিদি নম্বর ওয়ান’।
‘দিদি নম্বর ওয়ান’ শোয়ের হাতেখড়ি হয়েছিল টলি অভিনেত্রী পুষ্পিতা মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে। শোয়ের দ্বিতীয় পর্বে সঞ্চালিকার আসনে হয় মুখবদল। পুষ্পিতার পরিবর্তে সঞ্চালনা শুরু করেন রচনা।
‘দিদি নম্বর ওয়ান’-এর তৃতীয় পর্বে আবার পরিবর্তন দেখা যায় সঞ্চালিকার আসনে। রচনার বদলে তখন সঞ্চালনার দায়িত্ব পান টলি অভিনেত্রী জুন মালিয়া। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে মেদিনীপুরের তৃণমূল প্রার্থী জুন।
‘দিদি নম্বর ওয়ান’-এর চতুর্থ পর্বে সঞ্চালনার দায়িত্বে আবার ফিরে এলেন রচনা। কিন্তু পরের পর্বে আবার সঞ্চালিকার বদল। ‘দিদি নম্বর ওয়ান’-এর পঞ্চম পর্বে শোয়ের সঞ্চালিকা ছিলেন টলি অভিনেত্রী দেবশ্রী রায়। ২০১১ সালে অভিনেত্রীকে রাজনীতিক পরিচয় দিয়েছিল তৃণমূল। দু’বার রায়দিঘির বিধায়ক ছিলেন তিনি। ১০ বছর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার পর ২০২১ সালে ‘রাজনৈতিক সন্ন্যাস’ নেন তিনি। রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়ে আবার অভিনয় জগতে ফিরে আসেন দেবশ্রী। সম্প্রতি হইচই ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কেমিস্ট্রি মাসি’ নামের ওয়েব সিরিজ়ে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে।
ষষ্ঠ পর্ব থেকে আবার ‘দিদি নম্বর ওয়ান’-এর সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করছেন রচনা। বাঙালির প্রিয় রিয়্যালিটি শো রচনার হাত ধরেই নবম পর্বে পা দিয়েছে। কয়েক মাস আগে রচনা নবান্নে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে। তার পরে জানা যায়, তাঁর রিয়্যালিটি শোয়ে অতিথি হয়ে উপস্থিত হবেন মমতা। সেই আমন্ত্রণ জানাতেই রচনা রাজ্য সরকারের সচিবালয়ে গিয়েছিলেন। মার্চ মাসের গোড়ায় শোয়ের বিশেষ পর্বের অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে ‘দিদি নম্বর ওয়ান’ অনুষ্ঠানে মমতার উপস্থিতির ফলে অনেকেই অনুমান করছিলেন, রচনাকে বাংলার কোনও না কোনও আসনে প্রার্থী করতে পারেন দিদি। সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে রচনাও জল্পনা জিইয়ে রেখে জানিয়েছিলেন— ‘‘যা বলার দিদি বলবেন।’’
১০ মার্চ ব্রিগেডের ‘জনগর্জন সভা’ থেকে ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের রাজ্যের ৪২টি আসনের প্রার্থী ঘোষণা করেছিলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলের ‘সেনাপতি’ জানান, এ বছর লোকসভা নির্বাচনে হুগলি আসনে তৃণমূলের হয়ে লড়বেন রচনা।
জমি আন্দোলনের ধাত্রীভূমি সিঙ্গুর থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে নিজের রাজনৈতিক জীবনের সফর শুরু করেছেন বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়। তৃণমূলের দাবি, বিগত পাঁচ বছরে এই কেন্দ্রে লকেটের সে ভাবে দেখা মেলেনি। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে সাধারণ মানুষের।
