সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নতুন সংসদ ভবনের মাথায় যে জাতীয় প্রতীকটির উন্মোচন করেছেন, তা ঘিরে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন মহলের দাবি, এই অশোক স্তম্ভের সিংহগুলি চেহারায় হিংস্র। অথচ সারনাথের মন্দিরের যে অশোক স্তম্ভকে ভারতের জাতীয় প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল, তার সিংহগুলি অনেক শান্ত প্রকৃতির। সাবেক জাতীয় প্রতীকটির নকশা তৈরির নেপথ্যে অন্যতম মস্তিষ্ক ছিলেন চিত্রকর দীননাথ ভার্গব।
দীননাথ হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি উত্তর প্রদেশের সারনাথ স্তূপের প্রাচীন ভাস্কর্য ‘লায়ন ক্যাপিটাল অব অশোক’-এর উপর ভিত্তি করে অশোক স্তম্ভের নকশা তৈরি করেছিলেন। তাঁর কাজ ভারতীয় সংবিধানের মূল পাণ্ডুলিপির প্রথম পাতাতেও শোভা পেয়েছে।
দীননাথ ১৯২৭ সালের ১ নভেম্বর মধ্যপ্রদেশের বেতুল জেলার ছোট্ট শহর মুলতাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৪৭ সালে যখন ভারত স্বাধীনতা লাভ করে, তখন দীননাথের বয়স বছর ২০। তখন তিনি শান্তিনিকেতনে চারুকলা নিয়ে তিন বছরের ডিপ্লোমা করছিলেন।
শান্তিনিকেতনেই দীননাথ সান্নিধ্য লাভ করেন ভারতের চিত্রকলার ইতিহাসে কিংবদন্তিপ্রতিম শিল্পী নন্দলাল বসুর। সেই সময়ে নন্দলাল কলাভবনের অধ্যক্ষ পদে কর্মরত।
স্বাধীনতার পর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সংবিধানের মূল পাণ্ডুলিপি নকশা করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন নন্দলালকে।
দীননাথের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে নন্দলাল তাঁকে ভারতীয় সংবিধানের পাণ্ডুলিপির নকশা তৈরির দলে শামিল করেন।
অশোক স্তম্ভের নকশা তৈরির কাজের দায়িত্ব পড়েছিল দীননাথের উপর। তবে নন্দলাল চেয়েছিলেন, অশোক স্তম্ভের সিংহগুলি যেন একেবারে জীবন্ত সিংহের মতো দেখতে হয়। তাই দীননাথের কাজ মোটেও সহজ ছিল না।
দীননাথ ঠিক করলেন, জীবন্ত সিংহের মতো নকশা তৈরি করতে তিনি আসল সিংহদের পর্যবেক্ষণ করবেন। তবে শান্তিনিকেতনের সব থেকে কাছাকাছি যেখানে গেলে তিনি সত্যিকারের সিংহ দেখতে পেতেন, সেই জায়গা ছিল কলকাতার চিড়িয়াখানা।
তিন মাস ধরে প্রায় প্রতি দিন ভার্গব শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতার চিড়িয়াখানায় (প্রায় ১০০ কিমি দূরে) যাতায়াত করতেন। চিড়িয়াখানায় গিয়ে সিংহের আচরণ, চেহারা, শারীরিক ভাষা ইত্যাদি অধ্যয়ন করেন দীননাথ।
দীননাথের তৈরি প্রাথমিক পর্যায়ের নকশাগুলি দেখে নন্দলাল এতটাই সন্তুষ্ট হন যে, তিনি দীননাথকে সংবিধানের প্রথম পৃষ্ঠার জন্য এই প্রতীকের নকশা করার দায়িত্ব পাকাপাকি ভাবে দিয়ে দেন।
ভারতীয় সংবিধানের মূল পাণ্ডুলিপির প্রথম ৩০ পৃষ্ঠা সাজানোর দায়িত্ব তিনি দিয়েছিলেন দীননাথকে। বাকি পৃষ্ঠাগুলির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল অন্যান্য শিল্পীকে। তাঁরাও প্রত্যেকে নন্দলালের ছাত্র ছিলেন।
পেন্সিল এবং ব্রাশ দিয়ে ডিজাইন করা পাণ্ডুলিপির বিজোড় পৃষ্ঠাগুলির প্রতিটি সোনার ‘ক্যালিগ্রাফিক’ হরফে পূর্ণ ছিল। লেখাগুলি আরও সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পাথর থেকে তৈরি রং ব্যবহার করা ছাড়াও, শিল্পীরা খাঁটি সোনার গুঁড়া মেশানো বিশেষ রং ব্যবহার করেন। পাণ্ডুলিপির প্রত্যেকটি নকশা যাতে ভারতীয় শিল্প-ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলে, সেই দিকেও বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল।
১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ‘লায়ন ক্যাপিটাল অব অশোক’-এর আদলে দীননাথের নকশা করা জাতীয় প্রতীকের সাক্ষী হয় সারা দেশ। ভারতের জাতীয় প্রতীকের চার সিংহ— শক্তি, সাহস, আত্মমর্যাদা বোধ এবং আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।
২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট অশোক সারনাথের ‘লায়ন ক্যাপিটাল’ তৈরি করান। ‘লায়ন ক্যাপিটাল’-এর মতো জাতীয় প্রতীকেও সিংহ, হাতি, ঘোড়া এবং ষাঁড়ের ছবি রয়েছে। তবে ছবিতে প্রতিটি প্রাণী অশোক চক্রের দ্বারা পৃথক।
দীননাথের নকশা করা জাতীয় প্রতীকের তলায় দেবনাগরী ভাষায় লেখা ‘সত্যমেব জয়তে' (সত্যের জয় হোক)।
তবে নিজে নকশা করলেও দীর্ঘ দিন এই পাণ্ডুলিপির সম্পূর্ণ রূপটি দেখতে পাননি দীননাথ। প্রতি বার পাণ্ডুলিপির কোনও অংশ সম্পূর্ণ হওয়ার পর পরই নন্দলাল তা দিল্লিতে পাঠিয়ে দিতেন। অবশেষে ২০০৬ সালে তিনি পুরো পাণ্ডুলিপি দেখতে পান।
দীননাথ অনবদ্য ‘ওয়াশ পেন্টিং’-এর জন্যও বিখ্যাত। কাপড়ের উপর মধুবনী শৈলী ফুটিয়ে তোলার জন্য বিশেষ খ্যাতি পেয়েছিলেন দীননাথ। দীর্ঘ দিন অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডলুম বোর্ড-এর ডিরেক্টর ছিলেন তিনি। অবসর নেন ১৯৮৬ সালে।
‘ডাবল ডেকার’ তাঁত প্রবর্তন এবং নতুন ধরনের চান্দেরি শাড়ির নকশা করার ক্ষেত্রেও দীননাথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। দীননাথের তৈরি শিল্পকলা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর স্বীকৃতি কুড়িয়েছে। একাধিক পদক এবং সম্মানে ভূষিতও হয়েছেন তিনি।
দীননাথ ২০১৬ সালে ইনদওরে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর পরিবারের সদস্যেরা জানিয়েছেন, পুরনো অশোক স্তম্ভের মূল শিল্পকর্মের একটি প্রতিরূপ এখনও তাঁদের কাছে রয়েছে।