হাতব্যাগে নাকি পাঁচ-পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করেন। গুন্ডাদের দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, বরং মারমুখী হয়ে ওঠেন। হলিউডি পর্দায় এ হেন কড়াধাতের মুখরা বৃদ্ধার চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন টাইলার পেরি।
নিট সম্পত্তির নিরিখে আজকাল তিনি নাকি জনি ডেপ, টম ক্রুজ়, ডোয়েন জনসন, শাহরুখ খানের মতো তারকাদের ছাপিয়ে গিয়েছেন। সত্যি নাকি?
পঁয়ত্রিশের বেশি হলিউডি ছবি করলেও টাইলারকে বিশেষ বড়সড় চরিত্রে দেখা যায়নি। কেবলমাত্র মাডিয়া ‘মেবল’ সিমন্স নামের ওই বৃদ্ধাকে নিয়ে এখনও পর্যন্ত ১৩টি ছবি করে ফেলেছেন। যে চরিত্র তাঁরই সৃষ্টি। সে চরিত্রে তিনিই বার বার অভিনয় করেন। এবং তা করেই বক্স অফিসে লাভের গুড় খেয়েছেন টাইলার।
বিনোদনের দুনিয়ার অন্যতম সেরা ধনী কারা? প্রতি বারের মতো গত বছরও তার তালিকা প্রকাশ করেছিল আমেরিকার এক নামী পত্রিকা। দাবি করেছিল, জনি বা শাহরুখদের পিছনে ফেলে টাইলারই তালিকায় এক নম্বরে রয়েছেন।
তালিকার প্রথম নামটি জেনে হতবাক হতে বাধ্য হবেন অনেকেই। কারণ, জনপ্রিয়তা বা ছবির সাফল্যের নিরিখে আপাত ভাবে জনি বা শাহরুখেরা তো টাইলারের থেকে শত সহস্র যোজন এগিয়ে।
আমেরিকার পত্রিকাটির দাবি, টাইলারের কাছে ৮,২০০ কোটি টাকার নিট সম্পত্তি রয়েছে। কোথা থেকে এত আয় করেন তিনি?
সিনেমার ব্যবসায়িক পণ্ডিতদের মতে, মাডেয়ার মতো এমন সরস এক বৃদ্ধার চরিত্র গড়েই ফুলেফেঁপে উঠেছেন টাইলার। প্রথাগত ভাবে স্বল্পশিক্ষিত ওই বৃদ্ধার মাধ্যমে সামাজিক সমস্যার কথাগুলি সূক্ষ্ম ভাবে দর্শকদের বলেছেন। তবে তা এতটাই কমেডির মোড়কে যে গোড়ায় ঠাহর করতে পারবেন না।
২০২২ সালে ওপরা উইনফ্রে, জর্জ লুকাস, জন দে মোল এবং স্টিভেন স্পিলবার্গের মতো হলিউডের খ্যাতনামীদের সঙ্গে একসারিতে বসেছিলেন টাইলার। হলিউডের কোটিপতিদের তালিকায় তিনি তখন নয়া সংযোজন। হাতেগোনা সিনেমায় মুখ দেখানো টাইলার কী করে এত সম্পত্তির মালিক হলেন?
