বাবা ছিলেন বলিউড সঙ্গীতজগতের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। সেই সূত্রে পুত্রও বলিপাড়ার স্বাদ পেতে চেয়েছিলেন। তবে, বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে নয়। সঙ্গীতশিল্পী মহেন্দ্র কপূরের পুত্র রোহনের আগ্রহ ছিল অভিনয়ে। কিন্তু গোবিন্দের সঙ্গে একই ছবিতে কাজ করাই রোহনের জীবনে অন্ধকার ডেকে এনেছিল।
১৯৬৫ সালে মুম্বইয়ে জন্ম রোহনের। রোহনের বাবা মহেন্দ্র এক দশক ধরে বলিউডের বহু ছবির বিখ্যাত গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। সকলে ভেবেছিলেন যে, গানবাজনা নিয়েই নিজের কেরিয়ারে এগিয়ে যাবেন রোহন। কিন্তু সঙ্গীতের চেয়ে তাঁর বেশি আগ্রহ ছিল সিনেমার প্রতি।
হিন্দি ছবির খুঁটিনাটি জানতে ১৬ বছর বয়স থেকেই রোহন ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ফিল্মজগতে। ১৯৮১ সালে মুক্তি পেয়েছিল মনোজ কুমার পরিচালিত ঐতিহাসিক ড্রামা ঘরানার ছবি ‘ক্রান্তি’। এই ছবিতে মনোজকে সহ-পরিচালক হিসাবে সাহায্য করেছিলেন রোহন।
‘ক্রান্তি’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন দিলীপ কুমার, শত্রুঘ্ন সিনহা, হেমা মালিনী, পরভিন ববি, প্রেম চোপড়া, সারিকার মতো তারকারা। ক্যামেরার সামনে এবং পিছনে কী ভাবে কাজ হয়, সেই প্রসঙ্গে স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়েছিল রোহনের।
‘ক্রান্তি’ ছবিতে কাজ করার পর দু’-তিন বছর পরিচালনা এবং অভিনয় নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন রোহন। এমনকি, শফি ইমানদারের সঙ্গে একই মঞ্চে ‘নীলা কামরা’ এবং ‘অদা’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি।
১৯৮৫ সাল রোহনের জীবন অন্য দিকে বাঁক নেয়। যশরাজ ফিল্মসের প্রযোজনায় সুনীল দত্ত এবং রেখা অভিনীত ‘ফাসলে’ ছবিটি মুক্তি পায়। ‘ফাসলে’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন রোহনও।
‘বিজয়’ চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল রোহনকে। তবে, এই চরিত্রের জন্য যশ চোপড়ার প্রথম পছন্দ তিনি ছিলেন না। অনিল কপূরকে অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন যশ। তখন অনিলের হাতে একের পর এক ছবি।
সময়ের অভাব থাকায় যশের প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিলেন অনিল। তার পর যশ অডিশন নিতে শুরু করেন। রোহনকে দেখে পছন্দ হয়েছিল পরিচালকের। লম্বা এবং সুদর্শন চেহারার রোহনকেই ‘বিজয়’ চরিত্রের জন্য বেছে নিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু ‘ফাসলে’ ছবিটি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। বড় ক্ষতি হয় যশরাজ ফিল্মসের। পরে হিট ছবি বানিয়ে যশরাজ ফিল্মস লাভের মুখ দেখলেও রোহনের কেরিয়ারের চাকা যেন একটি ছবিতে অভিনয় করার পরেই আটকে গিয়েছিল।
অভিনয় নিয়ে কেরিয়ারে কী ভাবে এগোবেন, তা নিয়ে অভিজ্ঞদের মতামত নিতেন রোহন। কিন্তু যশ তাঁকে যা পরামর্শ দিতেন, তা বরাবর মুখ বুজে মেনে চলতেন তিনি। রোহন ‘ফাসলে’ ছবিতে যে ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, পরবর্তী ছবিতে যেন ওই একই ধরনের ছবিতে অভিনয় না করেন— এই পরামর্শ রোহনকে দিয়েছিলেন যশ।
