কুর্সিতে বসেই যুদ্ধ বন্ধ করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন ‘সুপার পাওয়ার’ দেশের ভাবী প্রেসিডেন্ট। কিন্তু সে গুড়ে বালি! উল্টে পশ্চিম এশিয়ার রণাঙ্গনে বাড়ছে আক্রমণের ঝাঁজ। যা শান্তির স্বপ্নকে চিরতরে কবরে পাঠাতে পারে বলেই মনে করছেন বিশ্বের তাবড় সমর বিশেষজ্ঞরা।
চলতি বছরের ৬ নভেম্বর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই ডোনাল্ড ট্রাম্প যে দ্বিতীয়বারের জন্য কুর্সিতে আসতে চলেছেন, তা একরকম স্পষ্ট হয়ে যায়। ইজ়রায়েলপন্থী এই রিপাবলিকান নেতার জয়ে সিঁদুরে মেঘ দেখছে ইরান ও শিয়া মুলুকটির মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলি।
আর তাই এতটুকু সময় নষ্ট না করে ইহুদি ভূমিতে নতুন করে লাগাতার রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা শুরু করেছে ‘হিজ়বুল্লা’। ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ) একাধিক ছাউনি ও বন্দরগুলিকে নিশানা করছে ইরান সমর্থিত এই জঙ্গি সংগঠন।
‘দ্য টাইমস অফ ইজ়রায়েল’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ট্রাম্পের জয় নিশ্চিত হওয়ার পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় ১৫০-র বেশি রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চলিয়েছে হিজ়বুল্লা। উত্তর গ্যালিলি, তেল আভিভ ও একরের মতো শহরে যা আছড়ে পড়েছে।
সূত্রের খবর, আইডিএফ তাঁদের হাতে থাকা চতুর্স্তরীয় বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) ব্যবহার করেও হিজ়বুল্লার সমস্ত রকেট বা ক্ষেপণাস্ত্রকে মাঝ আকাশে ধ্বংস করতে পারেনি। ফলে ইহুদিদের অন্তত ৫৩টি শহরে লম্বা সময় ধরে সাইরেনের শব্দ শোনা গিয়েছে। অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে বাঙ্কারে আশ্রয় নেন।
এ ছাড়া ইজ়রায়েলি বন্দরগুলির মধ্যে হাইফা, আশদোদ, জ়াফা, হাদেরা ও আশকেলনকে নিশানা করেছে হিজ়বুল্লা। আইডিএফের গোলা-বারুদ উড়িয়ে দিতে ড্রোন হামলা চালায় শিয়াদের এই জঙ্গি সংগঠন। তাতে অবশ্য পুরোপুরি সফল হয়নি লেবাননের সন্ত্রাসীরা।
ইহুদি ভূমির হাইফা বন্দরে বিপুল লগ্নি রয়েছে ভারতের শিল্পপতি গৌতম আদানির। ফলে সেখানে ঘন ঘন হামলা হওয়ায় উদ্বেগ বেড়েছে। গত বছরের (পড়ুন ২০২৩) জানুয়ারিতে প্রায় ৯,৯৫০ কোটি টাকার বিনিময়ে হাইফা বন্দরের পরিচালনার দায়িত্ব আদানি গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেয় ইজ়রায়েল সরকার।
এ বছরের নভেম্বরের গোড়ায় লেবাননে হিজ়বুল্লার ৯০ শতাংশ গুপ্ত ঘাঁটি উড়িয়ে দেওয়া গিয়েছে বলে দাবি করেছিল আইডিএফ। ইরানের মদতপুষ্ট এই সশস্ত্র সংগঠনের কোমর ভাঙতে প্রতিবেশী দেশটির উপর মারাত্মক এয়ারস্ট্রাইক চালিয়েছে ইহুদিরা। শুধু তাই নয়, সেখানে চলা গ্রাউন্ড অপারেশনে একের পর এক শহরকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে ইজ়রায়েল।
কিন্তু তার পরও কী ভাবে ইহুদিদের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিচ্ছে হিজ়বুল্লা? গোয়েন্দাদের দাবি, এর পিছনে রয়েছে ইজ়রায়েলের আর এক প্রতিবেশী দেশ সিরিয়া ও জর্ডনের মদত। আগামী দিনে যা আইডিএফের বড় মাথাব্যথার কারণ হতে পারে বলে অনুমান প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের।
গত শতাব্দীর ছয় ও সাতের দশকে একাধিকবার ইজ়রায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে লেবানন। ওই সময়ে সেখানকার বাসিন্দাদের একাংশ পালিয়ে জর্ডন ও সিরিয়ায় আশ্রয় নেন। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, এদেরকেই প্রশিক্ষণ দিয়ে বাহিনীতে ভর্তি করেছে হিজ়বুল্লা।