টাইলারের সম্পত্তি খতিয়ান দেওয়ার পাশাপাশি তার উৎস খোঁজার চেষ্টা করেছে আমেরিকা পত্রিকাটি। জানিয়েছে, অভিনয় ছাড়াও আটলান্টায় নিজের বিশাল স্টুডিয়ো, ভিডিয়ো অন-ডিমান্ড প্ল্যাটফর্ম ‘বিইটি প্লাস’ এবং নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জেরেই সম্পত্তি বেড়েছে টাইলারের।
৫৩ বছরের টাইলারের ছোটবেলা অবশ্য এতটা মসৃণ কাটেনি। লুইজিয়ানায় নিউ অর্লিয়েন্সে এক কাঠের মিস্ত্রির ঘরে জন্ম তাঁর। তিন ভাইবোনের মধ্যে বড় হওয়া এমিট পেরি জুনিয়রের ছোটবেলাটা নাকি নরকে কেটেছে। টাইলার নন, তখন তাঁকে বাবার নামের সঙ্গে মিল রেখে ওই নামেই ডাকা হত।
১৬ বছর বয়সে তাঁর বাবার নাম সরিয়ে টাইলার করা হয়েছিল। তত দিনে বাবার সঙ্গে দূরত্বও গড়ে উঠেছে। বহু বছর পর ‘প্রেসাস’ নামে এক সিনেমা দেখার পর টাইলার নিজের বহু গোপন কথা প্রকাশ করেন।
মোনিকের ওই সিনেমাটি তাঁকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে টাইলার জানান, ১০ বছর বয়সে এক বন্ধুর মায়ের কাছে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।
এর পর আরও তিন জন পুরুষের হাতে একই পরিণতি হয় টাইলারের। পরে জানতে পারেন, তাঁর বন্ধুকে যৌন হেনস্থা করেছেন বাবা। এমনকি, ডিএনএ পরীক্ষায় জানা যায়, এমিট পেরি সিনিয়র আসলে তাঁর বাবা নন।
স্কুলের পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি টাইলার। তবে জেনারেল এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট (জিইডি) কোর্সের পরীক্ষা দিয়ে হাই স্কুল স্তরের ডিগ্রি হাসিল করেছিলেন। কুড়ির কোঠায় ‘ওপরা উইনফ্রে শো’ দেখার পর মনে হয়েছিল, লেখালিখি করলে হয়তো মানসিক যন্ত্রণার উপশম হতে পারে।
সেই শুরু। গোড়ায় নিজেকেই একগুচ্ছ চিঠি লিখেছিলেন টাইলার। পরে সেগুলির ভিত্তিতে মঞ্চের জন্য তৈরি হয়েছিল ‘আই নো আই হ্যাভ বিন চেঞ্জড’। পাড়ার মঞ্চে ওই মিউজ়িক্যালটি দেখানো হয়েছিল। এর পর শহর ছাড়েন টাইলার।
১৯৯০ সালে লুইজিয়ানা ছেড়ে আটলান্টায় পাড়ি দেন তিনি। পুঁজি ছিল ওই বয়সের সঞ্চয়ের ১২ হাজার ডলার। বছর দুয়েক পর আটলান্টায় মঞ্চস্থ হয় ওই মিউজ়িক্যালটি। তবে তা বিশেষ সাফল্য পায়নি। পরের ছ’বছর ওই মিউজ়িক্যালটি নিয়ে পড়েছিলেন টাইলার। তাতে ঘষামাজা করতে থাকেন।
১৯৯৮ সালে আটলান্টার দু’টি প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হয়েছিল ‘আই নো... ’। তার পর থেকে বহু নাটক লিখেছেন টাইলার। বেশির ভাগই দর্শক টানেনি। প্রথম নাটক লেখার প্রায় ১৩ বছর পর সিনেমায় অভিষেক। নিজের লেখা গল্প, চিত্রনাট্যের পর্দায় এসেছিলেন টাইলার। ছবির নাম ‘ডায়েরি অফ আ ম্যাড ব্ল্যাক উওম্যান’। সেটি ছিল ২০০৫ সাল।
বড় পর্দায় অভিষেকেই সাফল্য পেয়েছিলেন তিনি। শুরুর সপ্তাহান্তে বক্স অফিসে ২.২৭ কোটি ডলার তুলে নেয় ‘ডায়েরি অফ আ ম্যাড ব্ল্যাক উওম্যান’। এর পর একে একে বহু ছবি করেছেন। ‘গন গার্ল’, ‘ব্যাক্সটার স্টকম্যান’, ‘স্টার ট্রেক’, ‘টিনএজ় মিউট্যান্ট নিনজ়া টার্টলস: আউট অফ দ্য শ্যাডো’, ‘ভাইস’-সহ বহু ছবিতে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য দেখা গিয়েছে তাঁকে।
তবে অভিনেতা টাইলারের জীবন বদলে দিয়েছে মাডিয়া সিরিজ়ের সিনেমাগুলি। যে চরিত্রে নিজেকে বয়স্কার ভূমিকায় বদলে নিয়েছিলেন তিনি। ওই অ-শ্বেতাঙ্গ বৃদ্ধার নানা কাণ্ডকারখানায় হাসির তুফান উঠেছে। তবে মাডিয়ার সংলাপের মধ্যে দিয়ে অ-শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান দর্শকদের মননে নাড়া দিয়েছেন টাইলার।
২০১৫ সালে আটলান্টায় ৩০০ একর জায়গা জুড়ে নিজের স্টুডিয়ো তৈরি করেন তিনি। আমেরিকার এক পত্রিকার দাবি, সেটির জন্য ২৮ কোটি ডলার খরচ করেছেন টাইলার। হলিউডের ইতিহাসে টাইলারই নাকি প্রথম অ-শ্বেতাঙ্গ, যাঁর একক মালিকানাধীন একটি স্টুডিয়ো রয়েছে।