গত শনিবার রাতে মুম্বইয়ের বান্দ্রা এলাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে খুন করা হয় অজিত পওয়ারপন্থী এনসিপি গোষ্ঠীর নেতা তথা মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মন্ত্রী বাবা সিদ্দিকিকে। সেই হত্যাকাণ্ডে ফের প্রকাশ্যে এসেছে গ্যাংস্টার লরেন্স বিশ্নোইয়ের নাম। খুনের দায় স্বীকার করে সমাজমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছে কুখ্যাত ওই দুষ্কৃতীর দল।
পঞ্জাবি গায়ক সিধু মুসে ওয়ালা হত্যা থেকে শুরু করে বলি অভিনেতা সলমন খানকে হত্যার হুমকি— বিগত কয়েক বছরে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে নাম জড়িয়েছে বিশ্নোই গ্যাংয়ের।
দীর্ঘ দিন ধরে জেলবন্দি রয়েছেন বিশ্নোই। গুজরাতের সাবরমতি জেলে বন্দি রয়েছেন তিনি। তার আগে দীর্ঘ সময় তিহাড় জেলে বন্দি ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, কী ভাবে জেল থেকে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন লরেন্স? কী ভাবেই বা বিদেশের মাটিতে বসে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কাছে ফোন করে টাকা চাইছেন তাঁর দলের সদস্যেরা?
হুমকি ফোন বা তোলাবাজি সংক্রান্ত সেই সব তদন্তের কিনারা করতে গিয়ে এক প্রকার হিমশিম খেতে হচ্ছে তদন্তকারীদের। আর সেই আবহেই ভেসে আসছে নতুন এক অপরাধ পদ্ধতির নাম। ‘ডাব্বা কলিং’।
গত কয়েক মাস ধরে দিল্লি, পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং রাজস্থানের মতো রাজ্যের পুলিশ এই ‘ডাব্বা কলিং’ অপরাধের সমাধানের চেষ্টা করে চলেছে।
‘ডাব্বা কলিং’ পদ্ধতি ব্যবহার করে ব্যবসায়ীদের থেকে টাকা তোলে মূলত বিদেশে বসবাসকারী গ্যাংস্টারেরা। ‘ডাব্বা কলিং’ পদ্ধতি ব্যবহার করে ব্যবসায়ীদের থেকে টাকা তোলে মূলত বিদেশে বা জেলে বসবাসকারী গ্যাংস্টারেরা।
এর মধ্যে রয়েছে লরেন্স, গোল্ডি ব্রার (পঞ্জাবি গায়ক সিধু মুসে ওয়ালা হত্যাকাণ্ডের মূলচক্রী মনে করা হয় যাঁকে), রোহিত গোদারা এবং আনমোল বিশ্নোইয়ের মতো কুখ্যাত গ্যাংস্টারের নাম।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যাঁদের থেকে টাকা চেয়ে হুমকি দেওয়া হয়, তাঁদের বেশির ভাগই নির্মাতা, ঠিকাদার, বড় ব্যবসায়ী, গাড়ি ব্যবসায়ী, ক্লাব বা হোটেলের মালিক, অবৈধ কল সেন্টারের মালিক এবং স্থানীয় রাজনীতিবিদ। কখনও কখনও হাওয়ালার সঙ্গে যুক্তদেরও হুমকি ফোন করে টাকা চাওয়া হয়।
কিন্তু কী এই ডাব্বা কলিং? প্রতিবেদন অনুযায়ী, লরেন্সের মতো গ্যাংস্টারেরা প্রথমে ঠিক করে যে কোন বিত্তশালীর থেকে টাকা চাওয়া হবে। এর পর টাকা তুলতে দেশে থাকা তাদের দালালদের কাজে লাগায় ওই অপরাধীরা। গ্যাংস্টারের স্থানীয় সহযোগীরা প্রথমে মোবাইলের ইন্টারনেট ব্যবহার করে ‘টার্গেট’কে ফোন করেন। এর পর অন্য একটি মোবাইল থেকে ফোন করা হয় বিদেশে বা জেলে বসে থাকা বস্কে।
দু’টি ফোনই স্পিকারে দিয়ে পাশাপাশি রেখে দেওয়া হয়। এর পর গ্যাংস্টার বিত্তশালী টার্গেটকে ‘প্রোটেকশন মানি’ বা অন্য কোনও সাঙ্কেতিক শব্দ ব্যবহার করে টাকা দেওয়ার কথা বলে। কিন্তু দু’জনের মধ্যে সরাসরি কথা হয় না।
