প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে নামার পরেই ব্রিটেনে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটগুলিতে তালা ঝোলানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন ঋষি সুনক। চিনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের বাড়বাড়ন্তের সময় আবারও এই প্রতিষ্ঠানগুলির নাম ভেসে উঠছে। কিন্তু কেন?
চিন সরকারের দাবি, বিদেশের মাটিতে নিজেদের ভাষা, শিল্পকলা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রসারের উদ্দেশ্যেই গড়ে তোলা হয়েছে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটগুলি। তবে সমালোচকদের দাবি, শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রসারের আড়ালে চিন সরকারের প্রচারযন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে এই প্রতিষ্ঠানগুলি।
কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটগুলিতে পড়াশোনা হয় শুধুমাত্র চিনা ভাষায়। এমনকি, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পাঠ্যক্রমে তাইওয়ান বা তিব্বতের মতো স্পর্শকাতর বিষয়কে পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে সুনকের হুঙ্কার ছিল, ‘‘ক্ষমতায় এলে ব্রিটেনের ৩০টি কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটকে বন্ধ করে দেব।’’ বস্তুত, বিশ্বে সুনকের দেশেই সবচেয়ে বেশি কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট রয়েছে। গত জুলাইয়ে কনজ়ারভেটিভ পার্টির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী পদে নিজের প্রচারে নেমে সুনক বলেছিলেন, ‘‘ব্রিটেন তথা বিশ্বের সুরক্ষা ও সমৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে চিন এবং চিনা কমিউনিস্ট পার্টি।’’
সমালোচকদের আরও দাবি, বিদেশের মাটিতে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির হয়েও প্রচার চালায় কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটগুলি। ‘রেডিফরঋষি’ নামে প্রচারের সিংহভাগ জুড়েই ছিল এই প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে সুনকের ‘সুর চড়ানো’ মন্তব্য। ব্রিটেন ছাড়াও বিশ্বের বহু দেশই চিনের এই প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। কিন্তু কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটগুলির বিরুদ্ধে বিশ্ব জুড়ে শোরগোল কেন?
শুধু ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী সুনক নন, আমেরিকা বা সুইডেনের মতো উন্নত দেশগুলিও এর বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে চিনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রচার তথা বিশ্ব জুড়ে প্রভাব বিস্তারের যন্ত্র হিসাবে তকমা দিয়েছিল আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট। সেটা ছিল ২০২০ সাল।
চলতি বছরের গোড়ায় সুরক্ষাজনিত কারণ দেখিয়ে দেশের সমস্ত কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট বন্ধ করে দিয়েছে সুইডেন। গত বছর সে দেশে মোট ৪টি এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
সুইডেনের দক্ষিণাঞ্চলের ফকেনবার্গ শহরে ১টি কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট চালু ছিল। চলতি বছর তাতেও তালা পড়েছে। ফলে চিন পরিচালিত এ ধরনের কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই অস্তিত্ব নেই সুইডেনে। ইউরোপের প্রথম দেশ হিসাবে এই পদক্ষেপ করেছে সে দেশ।
সুইডেনের মতো একই পথে পা বাড়িয়েছে আমেরিকার মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়। সে দেশে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্ত ১টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে তারা।
মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি, কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে বেজিং।
চিনের এই প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ উঠেছে। দাবি করা হয়, চিনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)-র একনিষ্ঠদেরই কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটগুলিতে শিক্ষকের চাকরি দেওয়া হয়।
২০০৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সোলে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তার পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তা আড়েবহরে বেড়েছে। আমেরিকার হেরিটে়জ় ফাউন্ডেশনের দাবি, বিশ্বের ১৪৬টি দেশে ৫২৫টি কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট রয়েছে।
বিশ্ব জুড়ে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটগুলিতে মোট ৯০ লক্ষ পড়ুয়া রয়েছেন বলেও দাবি হেরিটে়জ় ফাউন্ডেশনের। অন্য দিকে, ২০১৮ সালে আমেরিকার ‘পলিটিকো’ পত্রিকা দাবি করেছিল, বিভিন্ন দেশে অসংখ্য কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট চালাতে প্রতি বছর চিন সরকারের ১,০০০ কোটি টাকা খরচ হয়।
কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের বিরুদ্ধে আরও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে আমেরিকায়। ২০২০ সালে সে দেশের শিক্ষা মন্ত্রক হার্ভার্ড এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল। অভিযোগ, চিন-সহ বহু দেশের থেকে কোটি কোটি ডলারের চুক্তি এবং উপহার পেয়েছে তারা।
আমেরিকার মেধাস্বত্বে দখলদারি করা ছাড়াও সে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে বেজিংয়ের আগ্রাসনের অভিযোগও উঠেছে। আরও অভিযোগ, এ সবের পিছনে মাধ্যম হিসাবে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটগুলিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। গত বছর আমেরিকার সেনেটের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গভর্মেন্টাল অ্যাফেয়ার্স কমিটির একটি রিপোর্টে দাবি করা হয়েছিল, এই ইনস্টিটিউটগুলির মাধ্যমে ১,৫৪০ কোটি ডলার সরাসরি আমেরিকায় পাঠানো হয়েছিল।
চিনের অতিমারি পরিস্থিতি বিগড়ে যাওয়ার পর পর তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগও উঠেছে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটগুলির বিরুদ্ধে। চিনে করোনার উপরূপ বিএফ.৭-এ সংক্রমণ ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। লন্ডনের এয়ারফিনিটি লিমিটেড নামে বিশ্লেষক সংস্থার দাবি, জানুয়ারিতে চিনে ৩০ লক্ষেরও বেশি দৈনিক সংক্রমণ হতে পারে। যা মার্চে বেড়ে ৪০ লক্ষে পৌঁছনোর আশঙ্কা রয়েছে। যদিও অতিমারির এই ভয়াবহতাকে খাটো করে দেখানোর কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটগুলিকে কাজে লাগানো হতে পারে বলে দক্ষিণপন্থীদের দাবি।