উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে গত ১৪ দিন ধরে আটকে আছেন ৪১ জন শ্রমিক। কিছুতেই তাঁদের বার করা যাচ্ছে না। বার বার ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধারকাজ। কবে তাঁরা সুড়ঙ্গ থেকে বেরোবেন, শুক্রবারের পর তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
শুক্রবার নতুন করে ব্যাহত হয়েছে উত্তরকাশীর উদ্ধারকাজ। আমেরিকায় তৈরি যে অগার যন্ত্রটি দিয়ে সুড়ঙ্গ খোঁড়া হচ্ছিল, সেটি ভেঙে গিয়েছে। আর সেই যন্ত্র মেরামত করা যাবে না। এ বার অন্য পথ খুঁজতে হবে।
উত্তরকাশীর উদ্ধারকাজের শুরু থেকে একটি নাম বার বার সংবাদমাধ্যমের সামনে এসেছে। তা হল, আর্নল্ড ডিক্স। উদ্ধারকাজ কত দূর এগোল, আর কত দিন লাগবে, সংবাদমাধ্যমের সামনে একাধিক বার সেই সংক্রান্ত খবর দিয়েছেন ডিক্স।
আন্তর্জাতিক সুড়ঙ্গ বিশেষজ্ঞদের একটি দল উত্তরকাশীর পরিস্থিতি খতিয়ে দেখছে। তার প্রেসিডেন্ট ডিক্স। তাঁদের তত্ত্বাবধানেই উদ্ধারকাজ গতি পেয়েছে উত্তরকাশীতে।
উদ্ধারকাজের দায়িত্বে রয়েছে মোট পাঁচটি সংস্থা— ওএনজিসি, এসজেভিএনএল, আরভিএনএল, এনএইচআইডসিএল এবং টিএইচডিসিএল। এই সংস্থাগুলির সঙ্গে কথা বলে তাঁদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করছেন ডিক্স।
ডিক্স অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা। সুড়ঙ্গ বিশেষজ্ঞ হিসাবে বিশ্বজোড়া খ্যাতি তাঁর। পৃথিবীর যে প্রান্তেই সুড়ঙ্গে বিপদ আসুক, ডিক্স সেখানেই হাজির হয়ে যান তাঁর দলবল নিয়ে। সাফল্য না মেলা পর্যন্ত হার মানেন না সহজে।
মাটির নীচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে যে সমস্ত নির্মাণের কাজ হয়, সে ক্ষেত্রে পরামর্শদাতা হিসাবে ডিক্সের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে তাঁর বিশেষত্ব সুড়ঙ্গে অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে।
কোনও সুড়ঙ্গে কাজ চলাকালীন আগুন লেগে গেলে কী ভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, কী কী ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে, তা কী ভাবে এড়ানো যাবে, সব ডিক্সের নখদর্পণে। এই কাজের জন্য প্রায় সবক’টি মহাদেশে ঘুরে ফেলেছেন তিনি।
উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গের কাছাকাছি পৌঁছে প্রথমেই উদ্ধারকাজের খোঁজ নেন ডিক্স। তার পর কী ভাবে কী করলে শ্রমিকদের নিরাপদে সুড়ঙ্গ থেকে বার করে আনা যাবে, সে বিষয়ে পরামর্শ দেন।
সংবাদমাধ্যমের সামনে প্রথম থেকেই ইতিবাচক কথা বলে এসেছেন ডিক্স। তিনি বার বার বলেছেন, শ্রমিকেরা সকলে নিরাপদে এবং সুরক্ষিত আছেন। শীঘ্রই তাঁদের বার করে আনা হবে। তবে এ বিষয়ে তাড়াহুড়ো করলে চলবে না বলেও সতর্ক করেছেন তিনি।
শুক্রবার খননযন্ত্র ভেঙে যাওয়ার পর সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে ডিক্স বলেন, ‘‘আমরা আশা করছিলাম, শ্রমিকদের শীঘ্রই দেখতে পাব। বৃহস্পতিবারও মনে হচ্ছিল শুক্রবার এমন সময়ে ওঁরা বেরিয়ে আসবেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, পাহাড় অন্য কিছু চাইছে।’’
উত্তরকাশীর ঘটনাকে সামনে রেখে যে কোনও সুড়ঙ্গ খোঁড়া এবং সুড়ঙ্গের মধ্যেকার কাজের বিষয়ে সতর্ক করে ডিক্স জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে শুরুতেই আরও বেশি সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। সুড়ঙ্গে নিরাপত্তা সংক্রান্ত পরিষেবা মজুত থাকা দরকার।
বিশ্বের দরবারে বার বার প্রশংসিত হয়েছে ডিক্সের কাজ। তিনি ২০১১ সালে অ্যালান নেল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ান টানেলিং সোসাইটির দ্বিবার্ষিক পুরস্কারের মঞ্চে সেরা নির্বাচিত হন।
২০২২ সালে আমেরিকা থেকে স্বীকৃতি পান ডিক্স। আমেরিকার ন্যাশনাল ফায়ার প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের কমিটি সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিনি।
ডিক্স পেশায় আইনজীবীও বটে। তিনি ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অফ ইনভেস্টিগেটর্সের অন্যতম সদস্য। এখানেই শেষ নয়, ডিক্স অধ্যাপনাও করেন। টোকিয়ো সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সুড়ঙ্গ সংক্রান্ত বিষয় পড়ানোর জন্য মাঝেমাঝে তাঁর ডাক পড়ে।
আইন, প্রযুক্তি, ভূতত্ত্ব প্রভৃতি বিভিন্ন দিকে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ডিক্স। তদন্তকারী বিশেষজ্ঞ, পরামর্শদাতা এবং মধ্যস্থতাকারী হিসাবেও কাজ করে থাকেন তিনি। বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে চলে তাঁর কাজ।
উত্তরকাশীতে ডিক্স একেবারে সামনে থেকে লড়ছেন। যেনতেনপ্রকারেণ সুড়ঙ্গ থেকে ৪১ জন শ্রমিককে বার করে আনাই তাঁর লক্ষ্য। শুক্রবারের পরেও তাঁর গলায় তাই ইতিবাচক সুর।
ডিক্স জানাচ্ছেন, দেরি হতে পারে। তবে সুড়ঙ্গে থেকে সকলকে বার করে আনা হবেই। এতে কোনও সন্দেহ নেই। একটি পথে না হলে অন্য পথ তাঁরা অবলম্বন করবেন।
উত্তরকাশীতে যাঁরা নিরন্তর কাজ করে চলেছেন, তাঁদের কুর্নিশ জানিয়েছেন ডিক্স। তিনি প্রথম থেকেই বলছেন, ‘‘এখানে সবাই খুব ভাল কাজ করছেন। আশা করছি, খুব শীঘ্র আমরা আটকে পড়া শ্রমিকদের দেখতে পাব।’’
উত্তরকাশীর ৪১ জন শ্রমিকের ভাগ্য এখন ডিক্সের হাতেই। তাঁর অভিজ্ঞতা, পরামর্শের উপর উদ্ধারকারীরা ভরসা রেখেছেন। সামনে থেকে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করছেন অস্ট্রেলিয়ান এই প্রৌঢ়।