বছর ঘুরে এখনও চলছে ইজ়রায়েল-হামাস যুদ্ধ। অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে পড়েছে এই সংঘর্ষের প্রভাব। যার মধ্যে অন্যতম হল সোনা ও খনিজ তেল। লড়াই শুরু হওয়ার পর থেকেই বিশ্ব জুড়ে চড়চড়িয়ে বেড়েছে ‘হলুদ ধাতু’র দর। কিন্তু উল্টো চিত্র দেখা গিয়েছে ‘তরল সোনা’র ক্ষেত্রে।
অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী, কোনও জিনিস বা সামগ্রীর চাহিদা বাড়লে চড়তে থাকে তার দাম। বিশেষজ্ঞদের দাবি, পশ্চিম এশিয়ায় অস্থিরতার জেরে অনেকেই সোনায় লগ্নি করছেন। ফলে হঠাৎ করেই বাজারে বেড়েছে হলুদ ধাতুর চাহিদা। যেটা এর মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
গত ১২ মাসে বিশ্ববাজারে সোনার দর ৪৪.৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ, আউন্স প্রতি হলুদ ধাতুর দাম বেড়েছে ৮২০ ডলার। গত বছরের (২০২৩) ৭ অক্টোবর স্পট গোল্ডের দাম ছিল প্রতি আউন্সে ১,৮১০.৫১ ডলার। ওই দিনই ইজ়রায়েলে ঢুকে হামলা চালায় ইরান সমর্থিত জঙ্গি গোষ্ঠী হামাস। তার পরই যুদ্ধ ঘোষণা করেন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
ইজ়রায়েল-হামাস সংঘর্ষের বর্ষপূর্তিতে বিশ্ববাজারে সোনার দাম দাঁড়িয়েছে আউন্স প্রতি ২ হাজার ৬৫৩ ডলার। বিশেষজ্ঞদের কথায়, সোনাকে অনেকেই নিরাপদ লগ্নি বলে মনে করেন। আর তাই যুদ্ধ বাধতেই অন্য জায়গা থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে হলুদ ধাতু কেনা শুরু করেছেন তাঁরা। যা এর দরবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
ভারতের ঘরোয়া বাজারে সোনার দাম বৃদ্ধির অন্য অনেকগুলি কারণ রয়েছে। গত এক বছরে বেশ কয়েক ধাপে হলুদ ধাতু কিনেছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই)। এ ছাড়া আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক বা ফেডারেল ব্যাঙ্কের সুদের হার কমার আশঙ্কা রয়েছে। শেষ পর্যন্ত সুদের হার আরও কমলে সোনার দর যে আরও কিছুটা বৃদ্ধি পাবে, তা বলাই বাহুল্য।
আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, এ বছরের জুলাই থেকে প্রতি মাসে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে সোনার দর। অন্য দিকে আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কে সুদের হার কমতে কমতে সেপ্টেম্বরে সর্বনিম্ন সীমায় পৌঁছেছে। যা আরও ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমার আশঙ্কা রয়েছে।
কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টো ছবি দেখা গিয়েছে খনিজ তেলের ক্ষেত্রে। হামাস যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গত এক বছরে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দর কমেছে। গ্লোবাল ক্রুড অয়েল বেঞ্চমার্ক অনুযায়ী, ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ব্যারেল প্রতি ৫.২ ডলার কমেছে। যা প্রায় ৬.১৪ শতাংশ।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ব্রেন্ট ফিউচারের মূল্য ছিল প্রতি ব্যারেল ৯০.৮৯ ডলার। ঠিক এক বছর পর যা ৭৯ ডলার প্রতি ব্যারেলে পৌঁছয়। দাম কমেছে ডব্লিউটিআই ক্রুডেরও। এক বছরে ৮.৫ শতাংশ সস্তা হয়েছে এটি। অর্থাৎ, প্রতি ব্যারেলে দাম পড়েছে ৭ ডলার।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর হামাসের সমর্থনে এগিয়ে আসে ইরান সমর্থিত ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা। লোহিত সাগরে ইজ়রায়েল ও তার মিত্র দেশগুলির জাহাজগুলিকে নিশানা করে তারা। ফলে ডব্লিউটিআই ক্রুডের দাম হু-হু করে বাড়তে শুরু করে। যা একটা সময়ে ব্যারেল প্রতি ৯৩ ডলারে চলে গিয়েছিল।
তবে বছর ঘুরতেই ডব্লিউটিআই ক্রুডের দাম ৭৫.৭৮ ডলারে নেমে আসে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, বিশ্বব্যাপী চাহিদা হ্রাসের কারণে ‘তরল সোনা’র দর অনেকটা কমে গিয়েছে।
এ বছরের সেপ্টেম্বরের একেবারে শেষে ডব্লিউটিআই ক্রুডের দাম গত ১৪ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে নেমে যেতে দেখা গিয়েছে। তখন ব্যারেল প্রতি ৬৬.৯৫ ডলারে বিক্রি হচ্ছিল এই অপরিশোধিত তেল।
খনিজ তেলের দর কমার দ্বিতীয় উল্লেখ্যযোগ্য কারণ হল, সৌদি আরব ও লিবিয়া এর উৎপাদন বৃদ্ধি করবে বলে মনে করা হচ্ছে। মাঝে এই দু’টি আরব রাষ্ট্র অপরিশোধিত তেল উত্তোলনের পরিমাণ অনেকটা কমিয়েছিল। যার প্রভাব বিশ্ববাজারে দামের উপর পড়তে দেখা গিয়েছে।
উল্লেখ্য, সেপ্টেম্বরের গোড়া থেকে নতুন করে পশ্চিম এশিয়ায় বেড়েছে যুদ্ধের তীব্রতা। ইজ়রায়েলের উপর লেবানন থেকে একের পর এক হামলা চালিয়েছে ইরান সমর্থিত জঙ্গি গোষ্ঠী হিজ়বুল্লা। পাশাপাশি, ইহুদি ভূমিতে আছড়ে পড়েছে তেহরানের ছোড়া ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও।
ওই আক্রমণের পর পাল্টা আঘাতে লেবাননের একের পর এক এলাকা রীতিমতো তছনছ করেছে ইহুদি ফৌজ। ইরানের উপরেও বদলা নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। যা তেলের দামের উপর প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছেন আর্থিক বিশেষজ্ঞেরা।
বিশ্লেষকদের কথায়, গত এক বছর ধরে তরল সোনার দরে পতন দেখা গেলেও পশ্চিম এশিয়ায় অশান্তি বাড়লে পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে যাবে। ইজ়রায়েলি সেনা ইরানের তেলের ভান্ডার উড়িয়ে দিলে বিশ্ববাজারে এর দর আকাশছোঁয়া হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তবে পশ্চিম এশিয়ার এই উত্তেজনা ভারতের ঘরোয়া বাজারে পেট্রল ও ডিজ়েলের দামে প্রভাব ফেলবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ, ২০২২ সাল থেকে সস্তা দরে রাশিয়ার খনিজ তেল আমদানি করছে নয়াদিল্লি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যা বাড়াতে পারে কেন্দ্র।