সাফল্যের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে চন্দ্রযান-৩। এর আগে চাঁদে চন্দ্রযান-২ পাঠিয়েছিল ভারত। কিন্তু সেই অভিযান সফল হয়নি। অবতরণের সময় চাঁদে আছড়ে নষ্ট হয়ে যায় যানের ল্যান্ডার। তারও আগে ২০০৮ সালে চাঁদে চন্দ্রযান বা চন্দ্রযান-১ পাঠিয়েছিল ভারত। এই অভিযান সংক্রান্ত অনেক তথ্য এখনও অনেকের অজানা।
২০০৮ সালের ১৪ নভেম্বর। রাজকোটে ইংল্যান্ডদের বোলারদের দুরমুশ করছিলেন ভারতীয় ব্যাটার যুবরাজ সিংহ। মাত্র ৭৮ বলে ১৩৮ রান করেছিলেন তিনি। ইংল্যান্ডকে ১৫৮ রানে পরাজিত করেছিল ভারত। উৎসবের মেজাজ দেখা গিয়েছিল দেশ জুড়ে।
কিন্তু সেই সময় রাজকোট থেকে ১৬০০ কিলোমিটার দূরে উৎকণ্ঠায় সময় কাটাচ্ছিলেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। অধীর আগ্রহে ইতিহাস তৈরির প্রহর গুনছিলেন তাঁরা।
১৪ নভেম্বরই চাঁদের বুকে আছড়ে পড়ে ভারতীয় একটি মহাকাশযান। ইসরোর তরফে ইচ্ছাকৃত ভাবেই চাঁদের বুকে সেই যানটিকে আছড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
২০০৮ সালের ২২ অক্টোবর যাত্রা শুরু করেছিল চন্দ্রযান। ভারত যে পৃথিবীর কক্ষপথের বাইরে মহাকাশযান পাঠাতে প্রস্তুত, এই অভিযানের মাধ্যমে বিশ্বকে সেই বার্তাই দিয়েছিল ইসরো। ভারতের সেই অভিযান ছিল বিশ্বের কাছে ক্ষমতা প্রদর্শন। তখনও পর্যন্ত, আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান এবং ইউরোপ চন্দ্রালোকে অভিযান করতে সক্ষম হয়েছিল। পঞ্চম স্থানে জায়গা করে নেয় ভারত।
চাঁদ সংক্রান্ত বহু তথ্য পৃথিবীর বুকে পাঠিয়েছিল চন্দ্রযান-১। ভারতের এই মহাকাশযানই চাঁদে জলের অস্তিত্ব প্রথম খুঁজে পেয়ে ইতিহাস তৈরি করেছিল।
চন্দ্রযান বা চন্দ্রযান-১ অভিযান ছিল একটি প্রযুক্তিগত অভিযান। চন্দ্রপৃষ্ঠের ১০০ কিলোমিটার উচ্চতায় ঘুরে ঘুরে ছবি তুলে পৃথিবীতে পাঠানোর কথা ছিল এই মহাকাশযানের।
ভারতের তরফে চন্দ্রযানের ভিতরে একটি ৩২ কিলোগ্রামের তদন্তযান পাঠানো হয়েছিল। জুতোর বাক্সের আকারের অত্যাধুনিক ওই তদন্তযানের লক্ষ্যই ছিল চাঁদের বুকে আছড়ে পড়া। চাঁদে আছড়ে পড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত চাঁদের ছবি তুলে পৃথিবীতে পাঠানো ছিল এই যানের লক্ষ্য।
অত্যাধুনিক এই তদন্তযানের ভিতরে ছিল একটি ‘ভিডিয়ো ইমেজিং সিস্টেম’, একটি ‘রাডার অল্টিমিটার’ এবং একটি ‘স্পেকট্রোমিটার’। এই ‘ভিডিয়ো ইমেজিং সিস্টেম’-এর সাহায্যেই ছবি তুলে পৃথিবীতে পাঠাচ্ছিল যানটি।
‘রাডার অল্টিমিটার’টি চন্দ্রপৃষ্ঠের সঙ্গে দূরত্ব মাপার কাজ করছিল। চাঁদের বায়ুমণ্ডল সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছিল ‘স্পেকট্রোমিটার’।
২০০৮ সালের ১৪ নভেম্বর। রাত ৮টার একটু পরে। ইসরোর কন্ট্রোলরুমে বসে থাকা বিজ্ঞানীরা চাঁদে ওই তদন্তযানটি আছড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও চাঁদে আছড়ে পড়া প্রথম থেকেই লেখা ছিল ৩২ কিলোর যানটির ভাগ্যে।
১০০ কিলোমিটার উঁচু থেকে চন্দ্রযান ছেড়ে চাঁদের দিকে নামতে শুরু করে মহাকাশযানটি। কোনও রকম বাধা ছাড়া মহাকাশ থেকে চাঁদের বুকে আছড়ে পড়তে যানটির সময় লেগেছিল ২৫ মিনিট। আর এই ২৫ মিনিটেই বাজিমাত করে অত্যাধুনিক যানটি।
উপর থেকে নীচে নামার সময় বিভিন্ন উচ্চতা থেকে চাঁদের দক্ষিণ মেরুর একের পর এক ছবি নিয়ে পাঠাতে থাকে যানটি। এর পর চাঁদের মাটিতে আছড়ে পড়ে সেটি। ইসরোই চাঁদের মাটিতে প্রথম একটি মহাকাশযান ইচ্ছাকৃত ভাবে আছড়ে ফেলেছিল।
মহাশূন্য থেকে চাঁদের মাটিতে আছড়ে পড়ার সময়ের ২৫ মিনিটেই ইতিহাস তৈরি করেছিল সেই যানটি। সেই যানের পাঠানো ছবিতেই চাঁদে জল থাকার প্রমাণ পেয়েছিলেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। ইসরোর অনুসন্ধানে পরবর্তী কালে সিলমোহর দিয়েছিল নাসা।
পাশাপাশি ছবিগুলি খুঁটিয়ে দেখে চাঁদে ‘হিমাটাইট’ নামে লোহার যৌগের খোঁজ পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা।
সব থেকে উল্লেখযোগ্য যে, চাঁদে আছড়ে পড়া যানের ভিতরে থাকা তিন যন্ত্র যে তথ্য পৃথিবীতে পাঠিয়েছিল, তাকে ভিত্তিপ্রস্তর বানিয়েই চন্দ্রযান-২ এবং চন্দ্রযান-৩ অভিযানের পরিকল্পনা করে ইসরো।
চাঁদের বাড়ির একদম কাছে পৌঁছে গিয়েছে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর তৈরি চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার বিক্রম। আর কয়েক ঘণ্টাতেই ইতিহাস তৈরি করতে পারে ভারত। চাঁদের মাটি ছোঁবে ল্যান্ডার বিক্রম।
এর আগে ২০১৯ সালেও চন্দ্রালোকে অভিযানের আয়োজন করেছিল ভারত। চাঁদে পাড়ি দিতে পাঠানো হয়েছিল চন্দ্রযান-২। কিন্তু সে বার ‘চাঁদ হাতে পাওয়া’র স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। চাঁদের মাটিতে সফল অবতরণ করতে পারেনি ভারতের চন্দ্রযান।
কিন্তু এই বার চাঁদের একদম কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার। আর তাই আশায় বুক বাঁধছেন ভারতের কোটি কোটি মানুষ। চন্দ্রযান-৩ অভিযান নিয়ে দেশবাসীর মধ্যে উত্তেজনার অন্ত নেই।
ল্যান্ডার বিক্রমের চাঁদে অবতরণের কথা বুধবার সন্ধ্যায়। মুহুর্মুহু চন্দ্রপৃষ্ঠের ছবিও পাঠাতে শুরু করেছে বিক্রম। খুঁজে চলেছে অবতরণের উপযুক্ত জায়গা। বুধবার সন্ধ্যায় রোভার প্রজ্ঞানকে নিয়ে চাঁদের মাটিতে নামবে ল্যান্ডার বিক্রম। পুরো অভিযানে এই পর্যায়টিই সবচেয়ে কঠিন বলে মনে করা হচ্ছে। চার বছর আগে এই পর্যায়েই চন্দ্রযান-২ নিয়ে ভারতবাসীর আশা ভরসা চুরমার হয়ে গিয়েছিল। তবে এ বার তেমন আশঙ্কা নেই বলেই মনে করছেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা।