তৃণমূলের জেলা সভাপতি তিনি। কিন্তু অনুব্রত মণ্ডল ওরফে কেষ্টর নামে জানে রাজ্যবাসী। তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসা ইস্তক বার বার কেষ্টর নাম শোনা গিয়েছে। সবই তাঁর গরমাগরম মন্তব্যের জন্য। কখনও পঞ্চায়েত ভোটের আগে বিরোধীদের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পাঁচনের। কখনও তাঁর ‘চড়াম, চড়াম’ মন্তব্যে হুমকি দেখেছে বিরোধীরা। কিন্তু সেই ‘হেভিওয়েট’ কেষ্ট এখন কষ্টে আছেন। গত কয়েক মাসে হুড়মুড় করে ওজন কমেছে তাঁর। বার বার স্বাস্থ্যজনিত কারণ দেখিয়ে জামিন চেয়েছেন তিনি। কিন্তু প্রতি বারই তা নাকচ হয়েছে। ঠিক কী কী অসুখ আছে কেষ্টর?
গত বছরের অগস্ট মাসে গরুপাচার মামলায় অনুব্রত মণ্ডলকে গ্রেফতার করে সিবিআই। তার আগে বেশ কয়েক বার তাঁকে তলব করেছে। কখনও ২০২১ সালের ‘ভোট পরবর্তী হিংসা’ মামলায় তো কখনও দুর্নীতিকাণ্ডে তদন্তকারীদের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। তবে তার মধ্যে একাধিক বার হাজিরা এড়িয়েছেন স্বাস্থ্যজনিত কারণ দেখিয়ে। কখনও আবার হাজিরার দিন বীরভূম থেকে কলকাতা এসেছেন শাসকদলের জেলা সভাপতি। কিন্তু সিজিও কমপ্লেক্স বা নিজাম প্যালেসে নয়, নিউটাউনের ফ্ল্যাট থেকে তাঁর গাড়ি গিয়ে ঠেকেছে এসএসকেএম হাসপাতালের গেটে।
তখন তৃণমূল প্রথম বার রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে। অনুব্রতের ‘নাড়ু’ মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। নিন্দকরা বলেন সরাসরি বোমা না বলে ঘুরিয়ে তাকে ‘নাড়ু’ বলেন কেষ্ট। অনুব্রতের আলটপকা মন্তব্যে যখন শোরগোল শুরু হয়েছে, তখন তাঁর পাশে দাঁড়ান তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি প্রকাশ্য সভায় বলেন, ‘কেষ্টর ব্রেনে অক্সিজেন কম যায়’। তিনি বোঝাতে চান স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার কারণে অনেক সময় মেজাজ হারিয়ে অনেকে অনেক কিছু বলে ফেলেন। কেষ্টও তেমনই। তাই বিষয়টিকে ‘মানবিক ভাবে’ দেখা উচিত।
‘ঠোঁটকাটা’ অনুব্রতকে অনেক বার বকাবকিও করেছেন ‘দিদি’। তবে দায়ী করেছেন বিরোধীদের। ২০১৮ সালে যেমন। বীরভূমের আমোদপুরের একটি সভায় একই মঞ্চে রয়েছেন মমতা এবং অনুব্রত। অনুব্রতকে কুকথা বলানোর জন্য মমতা দায়ী করেন ‘প্ররোচনা’কে। মমতার কথায়, ‘‘আমি প্রায়ই শুনি, ওরা বীরভূমে আসে আর কেষ্টর নামে অকথা-কুকথা বলে। কেষ্ট যদি মাথা গরম করে একটা বাজে কথা বলে, তা হলে সংবাদমাধ্যম সেটা বার বার দেখায়। অথচ ভেবে দেখেছেন কি, এই ছেলেটাকে প্ররোচনা দেওয়া হয়! উত্তেজিত করার জন্য কথা বলা হয়। সেটা লেখা হয় কই!’’
