ইজ়রায়েল-হামাস যুদ্ধের এক বছর পার। ইতিমধ্যেই একাধিক ফ্রন্টে ছড়িয়ে পড়েছে সংঘর্ষ। উত্তরের প্রতিবেশী দেশ লেবাননে অভিযানে নেমেছে ইহুদি ফৌজ। সেখানে ইরান সমর্থিত জঙ্গি গোষ্ঠী হিজ়বুল্লার সঙ্গে লড়াই চলছে ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফের।
এক বছর ধরে চলা এই সংঘর্ষে কত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ইজ়রায়েলের? এই নিয়ে দুনিয়া জুড়ে জল্পনার মধ্যেই তার খতিয়ান প্রকাশ করেছে আইডিএফ। সেখানে ইরান সমর্থিত প্যালেস্টাইনি জঙ্গি গোষ্ঠী হামাসের প্রায় কোমর ভাঙা দশার ছবি উঠে এসেছে। অফিসার ও জওয়ান মিলিয়ে প্রাণ গিয়েছে ৭০০-র বেশি ইহুদি সৈনিকের।
ইজ়রায়েল-হামাস সংঘাতের বর্ষপূর্তির দিনে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘টাইমস অফ ইজ়রায়েল’। সেখানে আইডিএফের দেওয়া পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। ইহুদি ফৌজের দাবি, গাজ়ায় হামাসের ১৭ হাজার যোদ্ধাকে হত্যা করা গিয়েছে।
‘টাইমস অফ ইজ়রায়েল’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরান সমর্থিত এই প্যালেস্টাইনি জঙ্গি গোষ্ঠীর আট ব্রিগেড কম্যান্ডারকে গাজ়ায় উড়িয়ে দিয়েছে আইডিএফ। ইহুদি সেনার সাঁড়াশি আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে ৩০ জনের বেশি ব্যাটালিয়ান কম্যান্ডারের। হামাস বাহিনীর অধিকাংশ মাথাকে আকাশপথে হামলা চালিয়ে খতম করেছে ইজ়রায়েলি বায়ুসেনা।
আইডিএফের আরও দাবি, এক বছর ধরে চলা যুদ্ধে ১৬৫ জন কোম্পানি কম্যান্ডার পদমর্যাদার জঙ্গি নেতাকে নিকেশ করা গিয়েছে। এই পদের সমসংখ্যক যোদ্ধাকেও খতম করেছে তাঁরা। এখনও পর্যন্ত গাজ়ায় হামাসের ৪০ হাজার ৩০০টি গুপ্ত ঠিকানায় হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করেছে ইহুদি ফৌজ।
আইডিএফের হামলা থেকে বাঁচতে গাজ়ায় অসংখ্য সুড়ঙ্গ তৈরি করেছে হামাস। ইজ়রায়েলি সেনার দাবি, এখনও পর্যন্ত সেখানে ৪ হাজার ৭০০টি সুড়ঙ্গের হদিস মিলেছে। যার কয়েকটি বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে আইডিএফ। সেই ছবি সমাজমাধ্যমে পোস্টও করেছে তেল আভিভ।
চলতি বছরের ৩১ জুলাই ইরানের রাজধানী তেহরানে রহস্যজনক বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়ের। যার নেপথ্যে ইহুদি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের হাত রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে এই যুদ্ধে হানিয়ের মৃত্যুকেই ইজ়রায়েলের সবচেয়ে বড় সাফল্য বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
টাইমস অফ ইজ়রায়েলে প্রকাশিত আইডিএফের দেওয়া এই তথ্য অবশ্য মানাতে নারাজ গাজ়ার সরকার। সেখানকার স্বাস্থ্য মন্ত্রক জানিয়েছে, ইহুদি ফৌজের হামলায় মোট ৪১ হাজার নিরীহ বাসিন্দার মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতাল ও স্কুলে আইডিএফ লাগাতার বোমাবর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ তুলেছে তারা।
এই ইস্যুতে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন ইহুদি ফৌজের পদস্থ কর্তারা। তাঁদের দাবি, ইচ্ছা করে হাসপাতাল ও স্কুলকে গুপ্ত ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করছে হামাস। গাজ়ায় গ্রাউন্ড অপারেশন চলাকালীন হাসপাতাল থেকে হাতিয়ার উদ্ধারের ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আনে আইডিএফ।
এ ছাড়া গত বছরের (২০২৩) ৭ অক্টোবর, যুদ্ধ শুরু হওয়ার দিনে হাজারের বেশি হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করে ইহুদি সেনা। ইজ়রায়েলের ভিতরে ঢুকে হামলা চালিয়েছিল তারা। খুঁজে বার করে তাদের খতম করতে আইডিএফের কম্যান্ডোদের রীতিমতো কালঘাম ছুটে গিয়েছিল।
এই যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই হামাসকে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে হিজ়বুল্লা। আর তাই লেবাননের দিক থেকে মাঝেমধ্যেই রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে এই শিয়া জঙ্গি গোষ্ঠী। যাদের সমূলে ধ্বংস করতে কোমর বেঁধে যুদ্ধের ময়দানে নেমেছে ইহুদি ফৌজ।
