বিমানসেবিকা গীতিকা শর্মার আত্মহত্যার ঘটনায় হরিয়ানার প্রাক্তন মন্ত্রী তথা প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা গোপাল কান্ডাকে মঙ্গলবার বেকসুর খালাস করার নির্দেশ দিয়েছে দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ আদালত। এই মামলায় খালাস করা হয়েছে গোপালের সঙ্গী অরুণা চাড্ডাকেও।
দিল্লির ওই আদালতের বিশেষ বিচারক বিকাশ ধুল জানিয়েছেন, এই মামলায় যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন আইনজীবী। এর পরই গোপাল এবং অরুণাকে বেকসুর খালাস করার নির্দেশ দেন বিচারক। তবে আদালত শর্ত দিয়েছে, গোপালকে ১ লক্ষ টাকা ব্যক্তিগত বন্ড হিসাবে জমা রাখতে হবে।
বেকসুর খালাস পাওয়ার খবর পেতেই গোপাল বলেন, ‘‘আমার বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ ছিল না। এই মামলাটি আমাকে ফাঁসানোর জন্য করা হয়েছিল। আদালতের আজকের রায়ে তা পরিষ্কার।’’ গীতিকার মৃত্যু থেকে শুরু করে গোপালের বেকসুর খালাস পাওয়া, কোন পথে এগিয়েছে মামলার গতি? দেখে নেওয়া যাক এক নজরে।
প্রাক্তন মন্ত্রী গোপালের এমএলডিআর এয়ারলাইন্সে বিমানসেবিকা হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন দিল্লির বাসিন্দা গীতিকা। সেখান থেকে পদোন্নতি হয় তাঁর। বিমানসেবিকা থেকে পরবর্তী কালে গোপালের একটি সংস্থার ডিরেক্টর পদে বসানো হয় তাঁকে।
২০১২ সালের ৫ অগস্ট উত্তর-পশ্চিম দিল্লির অশোক বিহারের বাড়িতে গীতিকার মৃতদেহ উদ্ধার হয়। তাঁর নিথর দেহের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল একটি ‘সুইসাইড নোট’-ও।
২০১২ সালের ৪ অগস্ট লেখা সেই চিঠিতে গীতিকা লিখেছিলেন, গোপাল এবং অরুণার কাছে লাগাতার ‘হেনস্থা’র শিকার হতে হচ্ছে তাঁকে। এই কারণেই তিনি নিজেকে শেষ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
গীতিকার আত্মহত্যার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই তদন্ত শুরু করে পুলিশ। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী হওয়ার পাশাপাশি গোপাল ছিলেন হরিয়ানার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ভূপিন্দর সিংহ হুডার নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। কিন্তু বিতর্ক শুরু হওয়ার পরেই মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় গোপালকে।
গোপাল এবং অরুণার বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনা, ভয় দেখানো, প্রমাণ নষ্ট, ষড়যন্ত্র, জালিয়াতি-সহ বিভিন্ন ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছিল।
একটি আদালতে কান্ডার বিরুদ্ধে ধর্ষণ এবং বিকৃত যৌন সঙ্গমের অভিযোগেও মামলা দায়ের হয়েছিল। পরে দিল্লি হাই কোর্টে অবশ্য সেই অভিযোগগুলি বাতিল করে দেয়।
২০১২ সালের ৭ অগস্ট গোপালকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু গোপাল তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেন।
এর ঠিক পরের দিন এমডিএলআর-এর ম্যানেজার এবং গীতিকা মামলার সহ-অভিযুক্ত অরুণাকেও গ্রেফতার করা হয়।
এর মধ্যেই পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যান গোপাল। পুলিশ তাঁকে পলাতক বলে ঘোষণা করে। আগে ভাগেই তিনি আগাম জামিনের জন্য আবেদন করেন।
এর পর ৯ অগস্ট গোপালের বিরুদ্ধে লুকআউট নোটিশ জারি করা হয়। তল্লাশি অভিযানও চালানো হয় তাঁর বাড়িতে। ১৭ অগস্ট তাঁর জামিনের আবেদনও আদালতে খারিজ হয়ে যায়।
পরের দিন দিন অর্থাৎ, ১৮ অগস্ট গোপাল দিল্লির অশোক বিহার থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন।
ছয় মাস পরে আত্মহত্যা করেন গীতিকার মা অনুরাধা শর্মাও। তিনিও গোপালকেই দায়ী করে যান মৃত্যুর জন্যে। গোপাল অবশ্য ২০১৪ সালের মার্চ মাসে জামিন পান। জেল থেকে বেরিয়ে ভোটে দাঁড়ালেও ব্যর্থই হতে হয় গোপালকে।
তবে গ্রেফতারির পর থেকেই কংগ্রেসের সঙ্গে সমীকরণ বদলেছিল গোপালের। মাঝে তাঁর আঁতাঁত তৈরি হয় বিজেপির সঙ্গে।
হরিয়ানার লোক জনহিত পার্টির নেতা তথা সিরসার বিধায়ক গোপালকে মঙ্গলবার দিল্লির রাউজ অ্যাভিনিউ কোর্ট বেকসুর খালাস করার নির্দেশ দেয়। তবে আদালতের রায়ে গীতিকার ভাই অঙ্কিত খুশি নন।
কে এই গোপাল কান্ডা? ’৯০-এর দশকে জুপিটার মিউজিক হোমে রেডিয়ো সারিয়ে দিন গুজরান করা কান্ডা পরে ভাইয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিরসায় প্রথমে জুতোর দোকান এবং পরে জুতোর কারখানা তৈরি করেন।
ব্যবসার সুবাদে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বংশীলালের পরিবারের সঙ্গে। কিন্তু সেই সরকার পড়ে যেতেই চৌটালা শিবিরে ভিড় জমান কান্ডা।
রাজনৈতিক পরিচয়কে ব্যবহার করে গুরুগ্রামে জমি-বাড়ির ব্যবসা শুরু করেন কান্ডা।
২০০৭ সালে এমডিএলআর বিমান সংস্থা চালু করেন। সেখানেই চাকরি নেন গীতিকা। ২০০৮ সালে আয়কর দফতরের অফিসারদের মারধর করার অভিযোগ ওঠে। ওই বছরেই প্রাক্তন ভারতীয় পেস বোলার অতুল ওয়াসনের গাড়ি কান্ডার গাড়িকে ওভারটেক করায় মারধর করার অভিযোগ ওঠে।
২০০৯ সালে আইএনএলডি-র টিকিট না পেয়ে নির্দল হিসেবে লড়ে সিরসার বিধায়ক হন। হুডা সরকারকে সমর্থন করেন। ২০১২ সালে গীতিকার আত্মহত্যা। ২০১৪ সালে জামিনে ছাড়া পান কান্ডা। ধর্ষণের অভিযোগ থেকে মুক্তি পান। ২০১৯ ফের লোকহিত পার্টির পক্ষে সিরসা থেকে জয়ী হন। এ বার বেকসুর খালাস পেলেন তিনি।