‘নিঃশব্দ ঘাতক’কে চিনে ফেলার প্রযুক্তি অবিষ্কার করেছে ড্রাগন। সেই খবর প্রকাশ্যে আসতেই যুক্তরাষ্ট্রের নৌসেনা কম্যান্ডারদের কপালে পড়ল চিন্তার ভাঁজ। এর জেরে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চালবাজ চিনের ‘দাদাগিরি’ বন্ধ করা যে রীতিমতো কঠিন হবে, তা বলাই বাহুল্য।
পরমাণু শক্তিচালিত মার্কিন ডুবোজাহাজ। এক বার সমুদ্রের গভীরে ডুব দিলে সেগুলিকে আর চিহ্নিত করা সম্ভব নয় বলেই এত দিন পর্যন্ত দাবি করে এসেছেন বিশ্বের তাবড় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। যুক্তরাষ্ট্রের গর্বের সেই ‘অদৃশ্য’ হাতিয়ারকে নিখুঁত নিশানায় ওড়ানোর প্রযুক্তি তৈরি হয়ে গিয়েছে, জানিয়েছেন বেজিঙের প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা।
হংকঙের সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমেরিকার পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ চিহ্নিত করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছেন চিনের জ়িয়ান প্রদেশের নর্থওয়েস্টার্ন পলিটেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনপিইউ) গবেষকেরা। তাঁদের দাবি, এ বার থেকে সমুদ্রের গভীরে থাকা বিশ্বের সর্বোত্তম ‘নিঃশব্দ ঘাতক’কের অবস্থানও বলতে পারবেন তাঁরা।
‘স্টেলথ’ প্রযুক্তির পরমাণু ডুবোজাহাজ চলাচলের সময়ে সাগরের অতলে তৈরি হয় চৌম্বকীয় ক্ষেত্র। এর সাহায্যেই ‘নিঃশব্দ ঘাতক’গুলিকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিনা প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা। তাঁদের দাবি সত্যি হলে নৌযুদ্ধে ‘বিপ্লব’ আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ডুবোজাহাজ চিহ্নিতকরণের গবেষণায় নেতৃত্ব দেন এনপিইউ-এর সহকারী অধ্যাপক ওয়াং হংলেই। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘এর জন্য একটি কেলভিন ওয়েক মডেল তৈরি করা হয়েছে। জলের গভীরে চলাচলের সময়ে ডুবোজাহাজ ইংরেজি ভি অক্ষরের মতো দেখতে চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে। ওয়েকের সাহায্যে সেগুলি চিহ্নিত করে ডুবোডাহাজটির অবস্থান বুঝতে পারব আমরা।’’
চিনা গবেষষকদের আরও দাবি, ডুবোজাহাজের চলাচলের জেরে সমুদ্রের জলের আয়ন বিঘ্নিত হয়। তখনই ভূ-চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে জলের গভীরেই সেগুলি তৈরি করে চৌম্বকীয় ক্ষেত্র। সুপার কম্পিউটারের সাহায্যে সেটি বিশ্লেষণ করলে ডুবোজাহাজটির আকার এবং গতি পর্যন্ত জানা সম্ভব।
গত বছরের ৪ ডিসেম্বর হারবিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের পিয়ার-রিভিউ জার্নালে ডুবোজাহাজ চিহ্নিতকরণ সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন ড্রাগনের প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু শক্তিচালিত ‘সমুদ্র নেকড়ে’ (সি-উল্ফ) শ্রেণির ডুবোজাহাজকে বেছে নেন তাঁরা। প্রবন্ধ অনুযায়ী, এতে ১০০ শতাংশ সাফল্য পেয়েছেন চিনা গবেষকের দল।
বেজিঙের প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা যে সময়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছেন বলে জার্নালের প্রকাশিত প্রবন্ধ দাবি করা হয়েছে, ঠিক তখনই জাপানের ইকোসুকা বন্দরে নোঙর করেছিল ‘সি-উল্ফ’ শ্রেণির একটি মার্কিন ডুবোজাহাজ। ফলে বিষয়টি জানাজানি হতেই এই নিয়ে রীতিমতো হইচই পড়ে যায়। গত বছরের অক্টোবর থেকে ওই ডুবোজাহাজ জাপান সাগর এবং ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরে চক্কর কেটেছে বল ওয়াশিংটনের প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন সূত্রে মিলেছে খবর।
‘সি-উল্ফ’ শ্রেণির ‘নিঃশব্দ ঘাতক’কে মার্কিন নৌবাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী ডুবোজাহাজ হিসাবে গণ্য করা হয়। শত্রুব্যূহে ঢুকে একের পর এক রণতরী ডোবানোর লক্ষ্যে এগুলির নকশা তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অনেকটা দূরের রাস্তা পাড়ি দিয়ে বা যুদ্ধজাহাজ ও শত্রুর ডুবোজাহাজকে তাড়া করে ডোবানোর ক্ষমতা রয়েছে ‘সমুদ্র নেকড়ে’দের।
মার্কিন ‘সি-উল্ফ’ শ্রেণির ডুবোজাহাজে রয়েছে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র এবং টর্পেডো। এ ছাড়া ওয়াটার মাইন বিছিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে এই ‘নিঃশব্দ ঘাতক’-এর। ফলে এত দিন এগুলিকে অত্যন্ত সমীহ করে চলত চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ নৌসেনা। ডুবোজাহাজ চিহ্নিতকরণের নতুন প্রযুক্তি হাতে পেলে বেজিং আরও আগ্রাসী হবে বলেই মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
২০২১ সালের অক্টোবরে দক্ষিণ চিন সাগরে ধ্বংস হয় ‘ইউএসএস কানেকটিকাট’ নামের একটি মার্কিন ‘সি-উল্ফ’ শ্রেণির পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ। সূত্রের খবর, গোপন অপারেশনে ‘নিঃশব্দ ঘাতক’টিকে ওই এলাকায় পাঠিয়েছিল পেন্টাগন। ফলে এই নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া দেয় চিন। বেজিঙের সরকারি সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইম্স অবশ্য লিখেছিল, ডুবোজাহাজটির অবস্থান জানা ছিল না পিএলএ নৌসেনার। ফলে একে মার্কিন আগ্রাসন বলে উল্লেখ করেন তাঁরা।
‘ইউএসএস কানেকটিকাট’ ধ্বংসের কারণ প্রকাশ্যে না-আনায় প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছিল পেন্টাগন। সূত্রের খবর, ওই ঘটনার পর থেকেই ‘স্টেলথ’ ডুবোজাহাজ চিহ্নিতকরণের প্রযুক্তি অবিষ্কারে কোমর বেঁধে লেগে পড়েন চিনা প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। প্রায় তিন বছর পর এ ব্যাপারে সাফল্য মিলেছে বলে দাবি করেছেন তাঁরা। তবে ওই প্রযুক্তি চিনা নৌসেনা কবে থেকে ব্যবহার শুরু করবে, তা জানা যায়নি।
ওয়াং তাঁর গবেষণাপত্রে বলেছেন, ‘‘এত দিন পর্যন্ত ডুবোজাহাজ চিহ্নিত করতে সোনার প্রযুক্তিই ছিল ভরসা। কিন্তু এতে পরমাণু শক্তিচালিত ‘স্টেলথ’ ডুবোজাহাজগুলিকে চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব। অন্য দিকে চৌম্বকীয় ক্ষেত্রকে ব্যবহার করে এগুলির অবস্থান জানা অনেকটাই সহজ। কারণ সমুদ্রের গভীরে দীর্ঘ সময় ধরে থেকে যায় চৌম্বকীয় ক্ষেত্র।’’ একে ডুবোজাহাজের পদচিহ্ন বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি কুর্সিতে বসা ইস্তক চিনের সঙ্গে খারাপ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক। দুই মহাশক্তিধরের মধ্যে যুদ্ধের প্রবল আশঙ্কা রয়েছে বলেও মনে করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ডুবোজাহাজ-বিরোধী যুদ্ধে নিজেকে সক্ষম করে তুলতে চাইছে বেজিং। নতুন প্রযুক্তি ড্রাগনকে সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে যে সাহায্য করবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
মার্কিন-চিন সম্ভাব্য সংঘাত নিয়ে ইউরেশিয়ান টাইমসের কাছে মুখ খুলেছেন শিক্ষাবিদ লোরো হোর্তা। তাঁর কথায়, ‘‘ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ড্রাগনের নৌসেনাকে খতম করতে একসঙ্গে ১৪টি পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ নামাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধের সময়ে সেগুলিকে খুঁজে আগেই উড়িয়ে দিলে রাতারাতি বদলে যাবে লড়াইয়ের রং।’’
বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম নৌবহর রয়েছে পিএলএ নৌসেনার হাতে। ডুবোজাহাজের সংখ্যাও ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে বেজিং। সেগুলিকে ধ্বংস করতে মার্কিন ডুবোজাহাজগুলিকে চিনা উপকূলের কাছাকাছি পৌঁছতে হবে। সে ক্ষেত্রে ‘নিঃশব্দ ঘাতক’কে ড্রাগনের জল-যোদ্ধারা চিহ্নিত করুক, তা কখনওই চাইবেন না যুক্তরাষ্ট্রের দুঁদে নৌকম্যান্ডারেরা ।
ইউরেশিয়ান টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডুবোজাহাজ চিহ্নিতকরণের আরও কয়েকটি প্রযুক্তি রয়েছে চিনের হাতে। গত বছর সাংহাইয়ের জিয়াও টং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা দাবি করেন, কম ফ্রিকোয়েন্সিতে নির্গমনকে বিশ্লেষণ করে সমুদ্রের নীচের সামরিক লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করতে পারছেন তাঁরা। উপকূল থেকে ২০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত এই প্রযুক্তি কাজ করবে বলে জানানো হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে চিন ও আমেরিকার যুদ্ধ বাধার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটিকে নিজেদের অংশ বলে দীর্ঘ দিন ধরে দাবি করে আসছে বেজিং। শুধু তা-ই নয়, এটিকে কব্জা করার নীল নকশা ইতিমধ্যেই তৈরি করে ফেলছেন ড্রাগন প্রেসিডেন্ট তথা শি জিনপিং।
পিএলএ নৌসেনা তাইওয়ান আক্রমণ করলে সরাসরি যুদ্ধে নামার হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে আমেরিকা। চিনা প্রযুক্তির নজর এড়িয়ে তখন কী ভাবে ড্রাগন রণতরীগুলির উপর প্রত্যাঘাত শানাবে যুক্তরাষ্ট্র? এর জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই) ডুবোজাহাজগুলিকে মুড়ে ফেলবে ওয়াশিংটন? না কি অন্য কোনও উপায়ে মাত হবে চিন? উত্তর মিলবে সময়ে।