Europe on Trump Zelenskyy Row

‘মুক্ত বিশ্বে’ ঠাঁই নেই আমেরিকার, শুরু নতুন নেতার খোঁজ, জ়েলেনস্কির ‘অপমানে’ ফুঁসছে ইউরোপ!

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির নিষ্ফলা বৈঠকের পর কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে পশ্চিম ইউরোপ। ‘মুক্ত বিশ্ব’ তৈরি করতে আমেরিকাকে বাদ দিয়ে নতুন নেতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে শোনা গিয়েছে তাদের।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০২৫ ১৪:৩৬
Share:
০১ ২১

ওয়াশিংটনের ওভাল অফিসে বসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বাদানুবাদ। ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির এ হেন আচরণে রাগে ফুঁসছে আমেরিকা। অন্য দিকে, শান্তির খোঁজে বসা নিষ্ফলা ওই বৈঠকের জেরে সম্পূর্ণ উল্টো দিকে বাঁক নিয়েছে বিশ্ব রাজনীতি। দ্রুত বদলাতে শুরু করেছে ‘অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু’ পশ্চিমি দেশগুলির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের সমীকরণ।

০২ ২১

চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প-জ়েলেনস্কি বাদানুবাদের ছবি প্রত্যক্ষ করে গোটা দুনিয়া। বচসার কিছু ক্ষণের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ঐতিহ্যশালী ‘শ্বেত প্রাসাদ’ (পড়ুন হোয়াইট হাউস) ছেড়ে বেরিয়ে যান ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। ঘটনাটি জানাজানি হতেই তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিরাপত্তা এবং বিদেশনীতির প্রধান কাজা কালাস।

Advertisement
০৩ ২১

ট্রাম্প-জ়েলেনস্কি নিষ্ফলা বৈঠকের পর সমাজমাধ্যমে কালাস লেখেন, ‘‘আজ এটা প্রমাণিত যে ‘মুক্ত বিশ্ব’ তৈরি করার জন্য নতুন নেতার প্রয়োজন। এই চ্যালেঞ্জ আমাদের অর্থাৎ ইউরোপীয়দেরই গ্রহণ করতে হবে। কারণ, ইউক্রেন হল ইউরোপ। আমরা সব সময়ে কিভকে সমর্থন করে যাব যাতে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে তারা লড়াই চালিয়ে যেতে পারে।’’

০৪ ২১

এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) করা পোস্টে কালাস অবশ্য সুনির্দিষ্ট করে ট্রাম্প বা যুক্তরাষ্ট্রের নাম করেননি। ‘মুক্ত বিশ্বের’ নেতা কী ভাবে ঠিক হবে, তা-ও স্পষ্ট নয়। তবে এ ব্যাপারে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি-সহ পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ দেশের সমর্থন পেয়েছেন তিনি।

০৫ ২১

ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ পদাধিকারীর এ-হেন মন্তব্যে অবশ্য সিঁদুরে মেঘ দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের কথায়, ট্রাম্প-জ়েলেনস্কির বৈঠকের পর জি-৭ ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন দেখা যাচ্ছে। এর পর যুক্তরাষ্ট্র নেটো ত্যাগ করলে ইউরোপের নিরাপত্তা যে প্রশ্নের মুখে পড়বে, তা বলাই বাহুল্য।

০৬ ২১

১৯৪৫ সালে জাপানের আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এর চার বছরের মধ্যেই মূলত পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিকে সঙ্গে নিয়ে ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংগঠন’ (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন বা নেটো) গড়ে তোলে আমেরিকা। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ৩২। নেটোভুক্ত দেশগুলি পারস্পরিক সামরিক সহযোগিতা প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ।

০৭ ২১

বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে আমেরিকা ও তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে চলে ‘স্নায়ু যুদ্ধ’। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙে গেলে পুরোপুরি থেমে যায় ওই ঠান্ডা লড়াই। বিশ্লেষকদের দাবি, এর পর থেকেই ইউরোপের দেশগুলি প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে প্রবল ভাবে আমেরিকার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

০৮ ২১

কিন্তু, এ বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় বারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিয়ে এই নীতিতে বদল এনেছেন ট্রাম্প। ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য ফি বছর কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার খরচ করতে নিমরাজি তিনি। এর জন্য প্রয়োজনে নেটো ত্যাগের হুমকিও দিয়েছেন এই বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা।

০৯ ২১

ট্রাম্প যে ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়ে মোটেই ভাবিত নন, জ়েলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকের পর তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। ফলে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের উপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে ব্রিটেন, ফ্রান্স বা জার্মানির মতো শক্তিশালী দেশগুলি। আর তাই এই কাজে নেতৃত্ব দিতে নতুন নেতার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।

১০ ২১

বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছেন জার্মানির পরবর্তী সম্ভাব্য চ্যান্সেলর তথা মধ্য-ডানপন্থী ‘ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ান পার্টি’র নেতা ফ্রিডরিখ মেয়ার্ৎজ়। তাঁর কথায়, ‘‘ইউরোপকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে আমাদের জোর দিতে হবে। এর মাধ্যমে আমরা ধীরে ধীরে নিরাপত্তার প্রশ্নে আমেরিকার থেকে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারব।’’

