বাংলা জুড়ে গত কয়েক দিন ধরে তাপপ্রবাহের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। টানা এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে তাপপ্রবাহ চলছে দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলায়। আবহাওয়া দফতর জারি করেছে কমলা সতর্কতা।
গরম পড়ার জন্য এ বার আর ক্যালেন্ডার মেনে অপেক্ষা করেনি গ্রীষ্মকাল। চৈত্রেই রোদের তেজ দহনের ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিল। বৈশাখে যা আরও দৃঢ় হয়েছে।
কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের জেলায় জেলায় তাপপ্রবাহের সতর্কতা জারি করেছে হাওয়া অফিস। তাপমাত্রা ৪০ পেরিয়ে কোথাও কোথাও ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের গণ্ডিও ছুঁয়ে ফেলেছে।
টানা কয়েক দিন ধরে কলকাতার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে ঘোরাফেরা করেছে। প্রখর রোদে বাড়ির বাইরে পা ফেলতে ভয় পাচ্ছেন অনেকে।
এই পরিস্থিতিতে বৃষ্টি নিয়ে সপ্তাহান্তে আশার কথা শুনিয়েছে হাওয়া অফিস। দক্ষিণবঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলায় বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু গরম তাতে কতটা কমবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
রাজ্যের পরিস্থিতি দেখে অনেকের মনে পড়ে যাচ্ছে ১৯৯৫ সালের আমেরিকার কথা। তাপপ্রবাহ নয়, সে বার তাপগম্বুজের কবলে পড়েছিল আমেরিকার শিকাগো শহর এবং লাগোয়া এলাকা।
কী এই তাপগম্বুজ? জানা যাচ্ছে, তাপপ্রবাহের চেয়েও কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয় তার ফলে। এটি উষ্ণ আবহাওয়ার একটি চরম পরিস্থিতি। তাপগম্বুজ থেকে বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রাণঘাতী তাপপ্রবাহ তৈরি হতে পারে।
আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, উষ্ণ সামুদ্রিক বায়ু যখন আবহাওয়াজনিত কারণে বিস্তীর্ণ কোনও ফাঁকা স্থানে আটকে পড়ে, কোনও দিকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ পায় না, তখন তাপগম্বুজের সৃষ্টি হয়।
উষ্ণ জলের সঙ্গে উচ্চচাপ পরিস্থিতির সংমিশ্রণে আটকে পড়া গরম বাতাস বিশাল গম্বুজের আকার নেয়। সেই কারণেই এর নাম তাপগম্বুজ বা হিট ডোম। আবহাওয়ার বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে তাপগম্বুজ তৈরি হতে পারে।
শীতকালে নিরক্ষীয় প্রশান্ত মহাসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকায় পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। সমুদ্রের এই উষ্ণ জল উচ্চচাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
তাপগম্বুজ তৈরি হলে অনিয়ন্ত্রিত এবং অস্বাভাবিক হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। তার প্রভাব নির্দিষ্ট কোনও এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তাপের দাপট চোখে পড়ে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, কখনও কখনও একাধিক জেলা, একাধিক রাজ্যেও তাপগম্বুজের প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে পারে। তার দাপট চলতে পারে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় সাধারণত তাপগম্বুজের প্রভাব চোখে পড়ে। পূর্ব ভারতে এই বিশেষ আবহাওয়াজনিত পরিস্থিতি বিরল। কখনও কখনও উত্তর ভারতে তাপগম্বুজের পরিস্থিতি তৈরি হতে দেখা দেয়। যদিও তা বেশ বিরল।
সম্প্রতি ইউরোপে ঘন ঘন তাপগম্বুজের প্রভাব দেখা দিয়েছে। পোল্যান্ড, ডেনমার্ক, চেক প্রজাতন্ত্র, নেদারল্যান্ডস, বেলারুশ, লিথুয়ানিয়ার মতো দেশে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়ে গিয়েছে, যার নেপথ্যে রয়েছে এই তাপগম্বুজ।
১৯৯৫ সালে প্রবল তাপপ্রবাহের কবলে পড়েছিল শিকাগো। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, মারা গিয়েছিলেন ৭৩৯ জন মানুষ। মূলত আর্থিক ভাবে যাঁরা অসচ্ছল, যাঁরা বাতানুকূল যন্ত্র কিনতে পারেননি, তাঁদেরই মৃত্যু হয়েছিল গরমে।
তাপগম্বুজের ফলে আমেরিকার তাপমাত্রা পৌঁছে গিয়েছিল ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। সেখানকার মানুষ এই তাপমাত্রার সঙ্গে পরিচিত নন। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা খুব বেশি হলে ৩০ ডিগ্রির ঘরে ওঠে আমেরিকায়। ৪০ ডিগ্রির জ্বালাপোড়া গরম তাঁদের ধাতে সয়নি।
২০২১ সালে পশ্চিম কানাডা এবং আমেরিকার পশ্চিম অংশেও তাপগম্বুজ তৈরি হয়েছিল। তার ফলে যে তাপপ্রবাহ ওই এলাকাগুলিতে দেখা গিয়েছে, তাতে প্রাণহানিও হয়েছে প্রচুর। অনেকে আবার তাপগম্বুজ শব্দটি ব্যবহার করেন না। তীব্র তাপপ্রবাহ হিসাবেই এই পরিস্থিতিকে পরিচিত করা হয়।