বহু জল্পনা, আলোচনা ও খসড়া নিয়ে তর্ক-বিতর্কের পরে অবশেষে উত্তরাখণ্ডের বিজেপি সরকার পেশ করল দেশের প্রথম ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ সংক্রান্ত বিল। লোকসভা ভোটের মুখে এসে এই ধরনের পদক্ষেপকে ‘ঐতিহাসিক’ ঘটনার তকমা দিতে চায় মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর ধামির সরকার।
ভারতের প্রথম রাজ্য হিসাবে উত্তরাখণ্ড সরকার এই বিল বিধানসভায় পেশ করল। এই বিলে একাধিক বিষয়ের কথা বলা হয়েছে।
উত্তরাখণ্ডের বিধানসভা ভোটে বিজেপি জিতলেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ধামী। গত বছর ভোটে জিতে ক্ষমতায় ফেরার পরেই সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তৎপর হন তিনি।
উত্তরাখণ্ডে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকরের আইনি প্রক্রিয়া খতিয়ে দেখতে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জনা প্রকাশ দেশাইয়ের নেতৃত্বে কমিটি গড়ে সে রাজ্যের সরকার।
উত্তরাখণ্ড সরকারের তরফে জানানো হয়েছিল, সব ধর্মের মানুষের জন্য বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, জমি-সম্পত্তি এবং উত্তরাধিকার সংক্রান্ত একই আইন প্রচলনের রূপরেখা তৈরি করবে ওই কমিটি।
সেই মতো, বিবাহ, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, দত্তক গ্রহণের মতো বিষয়গুলিতে সকলের জন্য একই আইন চালু হওয়ার পথে আরও এক ধাপ এগোল হিমালয়ের কোলের এই রাজ্যটি।
এই বিলে রয়েছে, যদি কোনও যুগল ‘একত্রবাস’ বা ‘লিভ-ইন’ করতে চান, তবে অবশ্যই পুলিশ বা জেলা আধিকারিকদের অনুমতি নিতে হবে। আর যদি তাঁদের বয়স ২১ বছরের নীচে হয়, তবে বাবা-মায়ের সম্মতির প্রয়োজন পড়বে।
সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জনাপ্রকাশ দেশাইয়ের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেছিলেন উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী ধামি।
ওই কমিটির উপরেই দায়িত্ব ছিল অভিন্ন দেওয়ানি বিধির খসড়া তৈরি করার। কমিটির সুপারিশ মোতাবেক এই সংক্রান্ত খসড়া বিল পেশ হয় ধামির মন্ত্রিসভায়।
রবিবার মন্ত্রিসভার অনুমোদন পাওয়ার পর, সোমবার সেই বিল বিধানসভায় পেশ করেন ধামি।
এই বিল আইনে পরিণত হলে ভারতের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটবে বলে মনে করছে পদ্ম শিবির।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সংক্রান্ত বিলে নিষিদ্ধ করা হয়েছে বহু বিবাহ। যে কোনও ধর্মের মানুষের ক্ষেত্রেই এই নিয়ম বলবৎ হবে। নিয়ম ভাঙলেই কঠোর শাস্তি।
ধর্ম নির্বিশেষে মেয়েদের ন্যূনতম বিয়ের বয়স ১৮ এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১ বছর করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ‘রেজিস্ট্রি বিবাহ’ বাধ্যতামূলকের কথা বলা হয়েছে এই বিলে।
কোনও যুগল ‘লিভ-ইন’ করতে চাইলে প্রথমেই তাঁদের নাম পুলিশের কাছে নথিভুক্ত করতে হবে। ‘লিভ-ইন’ সম্পর্কের ‘ঘোষণাপত্র’ সঙ্গে রাখতে হবে যুগলকে।
সময় মতো প্রয়োজনে তা দেখাতে ব্যর্থ হলে যুগলের ২৫ হাজার টাকার জরিমানা এবং তিন মাসের জেল হতে পারে। ‘লিভ-ইন’ সম্পর্কে থাকা যুগলের যদি সন্তান হয়, তবে শিশুরা আইনি স্বীকৃতি পাবে।
কেউ যদি ‘লিভ-ইন’ সম্পর্ক নথিভুক্ত করতে ব্যর্থ হন তবে সর্বোচ্চ ছ’মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয়ই হতে পারে।
এর পাশাপাশি বিলে আরও বলা হয়েছে, যদি ‘লিভ-ইন’ সম্পর্ক নথিভুক্ত করতে দেরি হয়, সে ক্ষেত্রে তিন মাস পর্যন্ত জেল বা ১০ হাজার টাকার জরিমানা কিংবা উভয়েই হতে পারে।
বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রেও রাজ্যের সকলের জন্য একই নিয়ম বলবৎ করার কথা আছে এই বিলে। দম্পতিকে নির্দিষ্ট সময় ‘কুলিং অফ’ পিরিয়ডে থাকতে হবে।
সেই সঙ্গে এই বিলে সন্তান দত্তক নেওয়ার নিয়ম আরও সহজ করার কথা বলা হয়েছে।
এ ছাড়াও সম্পত্তির ক্ষেত্রে ছেলে এবং মেয়েদের সমান অধিকার থাকবে। জন্ম দেওয়া সন্তান এবং দত্তক নেওয়া সন্তান— দু’জনেই সম্পত্তির ক্ষেত্রে সমানাধিকারী হবে।
উত্তরাখণ্ড সরকারের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে গুজরাত এবং অসমের বিজেপি শাসিত সরকার।
বিশেষজ্ঞ কমিটিতে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি প্রমোদ কোহলি, সমাজকর্মী মনু গৌড়, অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার শত্রুঘ্ন সিংহ এবং দূন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরেখা ডাঙ্গওয়ালও ছিলেন।
বিজেপির একটি সূত্রের মতে, রামমন্দির, কাশ্মীর থেকে ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের পরে, এ বার দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার পথে এগোতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহেরা।
এ ক্ষেত্রে লোকসভা ভোটের আগে ধাপে ধাপে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি থেকে সেই প্রক্রিয়া শুরু হতে চলেছে।