১১ ২১

এ বছরের জুনে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের সদর দফতরে শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবে নেটোভুক্ত সমস্ত দেশ। সেখানে এ ব্যাপারে বড় সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে মনে করছেন সম্ভাব্য জার্মান চ্যান্সেলর মেয়ার্ৎজ়। ‘‘জুনের সম্মেলনেই নেটোর রূপ বদলের ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে স্বাধীন ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আমাদের গড়ে তুলতে হবে।’’ সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন তিনি।

১২ ২১

কিন্তু, এত কিছুর পরেও পশ্চিম ইউরোপের সমস্ত দেশ যে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এককাট্টা, তা নয়। উদাহরণ হিসাবে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমান্যুয়েল মাকরঁ ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারের কথা বলা যেতে পারে। এখনই প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদে প্রবল আপত্তি রয়েছে তাঁদের। আর সে কথা খোলাখুলি ভাবে জানিয়েও দিয়েছেন তাঁরা।

১৩ ২১

অন্য দিকে সমস্যা সমাধানে একটি অভিনব পদক্ষেপের প্রস্তাব দিয়েছেন ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি। ইউরোপ, ইউক্রেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি জরুরি বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। একটি বিবৃতিতে মেলোনি বলেন, ‘‘চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য ইউরোপীয় দেশগুলিকে আলোচনার রাস্তা নিতে হবে। ইউক্রেনকে রক্ষা করতে হলে দেরি না করে অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘বন্ধু’দের কথা বলা উচিত।’’

১৪ ২১

ইটালির প্রধানমন্ত্রীর এই প্রস্তাব ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ট্রাম্প মেনে নেবেন কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অন্য দিকে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান আবার বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার জন্য জ়েলেনস্কিকেই দুষেছেন। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘‘ট্রাম্প সাহসের সঙ্গে শান্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। তাই আপাতত অনড় না থেকে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতেই পারত।’’

১৫ ২১

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ চালাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিন বছর পেরিয়ে যুদ্ধ থামার নামগন্ধ না নেওয়ায় সম্প্রতি এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন ট্রাম্প। জ়েলেনস্কিকে ওয়াশিংটনে ডেকে পাঠান তিনি। সেখানে শান্তি সমঝোতার বিষয়ে আলোচনার সময়েই মেজাজ হারান দুই রাষ্ট্রনেতা।

১৬ ২১

ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই কিভকে আর্থিক এবং সামরিক দিক থেকে সাহায্য করে গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জ়েলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকে সে সব পুরোপুরি ভাবে বন্ধ করার হুঁশিয়ারি দেন ট্রাম্প। কিন্তু তাতেও আগাগোড়া অনড় ছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। এমনকি বৈঠক শেষে নিজের আচরণের জন্য ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নেও সাফ ‘না’ বলে দেন তিনি।

১৭ ২১

ওভাল অফিসে প্রায় ৪০ মিনিট ধরে চলা বৈঠকের অধিকাংশ সময়েই দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে চলে বাদানুবাদ। আলোচনা চলাকালীন সংবাদমাধ্যমের সামনেই পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধের জন্য জ়েলেনস্কিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান ট্রাম্প। বলেন, ‘‘লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়ায় বসেছেন তিনি। আর তাই সমঝোতার পথে হাঁটতে চাইছেন না।’’

১৮ ২১

উল্লেখ্য, এই প্রথম কোনও রাষ্ট্রনেতার সামনে ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করলেন ট্রাম্প। তাঁর কথায়, ‘‘শান্তির জন্য রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনকে চুক্তি করতেই হবে। এর জন্য কিছু ক্ষেত্রে আপসের প্রয়োজন রয়েছে। তবে সেটা খুব বেশি নয়। কিন্তু চুক্তিবদ্ধ না হলে কিভের সঙ্গে থাকবে না আমেরিকা।’’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এ হেন হুঁশিয়ারিকে অত্যন্ত তাৎপর্য বলে মনে করা হচ্ছে।

১৯ ২১

ওভাল অফিসে বৈঠক চলাকালীন জ়েলেনস্কিকে বাস্তববাদী হতে বলেন ট্রাম্প। জবাবে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘‘আপনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মিথ্যারই পুনরাবৃত্তি করছেন। রাশিয়াকে সুযোগ করে দিচ্ছেন। মস্কো আমাদের জায়গা চুরি করছে, সাধারণ নাগরিকদের হত্যা করছে, শিশুদের অপহরণ পর্যন্ত করছে। এত সবের পরে কী ভাবে বাস্তববাদী হতে বলেছন?’’

২০ ২১

অন্য দিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে জ়েলেনস্কির বাদানুবাদ এবং বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার ঘটনায় উল্লসিত মস্কো। এর জন্য ইউক্রেন প্রেসিডেন্টের ঘাড়েই দোষ চাপিয়েছে মস্কো। সাবেক রুশ প্রেসিডেন্ট তথা নিরাপত্তা পরিষদের উপপ্রধান দিমিত্রি মেদভেদেভ একটি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘অহঙ্কারী বরাহনন্দন ওভাল অফিসে সপাটে থাপ্পড় খেয়েছেন।’’

২১ ২১

ট্রাম্প-জ়েলেনস্কি বৈঠক ভেস্তে পাওয়ার পর ইউক্রেনের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে ব্রিটেন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে কিভকে ২৮০ কোটি ডলারের ঋণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করছেন ইংরেজ প্রধানমন্ত্রী স্টারমার। ফলে আগামী দিনে লড়াই আরও ছড়িয়ে পড়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আমেরিকার বিদেশনীতি কোন খাতে বয়ে চলে, সেটাই এখন দেখার।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement