তিনি প্রাসাদের চার দেওয়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন অনেক বছর আগেই। ক্রমে পথে নেমেছেন। সাধারণের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সাধারণের কথা তুলে ধরেছেন সংসদের চার দেওয়ালের ভিতরে। তিনি বিজেপি নেত্রী দিয়া কুমারী। এ বার কি সাধারণ মানুষের দাবিদাওয়া নিয়ে হাজির হবেন রাজ্য বিধানসভায়? নাকি নিজেই শুনবেন সে সব?
রবিবারই রাজস্থান বিধানসভার ফল প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯টি আসনের মধ্যে ১১২টিতে জিতেছে বিজেপি। রাজস্থানে সরকার গঠন করতে চললেও কাকে মুখ্যমন্ত্রী করা হবে, তা এখনও জানায়নি বিজেপি।
মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবে বেশ কয়েক জনের নাম উঠে এসেছে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম বিজেপির সাংসদ তথা সদ্যজয়ী বিধায়ক দিয়া। জয়পুরের শেষ রাজা দ্বিতীয় মান সিংহের নাতনি দিয়া। এই দ্বিতীয় মান সিংহের তৃতীয় স্ত্রী হলেন গায়ত্রী দেবী। কোচবিহারের রাজকন্যা ছিলেন তিনি। সেই অর্থে দিয়া গায়ত্রীরও নাতনি।
দিয়া কিন্তু সেই রাজবংশের পরিচয় থেকে অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছেন। ভোটারদের কাছে ‘জয়পুরের মেয়ে’ হিসাবে ভোট চেয়েছেন। আর ভোটাররা তাঁকে চিনেছে ‘সেই রাজকুমারী, যিনি রাস্তায়ঘাটে হাঁটেন’ হিসাবে।
প্রচারের সময় দিয়ার সঙ্গে সেলফি তুলেছেন তাঁর কেন্দ্রের ভোটারেরা। তাঁকে একটু ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছেন। দিয়াও অবলীলায় সে সব আবদার মিটিয়েছেন। মাথায় ঘোমটা টেনে এক মহল্লা থেকে অন্য মহল্লায় ছুটেছেন।
সাধারণের নাগালে থাকা রাজকুমারীর ভাবমূর্তিই মন ছুঁয়ে গিয়েছে রাজস্থানবাসীর। ২০১৩ সালে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন দিয়া। তার পর থেকে তিনটি ভোটে দাঁড়িয়ে তিনটিতেই জিতেছেন।
২০১৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সওয়াই মাধোপুর কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হয়ে জিতেছিলেন তিনি। ২০১৮ সালের বিধানসভা ভোটে নিজেই প্রার্থী হতে চাননি। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে রাজসমন্দ থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। জিতেছিলেন সাড়ে পাঁচ লক্ষ ভোটে।
প্রচার থেকে লোকসভার অধিবেশন, বার বার পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মহিলাদের ক্ষমতায়ন নিয়ে সরব হয়েছেন। ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় ব্যঘ্র সংরক্ষণের সদস্যও হয়েছিলেন।
বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন বেশ কয়েক বার। অযোধ্যা মামলার শুনানির সময় দাবি করেছিলেন, তিনি রামের বংশধর। তার প্রমাণও দিতে পারেন। ২০২২ সালে তিনি দাবি করেন, জয়পুরের মহারাজা জয় সিংহের জমিতেই মুঘল সম্রাট শাহজহান তাজমহল তৈরি করেছিলেন। তাজমহল গড়ার জন্য জমি নেওয়ার বিনিময়ে জয়পুরের রাজা জয় সিংহকে সম্রাট শাহজহান ক্ষতিপুরণ দিয়েছিলেন বলেও দাবি করেছিলেন দিয়া।
চলতি বিধানসভা নির্বাচনে জয়পুরের বিধ্যানগর পূর্ব আসন থেকে লড়েছেন দিয়া। জিতেওছেন।