ইজ়রায়েলি গুপ্তচর সংস্থা ‘মোসাদ’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, জর্ডন ও সিরিয়ায় আশ্রয়প্রাপ্তদের ইহুদিদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে ধর্মের তাস খেলছেন হিজ়বুল্লার শীর্ষনেতা শেখ নঈম কাসেম। বর্তমানে এক লাখের বেশি জঙ্গি যোদ্ধা ইহুদি ভূমিতে আক্রমণের জন্য মুখিয়ে রয়েছে।
শিয়া মুলুকের মদতপুষ্ট এই জঙ্গিদের ছক ভেস্তে দিতে অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে একাধিক বার সিরিয়ায় আক্রমণ শানিয়েছে ইজ়রায়েলি বায়ুসেনা। পাশাপাশি জর্ডনের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক মধুর হওয়ায় ওয়াশিংটনকে দিয়ে কূটনৈতিক চাপ তৈরির কৌশল নিয়েছে তেল আভিভ।
এ বছরের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই দক্ষিণ লেবাননে হিজ়বুল্লার একাধিক সুড়ঙ্গ উড়িয়ে দেয় আইডিএফ। সম্প্রতি সেই ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এনেছে ইহুদি ফৌজ। ইজ়রায়েলি হামলায় এখনও পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার বাসিন্দার মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন লেবাননের স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
এই পরিস্থিতিতে হিজ়বুল্লার শীর্ষনেতা কাসেম বলেছেন, ‘‘কোনও অবস্থাতেই আমরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ করব না। ইজ়রায়েলকে যাবতীয় পাপের ফল ভোগ করতে হবে। আমাদের কাছে যোদ্ধা বা গোলা-বারুদের কোনও অভাব নেই।’’
অন্য দিকে, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতেই শিয়া ফৌজ ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসির জেনারেলদের সঙ্গে গুপ্ত বৈঠক করেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেই। তেহরান আমেরিকার সদ্য নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যার ছক কষতে পারে বলে গোয়েন্দা সূত্রে মিলেছে খবর।
দ্বিতীয়বারের জন্য ট্রাম্প ক্ষমতা দখল করার পর ইরানের মদতপুষ্ট ‘হুথি’ জঙ্গিদের মুখে যুদ্ধবিরতির কথা শোনা গিয়েছে। ফলে আগামীদিনে ইয়েমেন থেকে ইহুদি ভূমিতে আক্রমণের সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে পশ্চিম এশিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমেরিকার সেনা ছাউনিগুলিতে সন্ত্রাসী হামলা করতে পারে আইআরজিসি।
সেই সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকাতে শিয়া মুলুকটির বিরুদ্ধে পাল্টা ছায়াযুদ্ধের পরিকল্পনা করছে ওয়াশিংটন। আর তাই ইরানের বিক্ষুদ্ধ গোষ্ঠীগুলির হাতে হাতিয়ার তুলে দিতে মরিয়া আমেরিকা। কুর্দ বিদ্রোহীদের দিয়ে এই কাজ হাসিল করার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
তেহরানের হাতে গড়া আর এক জঙ্গি গোষ্ঠী ‘হামাস’-এর অবস্থাও তথৈবচ। গাজ়ায় ঢুকে খুঁজে খুঁজে তাঁদের নিকেশ করছে আইডিএফ। ইহুদি ফৌজের করা বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়েছে হামাসের অধিকাংশ সুড়ঙ্গ। ইজ়রায়েলি বায়ুসেনার এয়ারস্ট্রাইকে রীতিমতো শ্মশানে পরিণত হয়েছে প্যালেস্টাইনের এই এলাকা।
এই আবহে সম্পূর্ণ গাজ়াকে ইহুদি ভূমিতে মিশিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে রয়েছে ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বে়ঞ্জামিন নেতানিয়াহুর। যদিও এই নিয়ে তাঁর দলের অনেকেই সহমত হন। ফলে ইচ্ছেপূরণে আমেরিকা ও আইডিএফের পদস্থ জেনারেলদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন তিনি।