তবে বিজেপি প্রার্থী লকেটের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর বলে দাবি করেন রচনা। দু’জনের সুসম্পর্কের কথা মানছেন লকেটও। প্রায় দীর্ঘ ১৭ বছরের বন্ধুত্ব দুই অভিনেত্রীর। ভাগ্যের ফেরে এখন তাঁরা প্রতিপক্ষ। তবে অভিনয় জীবনে রচনা অনেকটা প্রবীণ হলেও রাজনীতিতে এগিয়ে রয়েছেন লকেট। এখন ভোটযুদ্ধে মুখোমুখি তাঁরা।
লকেটের প্রায় বছর নয়েক আগে ছবির জগতে পা দেন রচনা। ‘কর্তব্য’ ছবিতে প্রথম বার একসঙ্গে কাজ করেছিলেন দুই অভিনেত্রী। তার পরে একের পর এক সিনেমায় একসঙ্গে কাজ করেছেন রচনা এবং লকেট। ‘মায়ের আঁচল’, ‘পরিবার’, ‘অগ্নি’, ‘ত্যাগ’— দু’বছরের মধ্যে পাঁচটি সিনেমায় একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন দু’জনে।
‘জন্মদাতা’, ‘চাওয়া পাওয়া’র মতো ছবিতেও কাজ করেছেন রচনা এবং লকেট। কখনও তাঁরা জায়ের চরিত্রে, কখনও বান্ধবীর চরিত্রে। তবে মিলের থেকে দুই চরিত্রের মধ্যে অমিলই যেন বেশি দেখা গিয়েছিল পর্দায়। বরাবরই ছবির নায়িকা রচনা এবং খানিকটা হলেও ‘দুষ্টু’ চরিত্রে লকেট। ২০১৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হঠাৎ একদিন’ ছবিতে একসঙ্গে শেষ কাজ করতে দেখা যায় দু’জনকে।
সঞ্চালনার দৌলতে যথেষ্ট পরিচিত মুখ হয়ে গিয়েছেন রচনা। প্রচারের সময় তিনি জানিয়েছিলেন, কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকার বন্দোবস্তও করছেন তিনি। অভিনেত্রীর কথায়, ‘‘চুঁচুড়ায় আমার থাকার জন্য ভাড়াঘর খোঁজা চলছে। যাতায়াত থাকবে, জিতলে কেন্দ্রে আসবই। ভোটারদের সঙ্গে সংযোগ রেখে চলব। আমাকে নিয়ে কারও কোনও ক্ষোভ থাকবে না।’’
বিনোদন জগতের ‘জুনিয়র’ এবং রাজনীতিতে ‘সিনিয়র’ লকেট। গত বছরের জয়ী সাংসদ লকেটকেই এ বারে হুগলির প্রার্থী হিসাবে মনোনীত করেছে বিজেপি। অভিনেত্রীর খোলস ছেড়ে মাঠঘাটের সক্রিয় রাজনীতিতে ২০১৭-১৮ সাল থেকেই ঢুকে পড়েছেন লকেট। তার আগে ২০১১ সালে তৃণমূলে এবং ২০১৪ সালে বিজেপিতে যোগ দিলেও অভিনয় চালিয়ে গিয়েছেন লকেট। ২০১৪ সালে ‘গোগোলের কীর্তি’ ছবিতে গোগোলের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন লকেট। এক বছর আগে মুক্তি পাওয়া ‘গোয়েন্দা গোগোল’ ছবিতে একই চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল রচনাকে।
২০১৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গোয়েন্দা গোগোল’ ছবিতে গোগোলের মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রচনা। ২০১৪ সালে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং নন্দিতা রায় পরিচালিত ‘রামধনু’ ছবিতেও অভিনয় করেন রচনা। ২০১৭ সালে শেষ বার বড় পর্দায় দেখা যায় রচনাকে। ‘হঠাৎ একদিন’ ছবিতে অভিনয়ের পর সাত বছর আর বড় পর্দায় দেখা যায়নি রচনাকে। রাজনীতি এবং সিনেমা দু’টি আলাদা বিষয়। বড় পর্দার সতীর্থের সঙ্গে কি লড়াইয়ে জিততে পারবেন ‘দিদি নম্বর ওয়ান’? জবাব দেবে ভোটের ফলাফল।