অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়। কাতার বিশ্বকাপের শেষ লগ্নে লিয়োলেন মেসি বনাম কিলিয়ান এমবাপে দ্বৈরথ যে এমন অভূতপূর্ব হতে চলেছে, তা কে-ই বা কল্পনা করেছিলেন! নাটকীয়, রুদ্ধশ্বাস ফাইনালের পর অবশেষে ১০ নম্বর নীল-সাদা জার্সিধারীর হাতেই উঠেছে বিশ্বকাপ। একটু দূর থেকে স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা নিয়ে সেই দৃশ্য দেখলেন ফরাসি ‘ট্র্যাজিক হিরো’।
বহু অভাবনীয় রূপকথা আর ইন্দ্রপতনের সাক্ষী থেকেছে এই বিশ্বকাপ। কাতারই হয়ে থাকল মেসির বিদায়মঞ্চ। দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়়তে দেখা গিয়েছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে। দুই নায়কের মহাকাব্যিক দ্বৈরথের সমাপ্তি ঘোষণা করল কাতার বিশ্বকাপই।
তবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বহু বিতর্ক কাঁটার মতো বিঁধেছে কাতার বিশ্বকাপকে। ঘুষকাণ্ড থেকে শুরু করে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে তুলকালাম, মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে তরজা। বহু প্রশ্ন উঠেছে।
মাহশা আমিনির মৃত্যুর প্রতিবাদে বিশ্বকাপের মঞ্চে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ইরানের ফুটবলারদের জাতীয় সঙ্গীত না গাওয়া গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। চুপ ছিলেন গ্যালারিতে বসে থাকা বহু দর্শকও। বিশ্বকাপ শুরুর দু’মাস আগে থেকে ইরানে বিক্ষোভের আগুন জ্বলেছে, তার আঁচ যে কাতারেও পৌঁছে যাবে, তা হয়তো অনেকেই কল্পনা করেননি।
বিতর্ক রয়েছে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ ঘিরেও। ইকুয়েডর বনাম কাতার। ইংল্যান্ডের একটি সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে, ম্যাচ ‘ছেড়ে’ দেওয়ার জন্য নাকি ইকুয়েডরের ফুটবলারদের ৭৪ লক্ষ ডলার ঘুষ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে কাতার! যদিও শেষ পর্যন্ত ম্যাচ জিতেছে ইকুয়েডর। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ২-০ গোলে কাতারকে হারিয়েছে তারা।
তবে সবচেয়ে বড় বিতর্ক কাতারকে বিশ্বকাপের আয়োজন করতে দেওয়া নিয়ে। বারো বছর আগের এক রাত। স্থান সুইৎজ়ারল্যান্ডের জ়ুরিখ। সেই যে শুরু, বিদায়ের লগ্নেও তা থামার লক্ষণ নেই।
সেপ ব্লাটারের বিরুদ্ধে ঘুষ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে বিশ্বকাপ আয়োজনের বরাত বিক্রির অভিযোগ ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা ফিফাকে আজও তাড়া করে বেড়াচ্ছে। প্রচণ্ড গরম নিয়ে ফিফার নিজস্ব টেকনিক্যাল কমিটির প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও কাতারের হাতে বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বত্ব তুলে দেওয়ার ঘোষণা করেন ব্লাটার। পরে ধীরে ধীরে ঢাকনা সরে প্রকাশ্যে বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি।
অভিযোগ ওঠে, ঘুষের বিনিময়ে ব্লাটাররা কাপের উপহার তুলে দিয়েছেন তেলের টাকায় ভাসতে থাকা ধনকুবেরদের হাতে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যাস সরবরাহকারী দেশের অর্থবল প্রলুব্ধ করেছে কর্তাদের। এই বিতর্কের জেরে সতেরো বছর ফিফার প্রেসিডেন্ট থাকার পর ২০১৫ সালে পদত্যাগও করতে হয় ব্লাটারকে।
যাদের ইতিহাস বেদুইনদের, ফুটবলের নয়, বিশ্বমানের স্টেডিয়ামও নেই, পশ্চিম এশিয়ার সেই ছোট্ট দেশ কাতার কী ভাবে বিশ্বকাপের মতো ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ আয়োজনের দায়িত্ব পেয়ে গেল, তা নিয়ে তর্ক হয়েছে। বিতর্কের রেশ অনুভূত হয় কাতার কার্নিভালেও।
