রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বের কথা কূটনৈতিক মহলের সকলেরই জানা। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পরেও ভ্লাদিমির পুতিন সরকারের বিরুদ্ধে সে ভাবে মুখ খুলতে দেখা যায়নি নয়াদিল্লিকে। আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়ার আপত্তি উড়িয়েই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে মস্কোর সঙ্গে গত দেড় বছর ধরে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে ভারত। এ বার বন্ধু ভারতের অস্ত্রভান্ডার মজবুত করতে স্বল্পপাল্লার বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা পাঠাল পুতিনের দেশ।
গত বছরের শেষের দিকে রাশিয়ার সঙ্গে নতুন অস্ত্র-চুক্তি করেছিল ভারত। সেই চুক্তি অনুযায়ী ভারত পেল নতুন অস্ত্র ইগলা-এস। প্রথম দফায় ভারতীয় সেনার কাছে পৌঁছল সেই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা। রাশিয়ায় তৈরি ২৪টি ইগলা-এস এসেছে ভারতে। সেই সঙ্গে এসেছে এর সঙ্গে ব্যবহার করার ১০০টি ক্ষেপণাস্ত্রও।
ইগলা-এস নিয়ে কৌতূহল রয়েছে অনেকের মনেই। আশির দশকে আফগানিস্তান যুদ্ধে সোভিয়েত যুদ্ধবিমান ধ্বংস করতে কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল আমেরিকার তৈরি স্ট্রিংগার ক্ষেপণাস্ত্র। তারই রুশ সংস্করণ হল এই ইগলা-এস। শুধু আমদানি নয়, নির্মাণকারী রুশ সংস্থার লাইসেন্স নিয়ে ওই স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিজেরাই বানাবে ভারত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইগলা-এসে ব্যবহৃত পাঁচ ফুট দৈর্ঘ্যের ক্ষেপণাস্ত্র নিমেষে ধ্বংস করবে শত্রুপক্ষের যুদ্ধবিমান। এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৫০০ মিটার থেকে ছ’কিলোমিটার। শত্রুপক্ষের হেলিকপ্টার বা নিচু দিয়ে ওড়া যুদ্ধবিমানকে ‘থার্মাল সেন্সর’-এর সাহায্যে খুঁজে নিয়ে ধ্বংস করতে পারে এই রুশ ক্ষেপণাস্ত্র।
সবচেয়ে বড় কথা, এই ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার রয়েছে বিশেষ সুবিধা। মাত্র এক জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনা কাঁধে নিয়ে ছুড়তে পারবেন ইগলা-এস। অর্থাৎ, এই রুশ ক্ষেপণাস্ত্র চালাতে কোনও স্থায়ী লঞ্চপ্যাড বা লঞ্চ ভেহিকলের প্রয়োজন পড়বে না।
ইগলা-এস ব্যবস্থায় রয়েছে একটিমাত্র ক্ষেপণাস্ত্র। এতে ৯এম৩৪২ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে রাশিয়া। শত্রুপক্ষকে ভয় ধরাতে একাই একশো ইগলা-এস, এমনই দাবি বিশেষজ্ঞদের।
প্রতিপক্ষের নজরদারি এবং ঘাতক ড্রোন নিশানা করতেও ইগলা-এস ব্যবহার করা যেতে পারে। জানা যাচ্ছে, সাড়ে তিন কিলোমিটার উচ্চতার মধ্যে থাকা যে কোনও লক্ষ্যবস্তুকে চোখের নিমেষে ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে এই রুশ ক্ষেপণাস্ত্র। এর গতি প্রতি সেকেন্ডে ৪০০ মিটার। খুব সহজেই এই ব্যবস্থায় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিস্থাপন করা যায়। সময় লাগে ১৩ সেকেন্ড।
এই প্রথম নয়, অতীতেও ইগলা-এস ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়া থেকে ভারতে এসেছিল। ২০২১-এর ডিসেম্বরে ভারতীয় সেনার জন্য সীমিত সংখ্যায় ইগলা-এস ক্ষেপণাস্ত্র কেনা হয়েছিল। ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর তিন শাখাতেই এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়।
চিন এবং পাকিস্তান সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকায় ইগলা-এস ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ভারতীয় সেনা। ড্রোন হানাদারি রুখতে ইতিমধ্যেই পাক সীমান্তে নতুন করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জমানার বোফর্স এল-৭০ বিমান বিধ্বংসী কামান মোতায়েন করেছে ভারতীয় সেনা। দেশে উৎপাদন শুরু হলে তার জায়গা নিতে পারে ইগলা-এস।
ইউক্রেনের উপর রাশিয়া হামলার করার পর আমেরিকা-সহ বিশ্বের অনেক দেশই মস্কোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। রাষ্ট্রপুঞ্জও রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বে চিড় ধরেনি ভারতের।
আমেরিকার মতো বন্ধু দেশগুলি নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও ভারত সে পথে হাঁটেনি। বলা চলে, গত দু’বছরে রাশিয়া থেকে ভারতের আমদানি অনেক বেড়েছে। অপরিশোধিত তেল থেকে শুরু করে অস্ত্র— বিভিন্ন কিছু আমদানি করে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভাল রেখেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার।
এক সময় ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর তিন শাখার ৮০ শতাংশেরও বেশি অস্ত্র এবং সরঞ্জাম আসত রাশিয়া থেকে। পরবর্তী সময়ে আমেরিকা থেকে ভারী সামরিক পরিবহণ বিমান সি-১৭ গ্লোবমাস্টার এবং সি-১৩০জে সুপার হারকিউলিস কেনা হয়েছে। এসেছে এম-৭৭৭ হাউইৎজ়ার কামান। কিন্ত সামগ্রিক ভাবে এখনও ভারতে অস্ত্র সরবরাহের নিরিখে ওয়াশিংটনের তুলনায় মস্কোর পাল্লা অনেকটাই ভারী।
রাশিয়া থেকে সাম্প্রতিক সময়ে যে সব ক্ষেপণাস্ত্র কেনার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে ভারত, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী ব্যবস্থা। ২০০৭ সালে রুশ বাহিনীতে এস-৪০০ অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০১৪-য় এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী ব্যবস্থা কেনার বিষয়ে মস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ করে নয়াদিল্লি।
আমেরিকার হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে রাশিয়া থেকে এস-৪০০ কেনার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত। ২০১৮ সালের অক্টোবরে পুতিনের দিল্লি সফরের সময় এ বিষয়ে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার চুক্তি সই হয়েছিল। সেই চুক্তি মোতাবেক ইতিমধ্যেই ভারতে এসেছে এস-৪০০। লাদাখ এবং অরুণাচল প্রদেশের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলএসি) চিনা ফৌজের মোকাবিলার উদ্দেশে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী ব্যবস্থা মোতায়েন করেছে ভারত। এ ছাড়া পাকিস্তান সীমান্তেও এস-৪০০ ব্যবহার করছে ভারত।
এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি এ বার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারতীয় সেনার শক্তি বৃদ্ধি করবে ইগলা-এস। ভারতে যে হেতু এই ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি হবে, তাই ভারতের অস্ত্রভান্ডারে ইগলা-এস ক্ষেপণাস্ত্রের জোগানের খামতি হবে না বলেই মনে করছেন সামরিক বিশেষজ্ঞেরা।