যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুদের নাস্তানাবুদ করতে নতুন হালকা ট্যাঙ্ক তৈরি করে ফেলেছে ভারত। গত শনিবার গুজরাতের হাজিরায় সফল ভাবে এই ট্যাঙ্কের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয়েছে।
‘ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা এবং উন্নয়ন সংস্থা’ (ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন বা ডিআরডিও) এবং নির্মাণ সংস্থা এলঅ্যান্ডটি যৌথ ভাবে এই ট্যাঙ্কটি তৈরি করেছে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘জ়োরাবর’।
ভারতের হাতে ইতিমধ্যেই একাধিক ভারী এবং মাঝারি ওজনের ট্যাঙ্ক রয়েছে। এর মধ্যে ‘অর্জুন’, রুশ টি-৯০ (ভীষ্ম), টি-৭২ (অজেয়) অন্যতম। তা হলে কেন আবার নতুন ট্যাঙ্কের প্রয়োজন পড়ল ভারতের?
ভারতের হাতে নতুন ট্যাঙ্কের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল চার বছর আগেই। ২০২০-র অগস্টে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় চিনা ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’র হামলায় ২০ জন ভারতীয় সেনার মৃত্যুর পরে। সেনা মোতায়েন করার সময় বোঝা গিয়েছিল পাহাড়ি অঞ্চলে হালকা ট্যাঙ্কের প্রয়োজনীয়তা।
এর পর আবার ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালীনও নতুন ট্যাঙ্কের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ভারত।
প্রথমে আসা যাক গালওয়ান উপত্যকায় ২০২০ সালে চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ এবং ভারতীয় সেনার সংঘাতের কথায়।
২০২০ সালে গালওয়ানে সম্ভাব্য চিনা হামলার আশঙ্কায় দ্রুত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলএসি) সেনা মোতায়েন করার সময় খামতি ধরা পড়ে হালকা ট্যাঙ্কের ক্ষেত্রে। অর্জুন, ভীষ্ম বা অজেয় ওজনে ভারী হওয়ায় লাদাখের পাহাড়ি অঞ্চলে যুদ্ধের উপযুক্ত ছিল না।
সে সময় চিনা হালকা ট্যাঙ্ক জ়েডটিকিউ-১৫-র মোকাবিলায় ভারতীয় সেনাকে ভরসা করতে হয়েছিল আশির দশকে রাশিয়া থেকে আনা বিএমপি-২ ‘ইনফ্যান্ট্রি ফাইটিং ভেহিকল্’ (সাঁজোয়া গাড়ি)-এর উপর।
সেই সংঘাতে ২০ ভারতীয় সেনার মৃত্যুর পর লাদাখে টানাপড়েনের সময়ই সেনার তরফে হালকা ট্যাঙ্কের আবেদন জানানো হয়েছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কাছে।
প্রাথমিক ভাবে চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে আমদানির কথা ভাবা হলেও শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী মোদীর ‘আত্মনির্ভর ভারত’ স্লোগান অনুসরণ করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ডিআরডিওকে হালকা ট্যাঙ্ক নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখনই জ়োরাবর তৈরির কাজে হাত লাগান বিজ্ঞানীরা।
জ়োরাবর তৈরির কাজ যখন চলছে, তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। টি-৯০ ট্যাঙ্ক নিয়ে ইউক্রেনের উপর হামলা চালায় রুশ সেনা। পাল্টা তুরস্কের থেকে পাওয়া ‘বায়রাক্তার টিবি২’ ড্রোন নিয়ে ওই ট্যাঙ্কগুলির উপর হামলা চালায় ইউক্রেন।
ড্রোন হামলা রোধ করার অক্ষমতার কারণে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় রুশ বাহিনী। একের পর এক টি-৯০ ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়ে যায়। ভারতের হাতেও এই একই ট্যাঙ্ক রয়েছে। ফলে নতুন চিন্তা ঢোকে ভারতের মাথায়।
যদি কখনও ভারত-পাক সংঘাত শুরু হয়, তা হলে তুরস্কের থেকে ওই একই ‘বায়রাক্তার টিবি২’ ড্রোন পেতে পারে পাকিস্তান। কারণ, তুরস্ক যে বকলমে পাকিস্তানকেই সমর্থন করবে, সে কথা অজানা নয়। ফলে সেই ড্রোন হামলার মুখে টি-৯০ ট্যাঙ্কগুলি তাসের ঘরের মতো ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
ভারত ঠিক করে টি-৯০ ট্যাঙ্কে যে খামতি রয়েছে, তা আর রাখা যাবে না। নতুন মোড়কে তৈরি করতে হবে রুশ ট্যাঙ্ক টি-৯০। এর পরেই রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে টি-৯০ ট্যাঙ্ককে নতুন রূপ দিয়ে টি-৯০ এমকে-৩ তৈরি করে ভারত। নতুন এই ট্যাঙ্ক যেমন ড্রোন হামলা প্রতিরোধ করতে সক্ষম, তেমন নিজেও চলতে পারে ড্রোন সঙ্গে নিয়ে। এই ট্যাঙ্ক থেকে ড্রোন হামলাও চালানো যায়।
এই বৈশিষ্ট্যগুলি জ়োরাবরে যোগ করে ডিআরডিও। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক কী কী ক্ষমতা রয়েছে জ়োরাবরের।
হালকা ওজনের জ়োরাবর স্থল এবং জল— উভয় জায়গায় চলাচলে সক্ষম। খাড়া পাহাড় যেমন তরতরিয়ে উঠে যেতে পারে, তেমনই ভাসতে পারে নদীতে। টি-৯০ বা টি-৭২ ট্যাঙ্কের তুলনায় অনেক সহজে এবং দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারে।
জ়োরাবরের ওজন মাত্র ২৫ টন (প্রায় ২৫ হাজার কেজি)। ফলে আকাশপথে এই ট্যাঙ্ক পরিবহণ করা সম্ভব। পাশাপাশি, লাদাখের মতো উঁচু, দুর্গম এবং পাহা়ড়ি অঞ্চলেও অনায়াসে চলাফেরা করতে পারে এই ট্যাঙ্ক। ফলে উপত্যকা এলাকায় চিনের হালকা ট্যাঙ্কের চোখরাঙানির জবাব অনায়াসেই দিতে পারবে ভারত।
জ়োরাবর ১০৫ মিমি বা তার থেকে বেশি ক্যালিবারের ট্যাঙ্ক বিরোধী ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে সক্ষম।
ড্রোন হামলার কথাও আগে থেকে টের পেয়ে যাবে জ়োরাবর। সেই মতো নিজের অবস্থানও বদলে ফেলতে পারবে। যদি কোনও ভাবে হামলা এড়াতে না পারে, তার জন্য ট্যাঙ্কটিতে একটি বিস্ফোরকরোধী বর্মও রয়েছে।
এই কারণেই মনে করা হচ্ছে, চিন এবং পাকিস্তানের চোখরাঙানিকে রুখে দিতে পারবে ভারতের নতুন ট্যাঙ্ক জ়োরাবর। ডিআরডিও প্রধানের মতে, ট্যাঙ্কটি ২০২৭ সালের মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
১৯ শতকের ডোগরা জেনারেল জ়োরাবর সিংহের নামে এই ট্যাঙ্কটির নামকরণ করা হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রাথমিক ভাবে ৫৯টি জ়োরাবর ট্যাঙ্ক হাতে পাবে। পরবর্তী কালে মোট ৩৫৪টি ট্যাঙ্ক তুলে দেওয়া হবে সেনার হাতে।