ভারতের বাসিন্দাদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা নতুন নয়। প্রাচীন কাল থেকেই কখনও বাণিজ্য, কখনও রাজনৈতিক কারণে ভারত ছেড়ে অন্য দেশে গিয়েছেন মানুষ।
ভারত ছেড়ে বাইরে যাওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন সময়ে। ১৮৩৪ সাল থেকে ব্রিটিশ ভারতের বাসিন্দাদের জোর করে শ্রমিক হিসাবে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া শুরু হয়।
মরিশাস, ফিজি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বিভিন্ন ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিতে শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে যেতেন ভারতীয়েরা। যে কারণে এই দেশগুলিতে এখনও হিন্দিভাষী মানুষের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি।
এর পর ক্রমে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নানা কারণে ভারত থেকে উদ্বাস্তু হিসাবে অনেকে বাইরে চলে গিয়েছেন। তবে সে সব দেশত্যাগের ক্ষেত্রেই কোনও না কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল।
বর্তমানে পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। এখন আর বাধ্য হয়ে নয়, ইচ্ছে করেই দেশ ছাড়ছেন ভারতীয়েরা। গত কয়েক বছরে ভারত ছেড়ে অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণের পরিমাণ চোখে পড়ার মতো বৃদ্ধি পেয়েছে।
শুক্রবার সংসদে বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, চলতি বছরে জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত মোট ৮৭ হাজার মানুষ ভারতের নাগরিকত্ব পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর পরিসংখ্যান তুলে ধরে জানিয়েছেন, শুধু ২০২২ সালেই খাতায়কলমে ভারত ছেড়েছেন ২ লক্ষ ২৫ হাজার ৬২০ জন। তাঁরা স্থায়ী ভাবে ভারতের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেছেন।
কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালে সালে ভারতের নাগরিকত্ব ছেড়েছেন ১ লক্ষ ৬৩ হাজার জন এবং ২০২০ সালে ভারতের নাগরিকত্ব ছেড়েছেন ৮৫ হাজার ২৫৬ জন।
২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতের প্রায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ দেশের বাইরে থাকেন। পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন প্রবাসীরা। রাষ্ট্রপুঞ্জ এই পরিসংখ্যান দিয়েছে।
বর্তমানে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ২০০-র বেশি মানুষ বিভিন্ন দেশে নেতৃস্থানীয় পদে কর্মরত। অন্তত ১৫টি দেশের পরিসংখ্যান তা নিশ্চিত করছে। আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
এ ছাড়াও, যে ভারতীয় বংশোদ্ভূতেরা অন্য দেশের শীর্ষ পদে বহাল, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক, গায়ানার প্রেসিডেন্ট ইরফান আলি এবং বিশ্বব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা প্রমুখ।
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১ সালের পর থেকে এখনও পর্যন্ত ১৭ লক্ষের বেশি ভারতীয় তাঁদের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেছেন। গড়ে প্রতি দিন ভারতের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন ৬১৮ জন।
ভারতে দ্বৈত নাগরিকত্ব আইনসিদ্ধ নয়। সেই কারণে অন্য কোনও দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে চাইলে ইচ্ছা না থাকলেও ভারতের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতেই হয়। কেন্দ্রের দাবি, ভারতের নাগরিকত্ব ত্যাগের কারণ বেশির ভাগ মানুষই ব্যক্তিগত দেখান।
ভারত ছাড়ার কারণ হিসাবে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যকেই তুলে ধরছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তাঁদের মতে, যে ভারতীয়েরা অন্য দেশের নাগরিক হচ্ছেন, তাঁরা মনে করছেন অন্য দেশেই তাঁদের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। যাঁরা দেশ ছাড়ছেন, তাঁরা বিদেশের চাকরি, বেতন ভারতের চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে করছেন।
ভারত থেকে প্রতি বছর উচ্চ শিক্ষালাভের আশায় অনেকে বিদেশে যান। সেই ছাত্রেরা দেশে ফিরে উপযুক্ত এবং প্রত্যাশামতো চাকরি পান না। ফলে তাঁরা বেশির ভাগই পছন্দের দেশে স্থায়ী নাগরিকত্বের আবেদন জানান।
২০২২ সালে ৭ লক্ষ ৭০ হাজার ভারতীয় ছাত্র বিদেশে পড়তে গিয়েছেন। বিদেশ থেকে পড়া শেষ হলে ৯০ শতাংশ ছাত্রই দেশে ফেরার আগ্রহ হারান।
ভারতের ধনী জনগোষ্ঠীর অনেকে বিদেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করে থাকেন। আরও ভাল ব্যবসায়িক সুযোগ সুবিধা এবং জীবনযাত্রার মান আরও উন্নত করার জন্য তাঁরা দেশ ছাড়ছেন।
এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে স্থায়ী ভাবে চলে যাওয়ার কারণ হিসাবে উঠে আসে জনসংখ্যার বাহুল্য, মহিলা এবং শিশুদের সুরক্ষা, উন্নত জীবনযাপন, আবহাওয়ার দূষণ এবং অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য। ভারত ত্যাগের নেপথ্যেও এই কারণগুলিকে দায়ী করা হচ্ছে।
ভারত থেকে বর্তমানে ২১টি দেশে ভিসা ছাড়া যাওয়া যায় এবং ১২৮টি দেশে যাওয়ার জন্য ভিসা প্রয়োজন হয়। পাসপোর্ট র্যাঙ্কিং সূচক অনুযায়ী, অন্য অনেক দেশ থেকে ভিসাবিহীন বিদেশভ্রমণের সুযোগ ভারতের চেয়ে বেশি।