প্রচারের সময় বার বার দু্র্নীতিকে হাতিয়ার করেছেন দিয়া। অনেকেই তাঁর মধ্যে তখন সৎ ঠাকুমা গায়ত্রী দেবীর ছায়া দেখেছিলেন। রানি গায়ত্রী ১৯৬২ সালে রাজনীতিতে নেমেছিলেন।
জয়পুর থেকে লোকসভার সাংসদ হয়েছিলেন গায়ত্রী। পর পর তিন বার। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার বিরোধিতা করে তিহাড় জেলে আটক থেকেছিলেন। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও নাতনি দিয়ার মধ্যে অনেকে তাঁর ছায়া দেখেছেন। দ্বিতীয় মানসিংহের প্রথম স্ত্রীর সন্তান হলেন দিয়ার বাবা ভবানী সিংহ।
দিয়া অবশ্য জানিয়েছিলেন, ওঁর মহিলাদের ক্ষমতায়নের কাজ তাঁর অনুপ্রেরণা। ওঁর দেখানো পথে তিনিও মহিলাদের উন্নয়ন, ক্ষমতায়নের চেষ্টা করছেন। তিনি জয়পুরের মেয়েদের জন্য স্কুল খুলেছিলেন। দিয়া জানান, তিনিও জয়পুরে দুটো স্কুল খুলেছেন, যার সুনাম গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
রাজপরিবারের অনেক বিধিনিষেধও ভেঙেছিলেন দিয়া। রাজত্ব আর নেই। তবু এখনও রাজস্থানের রাজপরিবারগুলি ছেলে-মেয়েদের বিয়ে অন্য রাজপরিবারেই দেয়। দিয়া সেই পথে হাঁটেননি। তিনি বিয়ে করেছিলেন নরেন্দ্র সিংহকে।
দিয়ার এই সিদ্ধান্তে রাজপুতেরা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। খুন-অপহরণ, সামাজিক বয়কটের হুমকি, বাবা-মায়ের চাপ— কোনও কিছুই আমল দেননি দিয়া। ১৯৯৭ সালে সওয়াই মাধোপুরের সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে নরেন্দ্রকে বিয়ে করেন। ২৪ বছর ঘর করেছেন তিনি। তিন সন্তান রয়েছে তাঁদের।
২৪ বছর পর দিয়ার বিয়ে ভেঙে গিয়েছে। সেই বিষয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চাননি কেউই। তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা রক্ষা করার আর্জিও জানিয়েছেন দিয়া।
এখন রাজ পরিবারের ট্রাস্টের সমাজসেবার কাজ, তিনটি স্কুল, জয়পুর-মাউন্ট আবুতে তিনটি হেরিটেজ হোটেল তিনি সামলান। রাজপুতদের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত তিনি।
এই দিয়াই এখন মুখ্যমন্ত্রীর দৌড়ে রয়েছেন। সেখানে তাঁকে টেক্কা দিচ্ছেন আর এক রাজকুমারী তথা রাজবধূ বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া। অনেকেই মনে করেন, শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক দৌড়ে এগিয়ে দেবে তাঁকে। অনেকে আবার তাঁকে মোদীর হাতে ‘পুতুল’-ও বলেন।
এই বসুন্ধরার সঙ্গে দিয়ার বিরোধ বহু বছরের। বসুন্ধরা মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় দিয়াদের রাজমহল প্যালেস হোটেলের বেআইনি নির্মাণ ভাঙার নির্দেশ দেন। অভিযোগ, তাতে রাজপুতদের অসম্মান করা হয়েছিল। দিয়া, তাঁর মা মহারানি পদ্মিনী দেবী বসুন্ধরা-সরকারের বিরুদ্ধে রাজপুত সংগঠন করণী সেনাকে নিয়ে পথে নেমেছিলেন।
রাজকুমারী বনাম মহারানির সেই সংঘাতেরই কি পুনরাবৃত্তি দেখা যাবে? দিয়া অবশ্য এ সব নিয়ে মুখ খোলেননি। তবে তাঁর পরিচিতেরা বলেন, এক বার যদি রাজকুমারী কোনও সিদ্ধান্ত নেন, তা করেই ছাড়েন। যেমন সকলের বিরুদ্ধে গিয়ে মনের মানুষকে বিয়ে করেছিলেন।