দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এমন কিছু অপরাধের ঘটনা ঘটে, যার পিছনে থাকা অপরাধীদের খুঁজতে গিয়ে পুলিশও নাজেহাল হয়ে পড়ে। এ রকমই এক ঘটনা ঘটেছিল মধ্যপ্রদেশের জবলপুর এলাকায়।
জবলপুরের এক গ্রামে ছয় ভাই তাঁদের পরিবার-সহ থাকতেন। প্রায় ৪০ একর জমি ছিল তাঁদের। উত্তম এবং তাঁর পাঁচ ভাই চাষবাস করেই দিনযাপন করতেন। উত্তমের পরিবারে এক ১০ বছরের খুদে সদস্যও ছিল।
সে ছিল উত্তমের এক মাত্র ছেলে বাদল। বাড়ির সামনে অথবা বন্ধুদের বাড়িতে খেলতে যাওয়া তার নিত্য কর্ম ছিল। আবার একটি নির্দিষ্ট সময় পর নিজে থেকেই বাড়ি ফিরে আসত। বাদলের বাবা-মা তার এই অভ্যাসের সঙ্গে পরিচিত ছিল। কিন্তু বাদল হঠাৎ এক দিন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
৮ এপ্রিল, ২০১৯। সকাল থেকে বিকাল গড়িয়ে গেছে। তবুও বাদল বাড়ি ফেরে না। বন্ধুর বাড়িতেও নাকি সে খেলতে যায়নি। মুহূর্তের মধ্যে সারা গ্রামে সাড়া পড়ে যায়। বাদলের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে গ্রামবাসীরাও বাচ্চা ছেলেটিকে খুঁজতে থাকে।
কোথাও খুঁজে না পাওয়ায় বাদলের বাবা-মা চিন্তিত হয়ে পড়েন। এর আগেও গ্রামের দুই শিশুকে অপহরণ করে মেরে ফেলা হয়েছিল। পুলিশ পরে দু’জনের মৃতদেহ উদ্ধার করে। বাদল নিরুদ্দেশ হওয়ায় গ্রামবাসীরা পুলিশের উপর আরও ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে।
গ্রামের শিশুদের বলি দেওয়া হচ্ছে বলেও সন্দেহ করতে শুরু করেন গ্রামবাসীরা। বাদলের বাবা-মা স্থানীয় থানায় অপহরণের অভিযোগ দায়ের করলে পুলিশ তদন্তে নামে। রাতারাতি গ্রামে পুলিশ ক্যাম্প বসে। প্রতিটি বাড়িতে তল্লাশি চালায় পুলিশ।
তিন দিন ধরে তল্লাশি চালানোর পরেও বাদলের কোনও খোঁজ মেলেনি। অবশেষে স্থানীয় এক বাসিন্দা এসে পুলিশকে জানান, এই গ্রামের বাইরে একটি বড় বাড়ি রয়েছে। তার সামনে দিয়ে আসার সময় একটি বিশ্রী গন্ধ তাঁর নাকে এসেছে। সন্দেহ হওয়ায় পুলিশের দ্বারস্থ হন তিনি।
পুলিশ দলবল নিয়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে বাড়ির ভিতর থেকে বাদলের মৃতদেহ উদ্ধার করে। হাত-পা তার দিয়ে বাঁধা ছিল। মৃতদেহটি দেখে মনে হচ্ছিল, ৬০-৭০ ঘণ্টা আগে বাদলকে মারা হয়েছে। পর পর তিনটি খুন, তাও একই পদ্ধতিতে। এর পিছনে কোনও বড় চক্রান্ত রয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে অনুমান করেছিল পুলিশ।
পুলিশ জানতে পারে, এই বাড়িটি রামজি নামে এক ব্যক্তির। কিন্তু তিনি এই বাড়িতে থাকেন না। ভিতরে কোনও আসবাব না থাকায় বাড়ির দরজায় তালাও লাগানো থাকত না বলে জানান রামজি।
কিন্তু পুলিশ যখন রামজির বাড়িতে পৌঁছেছিল, তখন সদর দরজায় তালা ছিল। তদন্ত এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে যেন আরও জটিল হয়ে পড়ছিল। পুলিশের সন্দেহ থেকে রামজির আত্মীয়রাও ছাড় পাননি। জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালীন তদন্ত অন্য দিকে মোড় নেয়। রামজির ভাইপো মুকেশ শ্রীপাল পুলিশের কাছে স্বীকার করেন তিনি নিয়মিত তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে জুয়া খেলতেন। তাঁদের দলে এমন এক জন ছিল যাঁর নাম-পরিচয় জেনে পুলিশও চমকে ওঠে।
বাদলের বড় কাকা অনিল ছিলেন তাঁর জুয়া খেলার সঙ্গী। জুয়া খেলে অনিল সর্বস্ব হারিয়েছিলেন। ভাইদের কাছে আর্থিক সাহায্য চেয়েও কোনও লাভ হয়নি। ব্যাঙ্ক লুট করার পরিকল্পনা করলেও এই কাজে প্রচুর ঝুঁকি। ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও বেশি। তাই নিজের ভাইয়ের ছেলেকেই অপহরণ করার ছক কষেন তিনি।
পরিকল্পনামাফিক, বাদলকে অপহরণ করে নিজের পরিচয় গোপন রেখে ভাইদের কাছে ২০ থেকে ২২ লাখ টাকা দাবি করতেন অনিল। টাকা হাতে এলেই বাদলকে মুক্ত করে দেবেন বলে ভেবেছিলেন তিনি। তাই ঘটনার দিন সকালেই অনিল এবং তাঁর দুই বন্ধু বাদলের বাড়ির সামনে আসেন।
বাইকে চাপিয়ে ঘোরাতে নিয়ে যাবেন বলে ভুলিয়ে বাদলকে বাইকে তুলে নিয়ে যান রামজির বাড়িতে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নিজের মুখ ঢাকতে ভুলে যান অনিল। তাঁকে দেখেই চিৎকার করতে শুরু করে বাদল। ইতিমধ্যেই গ্রামে পুলিশ আসে। পুলিশের ভয়ে বাদলের মুখ বেঁধে বাড়ির দরজায় তালা লাগিয়ে গ্রামে ফিরে যান।
ভাইপোকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে পরিবারের সকলের সঙ্গে তিনিও বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ করছিলেন। কিন্তু তাঁর মনে ভয় ছিল। বাদলকে খুঁজে পেলে তো তিনি ধরা পড়ে যাবেন। তাই সুযোগ বুঝে রামজির বাড়ি গিয়ে বাদলকে গলা টিপে খুন করেন। মৃতদেহ লুকোনোর জন্য তার দিয়ে বেঁধে ফেলে শরীর। কিন্তু মৃতদেহ সরিয়ে ফেলার সময় ও সুযোগ কিছুই পাননি।
মৃতদেহে পচন ঘটতে শুরু করলে গন্ধ বেরোতে থাকে। ঘটনাক্রমে পুলিশ সেখানে পৌঁছয়। আসল অপরাধী ধরা পড়লেও পুলিশ আগে অনিলের বাড়িতে যান। তাঁর ছয় ভাইয়ের সামনে পুরো ঘটনাটি বলেন। নিজের পরিবারের সদস্যই এমন ঘৃণ্য কাজ করতে পারে তা কারও পক্ষে ভাবাও সম্ভব হয়নি। তিন জন অপরাধীই সাজা হয়। অবশ্য আগে দুই শিশুর খুনের সঙ্গে এর কোনও যোগসূত্র খুঁজে পাননি পুলিশ আধিকারিকরা।