যশের বক্তব্য ছিল, দশটি ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব পেলে প্রয়োজনে একটি ছবিতে অভিনয় করাও ভাল। কিন্তু পর পর একই ধরনের চরিত্রে কাজ করে যাওয়া কেরিয়ারের পক্ষে উপযুক্ত নয়। রোহনের কাছে এই কথাগুলি মন্ত্রের মতো হয়ে দাঁড়ায়।
‘ফাসলে’ ছবিতে অভিনয় করার পর কয়েকটি ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব এলেও রোহন তা ফিরিয়ে দেন। ১৯৮৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘লভ ৮৬’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন রোহন। কেরিয়ারের দ্বিতীয় সিনেমায় অভিনয় করছেন ভেবে উৎসাহী ছিলেন তিনি।
কিন্তু রোহনের কপালে এ বারেও হয়তো সুখ লেখা ছিল না। ‘লভ ৮৬’ ছবিতে রোহনের সহ-অভিনেতা হিসাবে কাজ করেছিলেন গোবিন্দ। বড় পর্দায় এই ছবির মাধ্যমেই হাতেখড়ি গোবিন্দের।
রোহন ভেবেছিলেন যে, গোবিন্দ যে হেতু নতুন অভিনেতা, তাই দর্শক তাঁর দিকে বেশি খেয়াল করবেন না। এমনকি, গোবিন্দের অভিনয় দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন ছিল রোহনের মনে। ‘লভ ৮৬’ ছবির শুটিং চলাকালীন সেটের সকলে রোহনের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতেন। সব মিলিয়ে রোহন এক রকম ধরেই নিয়েছিলেন যে, তাঁর কেরিয়ার এই ছবি মুক্তির পর পুরোদমে এগোবে।
কিন্তু ‘লভ ৮৬’ মুক্তি পাওয়ার পর সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র ধরা পড়ে। গোবিন্দের অভিনয় নিয়ে দর্শক প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এমনকি, বলিপাড়াতেও গোবিন্দকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। রোহন যেন হঠাৎ করে সকলের কাছে অদৃশ্য হয়ে যান।
গোবিন্দের কাছে একের পর এক ছবির প্রস্তাব আসতে থাকে। কিন্তু রোহনের হাতে তখন কোনও কাজ ছিল না। হাতেগোনা যে কয়েকটি ছবি তাঁর হাতে ছিল, সেই ছবিগুলির কাজ কখনও শুরুই হয়নি। এ ভাবে তাঁরে কেরিয়ার পতনের জন্য রোহন খানিকটা হলেও গোবিন্দকে দায়ী করেছিলেন।
১৯৮৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল সুশীল মালিক পরিচালিত ‘ইমানদার’ ছবিটি। মুখ্য চরিত্রে ফারাহ এবং সঞ্জয় দত্তের পাশাপাশি এই ছবিতে দেখা গিয়েছিল রোহনকেও। কিন্তু এই ছবিও হিট করেনি। তাই অভিনয়জগৎ থেকে সরে যান তিনি।
মহেন্দ্র দেশ-বিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করতে যেতেন। ৯ বছর বয়স থেকেই যাত্রাগুলিতে বাবার সঙ্গী হতেন রোহন। অভিনয় থেকে সরে যাওয়ার পর সঙ্গীত নিয়েই ব্যস্ত থাকতে শুরু করলেন তিনি। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মঞ্চে গান গাওয়াও শুরু করেন তিনি।
শেষ পর্যন্ত বাবার মতো সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে নিজের কেরিয়ার গড়ে তোলেন রোহন। কিন্তু যে পেশা নিয়ে তাঁর এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তাতেই সারা জীবনের মতো দাঁড়ি পড়ে যায়। মাত্র তিনটি ছবিতে অভিনয় করার পর বলিপাড়া থেকে হারিয়ে যান এক কপূর-পুত্র।