হিজ়বুল্লাকে নিশ্চিহ্ন করতে গাজ়ার মতো লেবাননেও কার্পেট বোমাবর্ষণ করেছে ইজ়রায়েলি বায়ুসেনা। আইডিএফের দাবি, এখনও পর্যন্ত হিজ়বুল্লার ৮০০ যোদ্ধাকে নিকেশ করা গিয়েছে। যার মধ্যে ৯০ জন শীর্ষ জঙ্গিনেতার।
টাইমস অফ ইজ়রায়েলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লেবাননের হিজ়বুল্লার ১১ হাজার গোপন ডেরায় হামলা চালিয়েছে ইহুদিরা। অন্য দিকে গাজ়া ও লেবানন মিলিয়ে ২৬ হাজার রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র ও হামলাকারী ড্রোন উড়ে এসেছে ইজ়রায়েলের দিকে। গাজ়া থেকে সর্বাধিক পাঁচ হাজার ও লেবানন থেকে ১২ হাজার ৪০০টি আক্রমণ শানিয়েছে এই দুই জঙ্গি গোষ্ঠী।
হামাস-হিজ়বুল্লার ছোড়া অধিকাংশ রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন মাঝ আকাশেই ধ্বংস করেছে ইজ়রায়েলি ডিফেন্স সিস্টেম। যাতে রয়েছে আয়রন ডোম, ডেভিড’স স্লিং ও অ্যারো ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা। পাল্টা গাজ়া ও লেবাননে কত ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন দিয়ে হামলা চালানো হয়েছে, তা স্পষ্ট করেনি আইডিএফ।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর লেবাননে হঠাৎ করেই ফাটতে শুরু করে একের পর এক পেজার, ওয়াকিটকি ও সৌর প্যানেল। এতে হিজ়বুল্লার যোদ্ধাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। এই পেজার হামলার নেপথ্যে মোসাদের হাত রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ইহুদি গুপ্তচরদের নজর এড়াতেই স্মার্ট ফোনের বদলে পেজার ব্যবহার করছিল জঙ্গিরা।
ইজ়রায়েলের এই পেজার হামলার প্রশংসা করেছেন ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী। ওই ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই হিজ়বুল্লা প্রধান সৈয়দ হাসান নাসরাল্লাকে বিমান হামলা চালিয়ে হত্যা করে আইডিএফ। লেবাননের রাজধানী বেরুটে একটি আবাসনে ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে লুকিয়ে ছিলেন এই জঙ্গি নেতা।
গাজ়া ও লেবানন ছাড়াও ইজ়রায়েলের উপর হামলা চালাচ্ছে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা। এদেরও মদত দিচ্ছে ইরান। পারস্য উপসাগরের তীরের দেশটিও ইহুদি ভূমিতে প্রায় ২০০ ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালিয়েছে। আক্রমণ এসেছে সিরিয়ার দিক থেকেও।
আইডিএফ জানিয়েছে, এখনও পর্যন্ত তাদের ৭২৮ জন সেনা মারা গিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে রিজার্ভ সৈনিক ও স্থানীয় নিরাপত্তা আধিকারিকেরাও রয়েছেন। আহতের সংখ্যা ৪ হাজার ৫৭৬। গাজ়ায় গ্রাউন্ড অপারেশনের সময়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৩৪৬ জন। দু’হাজার ২৯৯ জনকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
আইডিএফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্যালেস্টাইনের অপর অংশ ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ৬৯০ জন বন্দুকধারীকে হত্যা করা হয়েছে। জঙ্গিদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখায় সেখানকার ৩০টি বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইজ়রায়েল। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে মোট ১৫০টি তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে ইহুদি ফৌজ।
গত বছরের (২০২৩) ৭ অক্টোবর তিন দিক দিয়ে ইজ়রায়েলের উপর হামলা চালায় হামাস। ওই সময়ে ইহুদি ভূমিতে উৎসব চলছিল। তার মধ্যে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১ হাজার ২০০ জনকে গুলি করে খুন করে প্যালেস্টাইনি জঙ্গিরা। ২৫১ জনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় গাজ়ায়। এর পরই হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।