১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল। এক দশক ধরে কুড়ি হাজারের বেশি গান গেয়েছেন। হিন্দি, ওড়িয়া, বাংলা ভাষা-সহ মোট ১০ রকম ভাষায় গান গাইতে পারতেন তিনি। কখনও অমিতাভ বচ্চন, কখনও গোবিন্দ,কখনও অনিল কপূরের কণ্ঠে গেয়ে একের পর এক হিট হিন্দি গান বলিউড ইন্ডাস্ট্রিকে উপহার দিয়েছেন। কিন্তু তার পরিবর্তে বলিপাড়া থেকে প্রাপ্য সম্মান পাননি মহম্মদ আজিজ। এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরে বলিপাড়ার কোনও তারকা টুইট করেও শোকপ্রকাশ করেননি।
১৯৫৪ সালের ২ জুলাইয়ে কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম সইদ মহম্মদ আজিজ উন নাবি ওরফে মহম্মদ আজিজ ওরফে মু্ন্নার। ছোটবেলা থেকেই মহম্মদ রফির ভক্ত তিনি। রফিকে অনুকরণ করে তাঁর মতো গান গাওয়ার চেষ্টা করতেন মহম্মদ আজিজ। পড়াশোনার পাশাপাশি গান শেখাও শুরু করেন তিনি।
কিন্তু ভাগ্য তাঁকে অন্য পথে যেতে বাধ্য করে। হঠাৎই পরিবারের আর্থিক অবস্থার অবনতি হয় তাঁর। অর্থের প্রয়োজনে যত দ্রুত সম্ভব একটি চাকরি খুঁজছিলেন তিনি। পরিস্থিতির চাপে গান শেখা বন্ধ হয়ে যায় তাঁর। বড় মঞ্চে গান গাওয়ার স্বপ্ন যেন এক মুহূর্তে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায় আজিজের।
তবে, আজিজ হার মানার পাত্র নন। মঞ্চে গান গাইতে পারছেন না তো কী হয়েছে? অর্থ উপার্জনের জন্য গান নিয়েই এগোনোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তিনি। কলকাতার নামী বার এবং রেস্তরাঁয় গান করতেন মহম্মদ। কিন্তু তাতে পরিবারের পরিস্থিতি কিছুটা সামলে গেলেও শান্তি পাচ্ছিলেন না তিনি।
এর পরেই মুম্বই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আজিজ। মুম্বই গিয়ে মহম্মদ রফির কাছ থেকে গান শিখবেন বলে ভেবেছিলেন তিনি। পরিবারের কাছ থেকে দু’বছরের সময় চেয়ে নিয়েছিলেন তিনি। আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, দু’বছরের মধ্যে যদি গান নিয়ে কেরিয়ারে এগোতে না পারেন, তা হলে কলকাতায় ফিরে আসবেন। বাড়ির লোকও তাঁর কথায় রাজি হয়ে যান।
১৯৮০ সালে মহম্মদ রফি প্রয়াত হন। রফিকে গুরুর চোখে দেখতেন আজিজ। গুরুর মৃত্যুর খবর পেয়ে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। রফি না থাকলে কার কাছে গান শিখবেন তিনি? স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেলেও মুম্বইয়ে যান তিনি।
মুম্বইয়ের সঙ্গীতজগতের নামকরা শিল্পীদের মধ্যে এক জন ছিলেন সেলিম আখতার। সেলিমের নিকটাত্মীয় ছিলেন আজিজের বন্ধু। সেই বন্ধুর সাহায্যে বলিউডে পা রাখেন তিনি। এর আগে ওড়িয়া ছবির জন্য গান করলেও হিন্দি ছবিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল না মহম্মদের। সেলিম আখতারের সঙ্গে কিছু দিন কাজ করেন তিনি। কিন্তু কেরিয়ারে বিন্দুমাত্র এগোতে পারছিলেন না।
মুম্বই যাওয়ার কিছু দিন পর অনু মালিকের সঙ্গে পরিচয় হয় আজিজের। অনুর সহকারী হিসাবে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। ‘মর্দ’ ছবির গান তৈরি করার সময় আজিজকে দিয়ে একটি গান গাইয়েছিলেন অনু। গানটি শুনে মনে হয়েছিল রফি গানটি গেয়েছেন।
সকলে ভেবেছিলেন রফিকণ্ঠী শাব্বির কুমারকে দিয়ে অনু গান গাইয়েছেন। কিন্তু পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে ইন্ডাস্ট্রিতে এক নতুন শিল্পী এসেছেন যাঁর গলা অবিকল রফির মতো। সেই সময় বাজারে রফিকণ্ঠী হিসাবে শাব্বির কুমার এবং আনওয়ারের খ্যাতি ছিল। কিন্তু আজিজের নাম ছড়িয়ে পড়তেই ওই দু’জনের প্রভাব কমতে শুরু করল।