তদন্তকারীরা যখন অভিযোগ পেয়ে তদন্তে নামেন তখনই পুরো বিষয়টি নিয়ে হিমশিম খেতে হয় তাঁদের। যে হেতু গ্যাংস্টারের মোবাইল থেকে সরাসরি ফোন আসে না, তাই তদন্তকারীদের হাতেও প্রমাণ থাকে না। তদন্তকারীদের এ ভাবে সমস্যায় ফেলে ঘটিয়ে ফেলা অপরাধের নামই ‘ডাব্বা কলিং’। দু’টি আলাদা মোবাইল ব্যবহার করে বিশেষ পদ্ধতিতে এই হুমকি ফোনগুলি করা হয় বলেই এ রকম নাম।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যখন এই হুমকি ফোনগুলি করা হয় তখন গ্যাংস্টার এবং তার সহযোগীরা আলাদা আলাদা জায়গায় থাকেন। ‘টার্গেট’ এবং গ্যাংস্টারের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করেন সহযোগীরা। বিভিন্ন দেশ থেকে ‘ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল (ভিওআইপি)’, অর্থাৎ ইন্টারনেটের মাধ্যমে ওই ফোন করে টাকা চায় কুখ্যাত অপরাধীরা।
এই ধরনের ফোনগুলি বেশির ভাগই ‘ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন)’ ব্যবহার করে করা হয়। ভিপিএন এমন একটি ইন্টারনেট ব্যবস্থা যা এক জন ব্যক্তির অনলাইন পরিচয় গোপন রাখে৷ ফলে কোথা থেকে সেই সব ফোন আসে এবং কারা ফোন করে, তা খুঁজে পাওয়া তদন্তকারীদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
যদি তদন্তকারীরা কখনও ফোন নম্বর ট্র্যাক করতে সক্ষমও হন, তা হলেও গ্যাংস্টারের সহযোগীদের কাছে পৌঁছন তাঁরা। মূল অপরাধী থেকে যান অধরাই। পাশাপাশি, ডাব্বা কলিংয়ের এই চক্র এমন সব অ্যাপ ব্যবহার করে যা ‘এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন’ বা অতিরিক্ত সুরক্ষা প্রদান করে। এর ফলে অপরাধীদের তথ্য সুরক্ষিত থাকে।
তদন্তকারীরা যখন গ্যাংস্টারের অবস্থান জানতে সংশ্লিষ্ট অ্যাপ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অ্যাপের তরফে গ্রাহকের নিরাপত্তার কারণে সেই তথ্য দেওয়া হয় না। আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে কখনও পুলিশ যদি অভিযুক্ত গ্যাংস্টারের ডেরার খোঁজ পেয়েও যায়, তা হলেও তত দিনে ওই গ্যাংস্টার অন্য কোথাও পালিয়ে গিয়েছেন। যদি কোনও ভারতীয় আইপি ব্যবহার করে ফোন করাও হয়, তা হলে পরে জানা যায় যে, সিমটি জাল নথি দিয়ে কেনা হয়েছে।
বছরের পর বছর ধরে তোলাবাজি, চোরাকারবারি এবং চুক্তি হত্যা-সহ বিস্তৃত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে বিশ্নোই গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে। জেলে থাকা সত্ত্বেও বিশ্নোই তাঁর অপরাধের সাম্রাজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন বলে দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।
২০২২ সালের ২৯ মে পঞ্জাবের মানসাতে জনপ্রিয় র্যাপার তথা কংগ্রেস নেতা সিধু মুসে ওয়ালাকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় দুষ্কৃতীর দল। ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও নাম জড়ায় লরেন্স বিশ্নোইয়ের। যদিও খুনের সময় তিহাড় জেলে বন্দি ছিলেন এই গ্যাংস্টার।
মুসে ওয়ালা খুনের পর বিশ্নোইকে হেফাজতে নিয়ে নতুন করে তদন্ত শুরু করে দিল্লি পুলিশ। জেলে বসেই কী ভাবে তাঁর ইশারায় খুন করা হল, তা নিয়ে চিন্তা বেড়েছে তদন্তকারীদের। জেল থেকেই বিশ্নোই দিব্যি অপরাধের নেটওয়ার্ক চালিয়ে যাচ্ছেন বলে মনে করা হয়। যা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন তিহাড় জেল কর্তৃপক্ষ।
গত বছরের ৫ ডিসেম্বর জয়পুরে নিজের বাড়িতে গুলিতে খুন হন দক্ষিণপন্থী নেতা সুখদেব সিংহ গোগামেডি। ওই বছরের নভেম্বরে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে পঞ্জাবি গায়ক গিপ্পি গ্রেওয়ালের বাড়িতে গুলি চলে। দু’টি ঘটনার নেপথ্যেই বিশ্নোই গ্যাংয়ের হাত রয়েছে বলে জানিয়েছিল পুলিশ।
২০১৮ সালে সম্পথ নেহরা নামের এক সুপারি কিলারকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই ব্যক্তি সলমনকে খুনের জন্য তাঁর বাড়ি রেকি করছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। বিশ্নোইয়ের নির্দেশেই নেহরা ওখানে গিয়েছিলেন বলে দাবি করেন তদন্তকারীরা। ২০২৩ সালের ১৪ এপ্রিল সলমনের বান্দ্রার বাড়ির সামনে বাইকে করে এসে গুলি চালায় দুই দুষ্কৃতী। তবে তাতে অবশ্য অভিনেতার কোনও ক্ষতি হয়নি। ওই ঘটনার সঙ্গেও বিশ্নোই গ্যাং জড়িত ছিল বলে সন্দেহ পুলিশের।
এ বছরের সেপ্টেম্বরে ভ্যাঙ্কুভারে আর এক পঞ্জাবি গায়ক এপি ধিঁলোর বাড়ির সামনে গুলি চলে। যার দায় স্বীকার করেন বিশ্নোই গ্যাংয়ের সদস্য রোহিত গোদারা। সমাজমাধ্যমে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘ধিঁলোর ‘ওল্ড মানি’ গানের অ্যালবামে সলমনকে দেখা গিয়েছে। আর তাই তাঁর নাম তালিকায় চলে এসেছিল।’’
কেন বার বার সলমন খানকে খুনের হুমকি দিচ্ছে বিশ্নোই গ্যাং? এর নেপথ্যে রয়েছে কৃষ্ণসার হরিণ হত্যা। ১৯৯৮ সালে রাজস্থানের জোধপুরে ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’ ছবির শুটিং করতে যান সলমন খান। সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে কৃষ্ণসার হরিণ শিকারের অভিযোগ ওঠে।
এই ঘটনায় বিশ্নোই সম্প্রদায়ের ভাবাবেগে আঘাত লাগে। কারণ কৃষ্ণসার হরিণকে অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করেন তাঁরা। ২০১৮ সালে গ্রেফতারির পর আদালতে দাঁড়িয়ে লরেন্স বিশ্নোই হুমকির সুরে বলেছিলেন, ‘‘জোধপুরে আমরা সলমন খানকে হত্যা করব। আমরা ব্যবস্থা নিলেই সবাই জানতে পারবে। আমি এখনও পর্যন্ত কিছুই করিনি। ওরা বিনা কারণে আমার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ এনেছে।’’
বিশ্নোই গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্মম ভাবে নির্মূল করার অভিযোগ ওঠার পর সমগ্র উত্তর ভারতে ত্রাসে পরিণত হয়েছে সেই গ্যাং। বিশেষ করে পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং রাজস্থানের মতো রাজ্যে সেই গ্যাংয়ের প্রভাব ভয়ঙ্কর।
উল্লেখ্য, গ্যাংস্টার বিশ্নোই এবং গোল্ডি ব্রারের যুগলবন্দিকে ইতিমধ্যেই ১৯৯৩ সালের মুম্বই বিস্ফোরণের মাস্টারমাইন্ড দাউদ ইব্রাহিম কাসকরের তৈরি ‘ডি কোম্পানি’-র সঙ্গে তুলনা করেছেন এনআইএর গোয়েন্দারা। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে যাঁদের নামে কাঁপত গোটা মুম্বই-সহ মহারাষ্ট্রের ফিল্মি দুনিয়া থেকে নামী শিল্পপতিরা।