সেই কেষ্ট শুক্রবার আদালতে জানান তাঁর কষ্টের কথা। আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালতে হাজির করানো হয়েছিল তাঁকে। ভার্চুয়ালি শুনানি চলাকালীন বিচারক রাজেশ চক্রবর্তী যখন তৃণমূল নেতাকে জিজ্ঞাসা করেন, তাঁর শরীর কেমন আছে, তার জবাবে অনুব্রত জানান, এমনিতে ভালই। কিন্তু মাঝেমাঝে ফিসচুলার যন্ত্রণায় তাঁকে বেশ ভুগতে হয়।
আদালত সূত্রে খবর, অনুব্রত বিচারককে বলেন, ‘‘ফিসচুলাতে এখনও যন্ত্রণা রয়েছে। মাঝেমাঝে সেটা বেড়ে যায়। যখন বেড়ে যায়, রক্ত পড়ে।’’ তাঁর শারীরিক অবস্থার কারণে বিচারক বলেন, ‘‘জেল কর্তৃপক্ষকে বলে দিচ্ছি, যাতে আপনার ভাল চিকিৎসা করানো হয়।’’
বস্তুত, সংশোধনাগারে থাকাকালীন একাধিক বার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অনুব্রত। কখনও বলেছেন, বুকে ব্যথা। কখনও জ্বর, সর্দি-কাশিতে ভুগেছেন। যদিও প্রতি বারই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, তেমন কোনও শারীরিক সমস্যা হয়নি তাঁর। আসলে দীর্ঘ দিন ধরে অনেকগুলি অসুখে ভুক্তভোগী কেষ্ট। মাঝেমাঝে সেগুলি মাথাচাড়া দেয়। তখন হেভিওয়েট নেতা প্রচণ্ড সমস্যায় পড়েন।
ঠিক কী কী অসুখ আছে অনুব্রতের? স্থূলকায় ওই তৃণমূল নেতার ওজন ছিল ১০০ কিলোগ্রামের উপর। এমন চেহারা হলে বেশ কিছু অসুখ জেঁকে বসে শরীরে। খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। অনেক বিধিনিষেধ মানতে হয়। সূত্রের খবর, অনুব্রত শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে। তিনি সিওপিডি রোগী। তার জন্য সর্বদা অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখতে হয় তৃণমূল নেতাকে। আসানসোল জেলা কর্তৃপক্ষ সূত্রে খবর, সংশোধনাগারেও ঢাউস ‘ইনহেলার’ রাখতে হয়েছে অনুব্রতের জন্য।
সিওপিডির সমস্যা ছাড়াও কেষ্টর মধুমেহ রয়েছে বলে খবর। নিয়মিত ইনসুলিন নিতে হয় ওজনদার নেতাকে। এখানেই শেষ নয়। অণ্ডকোষেও সমস্যা রয়েছে অনুব্রতের। আছে বয়সজনিত আরও বেশ কিছু শারীরিক সমস্যা। তবে এখন নেতাকে সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে ফিসচুলা।
হার্টের সমস্যা আছে কেষ্টর। শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা যখন তখন হঠাৎ কমে যায়। তাই কৃত্রিম পদ্ধতিতে অক্সিজেন নিতে হয় অনুব্রতকে। আসানসোল জেল কর্তৃপক্ষ সূত্রে খবর, সকালে ঘুম থেকে উঠেই গুচ্ছ ওষুধ খেতে হয় কেষ্টকে।
এক সময় ভীষণই খাদ্যরসিক ছিলেন অনুব্রত। পছন্দের খাবারের কথা বলতে গিয়ে নানা সময় কেষ্ট শুনিয়েছেন তাঁর তরুণ বয়সের কথা। তখন নাকি তিনি একাই দেড় কেজি খাসির মাংস সাবাড় করে দিতে পারতেন। মাছের বিভিন্ন পদের ভক্ত ছিলেন।
কিন্তু অসুখ-বিসুখের কারণে সে সবই ছাড়তে হয়েছে। এখন নিয়ন্ত্রিত ভাবে খাবার খান। বছর খানেক আগে কেষ্ট জানিয়েছিলেন, তাঁর পাতে এখন অল্প ভাত। দু’একটা আটার রুটি থাকে। রোজকার খাবারের তালিকায় থাকে টুকরো মাছ। আর বেশি করে সব্জি।
গত বিধানসভা ভোটের সময় অননুব্রত তাঁর খাদ্যতালিকার কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, প্রাতঃরাশে সাধারণত দুধ-রুটি খান। দুপুরে তাঁর খাবারের পাতে নিম-বেগুন থাকে। থাকে আলু-পোস্ত। ওটা তাঁর অত্যন্ত পছন্দের পদ। তেল-মশলা যুক্ত খাবার নৈব নৈব চ।
অনুব্রতকে নাকি সব মিলিয়ে রোজ ৩৪টা ওষুধ খেতে হয়! সূত্রের খবর এমনটাই। তা ছাড়া, অক্সিজেন নেওয়া, ইনসুলিন নেওয়া তো আছেই। নিয়মের একটু এদিক-ওদিক হলেই অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন তিনি। তাই সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষকে বিশেষ সজাগ থাকতে হয়।
অনুব্রতের আইনজীবী বার বার স্বাস্থ্যজনিত কারণ দেখিয়ে মক্কেলের জামিন চেয়েছেন। কিন্তু বিচারকের অনুমতি মেলেনি। আবার বিরোধীরা অভিযোগ করেন, গ্রেফতারি এড়াতে এ সব ‘ফন্দি’ আঁটেন কেষ্ট। সমাজমাধ্যমে কেষ্টর অসুখ-বিসুখ নিয়ে নানা টিপ্পনী হয়। তবে কেষ্ট-ঘনিষ্ঠদের দাবি, কারও অসুস্থতা নিয়ে মজা করাটা অভিপ্রেত নয়। কেষ্ট সত্যিই অসুস্থ।