পৃথিবীতে তিন ধরনের শাসনব্যবস্থা রয়েছে। গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র এবং একনায়কতন্ত্র। জনতার দ্বারা নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করলে তাকে গণতন্ত্র বলে। ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র।
সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, ওমান, ব্রুনেই প্রভৃতি দেশে রাজতন্ত্র প্রচলিত। রাজাই সেখানকার শাসক। এ ছাড়া, উত্তর কোরিয়ায় প্রচলিত একনায়কতন্ত্র। সেখানকার একমাত্র প্রশাসক কিম জং উন।
২০০৮ সাল পর্যন্ত ভারতের উত্তরের পড়শি দেশ নেপালেও প্রচলিত ছিল রাজতন্ত্র। ওই বছরের ২৮ মে ২৪০ বছরের পুরনো রাজতন্ত্র ভেঙে নেপালে প্রতিষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা।
সম্প্রতি নেপালে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবি উঠেছে। সেই সঙ্গে নেপালিরা তাঁদের দেশকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ হিসাবে গড়ে তোলার দাবিও জানিয়েছেন। খাস কাঠমান্ডুতে এই দাবি নিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছে জনতা।
নেপালের শেষ রাজা ছিলেন জ্ঞানেন্দ্র। ২০০৬ সালে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। তার দু’বছরের মধ্যেই গণতন্ত্রে পথ চলা শুরু হয় নেপালের। নেপালে বর্তমানে আবার সেই পুরনো রাজাকে ফেরানোর দাবি উঠেছে।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জ্ঞানেন্দ্র নেপালের সাধারণ নাগরিক হিসাবে বাস করেন। তাঁর কোনও রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ক্ষমতা নেই। এমনকি, সরকারি কোনও সুবিধাও তিনি পান না।
শুক্রবার গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে কাঠমান্ডুর পথে নামেন হাজার হাজার নেপালি। দেশের জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে পুরনো রাজা, পুরনো শাসনব্যyস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি জানান তাঁরা।
এই বিক্ষোভের নেতৃত্বে ছিল নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা বর্তমান বিরোধী দলনেতা কেপি ওলির দল। ওই দলের নেতা দুর্গা প্রসাই বিক্ষুব্ধ জনতাকে সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেছেন।
রাজধানীর পথে নেপালিদের এই বিক্ষোভ প্রদর্শনের ঠিক আগে কাঠমান্ডুতে বিক্ষোভ আন্দোলনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল সরকার। ফলে বিক্ষুব্ধ জনতাকে ঠেকাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এ ছাড়া, জলকামান, টিয়ার গ্যাসও মিছিলের উপর প্রয়োগ করা হয়।
বিক্ষুব্ধদের অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দহাল ওরফে প্রচণ্ড দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁর আমলে দুর্নীতি ডালপালা মেলেছে নেপালে। ধর্মেরও কোনও নিরাপত্তা অবশিষ্ট নেই তাঁর শাসনকালে।
দুর্নীতিই নেপালের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীদের প্রধান হাতিয়ার। চলতি বছরের শুরুর দিকে একটি বড়সড় দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ্যে আসে। যা প্রচণ্ড সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে বলে দাবি করেন কেউ কেউ।
অভিযোগ, নেপাল সরকারের শীর্ষনেতারা নেপালের নাগরিকদের ভুয়ো সংশাপত্র বানিয়ে ভুটানি উদ্বাস্তু হিসাবে দেখাচ্ছেন এবং তাদের আমেরিকায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এই অভিযোগ সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলেছে।
গণতান্ত্রিক নেপালে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষিত কোনও ধর্ম না থাকলেও সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠই হিন্দু। দেশের একাংশের দাবি, নেপালকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা হোক।
নেপালে যখন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল, সেই সময়ে দেশটি হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবেই পরিচিত ছিল। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে নেপালকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে ঘোষণা করা হয়। পরে দেশের সংবিধানেও সেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
নেপালিদের একাংশের দাবি, রাজতন্ত্র ফিরে এলে, হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবে নেপাল আবার স্বীকৃতি পেলে দেশের পরিস্থিতির উন্নতি হবে। ওলির দল প্রচণ্ড সরকারের বিরুদ্ধে এই জনমতকে হাতিয়ার করে রাস্তায় নেমেছে।
নেপালের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে হলে ফিরে দেখতে হবে দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাস। ১৭৬৮ সালে সেখানে রাজতন্ত্র চালু হয়েছিল।
২০০১ সালে নেপালি রাজতন্ত্রের উপর সবচেয়ে বড় আঘাত আসে। রাজা বীরেন্দ্র-সহ রাজপরিবারের ন’জন সদস্যকে গুলি করে খুন করা হয়। এর পরে সিংহাসনে বসেন জ্ঞানেন্দ্র।
তাঁর বিরুদ্ধেও প্রজাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। দিনের পর দিন বিক্ষোভের মুখে ২০০৬ সালে অবশেষে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন রাজা জ্ঞানেন্দ্র। দু’বছরের মধ্যে রাজতন্ত্র উঠে যায় নেপাল থেকে।
২০১৫ সালে নেপালের সংবিধান তৈরি হয়। সংবিধান স্বীকৃত প্রধানমন্ত্রী হন কেপি ওলি। তিনি তিন বার প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেছেন। নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত তিনি।
নেপালের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ডের সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় এসেছিলেন ওলি। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রতিশ্রুতি মতো সময় পেরিয়ে গেলেও প্রচণ্ডকে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাননি।
সেই সময়ে ওলির বিরুদ্ধে নেপালে ব্যাপক গণবিক্ষোভ হয়েছিল। পরে তাঁর সংসর্গ ত্যাগ করে বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গঠন করেন প্রচণ্ড।
গণতন্ত্রে নতুন দেশ নেপাল। সবে তাদের হাতেখড়ি হয়েছে। রাজনীতির এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে তাই নেপালের মানুষ ক্ষুব্ধ। তারা পরিস্থিতির জন্য নতুন শাসনব্যবস্থাকেই দায়ী করছেন।
২৪০ বছর ধরে যে শাসনব্যবস্থার সঙ্গে নেপালিরা পরিচিত, আবার সেই রাজতন্ত্রেই ফিরে যেতে চাইছেন অনেকে। নেপালে জোরালো হচ্ছে রাজতন্ত্রের দাবি। হিন্দু ধর্মের অনিশ্চয়তার জন্যও এই শাসনব্যবস্থাকে তাঁরা দায়ী করছেন।