কাতারের স্টেডিয়ামগুলির পরিকাঠামো নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ছোট্ট দেশটির যাযাবর জনগোষ্ঠী বায়াত-আল-শা-আর-রা মরুভূমিতে যে ধরনের তাঁবুতে থাকতেন, তারই অনুকরণে দোহা থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার উত্তরে ৬০ হাজার দর্শকাসনের আল বায়েত স্টেডিয়াম গড়ে তোলা হয়। তার নির্মাণে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে বলে অভিযোগ জানিয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বয়কটের সিদ্ধান্ত নেন শাকিরা-সহ একাধিক তারকা।
স্টেডিয়াম তৈরির সঙ্গে যুক্ত থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে কাতার কর্তৃপক্ষের খারাপ আচরণ নিয়ে বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে। মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো অনেক গোষ্ঠীই পরিযায়ী শ্রমিকদের কম বেতন এবং জীবনযাত্রার নিম্নমান নিয়ে প্রশ্ন তোলে। অভিযোগ, অনেক শ্রমিকের প্রাণ গিয়েছে স্টেডিয়াম তৈরি করতে গিয়ে।
বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার পরেও থেমে ছিল না বিতর্ক। ইরানের ফুটবলারদের মতো জার্মান দলের খেলোয়ারদের হাত দিয়ে মুখ চেপে প্রতিবাদ নজর কেড়েছে গোটা বিশ্বের।
জাপানের বিরুদ্ধে ম্যাচের আগেই ফিফাকে প্রতারক, বিশ্বাসঘাতক বলে উল্লেখ করে আদালতে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয় জার্মানি। সেই প্রতিবাদ যে ওখানেই থেমে যায়নি, এটা বোঝাতেই মাঠের মধ্যে মুখে হাত চাপা দিয়ে দাঁড়ান ফুটবলাররা। শুধু তাই নয়, জার্মানির অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী ন্যান্সি ফাসের হাতে ‘ওয়ানলাভ’ আর্মব্যান্ড দেখা যায়।
বিশ্বকাপের দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা বনাম নেদারল্যান্ডসের ম্যাচে বিতর্ক হয় স্পেনের রেফারি মাতেউ লাহোজের সিদ্ধান্ত ঘিরে।
ওই ম্যাচে ১৫টি কার্ড দেখিয়েছিলেন রেফারি। তার মধ্যে ৮টি হলুদ কার্ড দেখেছেন আর্জেন্টিনার ফুটবলাররা। নেদারল্যান্ডসের ফুটবলাররা দেখেছেন ৬টি হলুদ কার্ড এবং ১টি লাল কার্ড। হলুদ কার্ডের তালিকায় মেসিও ছিলেন। সেই নিয়ে ম্যাচের মধ্যে মাতেউর সঙ্গে তর্কাতর্কি হয় মেসির।
কোয়ার্টার ফাইনালের পরে রেফারি লাহোজের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন মেসি। মাতেউকে দায়িত্ব দেওয়ার আগে ফিফার ভেবে দেখা উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি। তার পরেই মাতেউকে বিশ্বকাপের রেফারির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
দীর্ঘ ৩৬ বছর পর ফুটবল বিশ্বকাপ জিতেছে আর্জেন্টিনা। তার পরেই বিতর্কে জড়ান নীল-সাদাদের গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেস। প্রতিযোগিতার সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার হাতে তাঁর একটি অঙ্গভঙ্গি নিয়ে জোর তরজা শুরু হয়েছে।
সমাজমাধ্যমে অনেকেই বিশ্বকাপজয়ী গোলরক্ষকের আচরণের সমালোচনা করেছেন। বিশ্বকাপের মঞ্চে কাদের উদ্দেশ্য করে তিনি কেন এমন করলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ঘটনার ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়েছে। মার্তিনেস নিজে অবশ্য তাঁর এই আচরণ নিয়ে মুখ খোলেননি।
বিশ্বকাপে বেলজিয়াম ০-২ গোলে হেরে যায় মরক্কোর কাছে। ডি ব্রুয়েনদের হার মেনে নিতে পারেননি সমর্থকরা। যার জেরে দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হয় ব্রাসেলসে। ভাঙচুর চলে বহু দোকানে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় গাড়ি।
বিশ্বকাপের ম্যাচে রোনাল্ডোকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখা নিয়েও বিস্তর তর্কবিতর্ক হয়েছে। চর্চা হয়েছে কোচ ফার্নান্দো স্যান্তোসের সঙ্গে শীতল সম্পর্ক নিয়েও।
বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলতে মাদ্রিদ থেকে উড়ে আসতে চেয়েছিলেন করিম বেঞ্জেমা। তা নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছে ফুটবল মহলে। কিন্তু ফরাসি কোচ দিদিয়ে দেশঁ রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ফাইনাল দেখতে আসেননি ফরাসি স্ট্রাইকার।