ইন্ডাস্ট্রিতে পরিচিতি গড়ে তোলার পর আর থেমে থাকেননি আজিজ। একের পর এক হিন্দি ছবিতে গান গেয়েছেন তিনি। দিলীপ কুমার, ধর্মেন্দ্র, রাজেশ খন্না, জীতেন্দ্র, কমল হাসন, রজনীকান্ত, সঞ্জয় দত্ত, গোবিন্দ, অক্ষয় কুমার, শাহরুখ খান, নানা পটেকর, মিঠুন চক্রবর্তীর মতো নায়কদের কণ্ঠে গেয়েছেন তিনি।
১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, সাধনা সরগম, অলকা যাজ্ঞিকের মতো গায়িকাদের সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছেন আজিজ।
বাপ্পি লাহিড়ি, যতীন-ললিত, আরডি বর্মন, আনন্দ-মিলিন্দের মতো সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন আজিজ। তবে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল জুটির সঙ্গে। তাঁদের সঙ্গে ২৫০টিরও বেশি গান রেকর্ড করেছেন তিনি।
আজিজের কেরিয়ার যখন মধ্যগগনে, সেই সময় বলি ইন্ডাস্ট্রিতে কানাঘুষো চলত যে, দশকের সেরা গায়ক মহম্মদ আজিজ ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। কিন্তু ভাল সময় বেশি দিন উপভোগ করতে পারেননি আজিজ।
১৯৮৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘কয়ামত সে কয়ামত তক’। নব্বইয়ের দশক শুরুর দিকে বলিপাড়ার সঙ্গীতজগতে আমূল পরিবর্তন আসে। কুমার শানু, উদিত নারায়ণের মতো নতুন গায়কেরা কাজ পাচ্ছিলেন ইন্ডাস্ট্রিতে। ছবিতে ব্যবহার করা শুরু হয় অন্য স্বাদের গান। পুরনো দিনের গায়ক-গায়িকারা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছিলেন।
গান সম্পর্কিত কোনও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হোক বা বলি তারকাদের সমাগম— আজিজকে কোথাও ডাকা হত না। এক পুরনো সাক্ষাৎকারে এমনটাই দাবি করেছিলেন গায়ক। তিনি বলেছিলেন, ‘‘ইন্ডাস্ট্রিতে যাঁরা নতুন এসেছেন, তাঁরা আর আমার সঙ্গে কাজ করতে চাইছেন না। হয়তো আমাদের মধ্যে কোনও ব্যবধান তৈরি হয়ে গিয়েছে।’’
২০১৭ সালে কর্ণ জোহরের ছবি ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’ নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন আজিজ। ওই ছবিতে একটি সংলাপ ছিল যেখানে বলা হয়েছে— রফির গান শুনলে বোঝা যায় না যে তিনি গাইছেন নাকি কাঁদছেন। নিজের গুরু সম্পর্কে এমন কথা শুনে রেগে গিয়েছিলেন আজিজ।
আজিজ বলেন, ‘‘রফির বিরুদ্ধে সংলাপ যিনি লিখেছেন, তিনি আস্ত বোকা। এমন সংলাপ যিনি ছবিতে ব্যবহারের জন্য অনুমতি দিয়েছেন তিনি আরও বড় বোকা।’’ এমনকি, কর্ণকে সরাসরি বয়কট করার কথাও বলেন তিনি।
২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর। কলকাতা থেকে বিমানে মুম্বই আসছিলেন আজিজ। মুম্বইয়ে নিজের বাড়ি যাওয়ার পথে হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়েন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে নিকটবর্তী হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু হাসপাতালের চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। চিকিৎসকেরা জানান হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন তিনি।
বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে কোনও তারকা মারা গেলে অন্য তারকারা নিজেদের সমাজমাধ্যমে টুইট করে শোকপ্রকাশ করেন। কিন্তু আজিজ মারা যাওয়ার পর বলিউডের কোনও তারকা টুইট করেননি। এমনকি, যে অভিনেতাদের সঙ্গে তিনি কাজ করেছিলেন, তাঁরাও কেউ গায়কের অকালপ্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেননি।