আধুনিক কম্পিউটার ব্যবস্থায় তথ্য বা ডেটা সংরক্ষণের প্রযুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল মাধ্যমে গোটা প্রক্রিয়া নির্ভর করে ডেটা সংরক্ষণের উপরেই।
এই ডেটা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কার্যত বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল ১৯৯৫ সালে। নেপথ্যে এক ডাচ প্রযুক্তিবিদ। যাঁর নাম রোমকে জ্যঁ বার্নহার্ড স্লুট। নেদারল্যান্ডসের গ্রনিনজেন প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্লুট। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন ছোট।
স্লুটের বাবা পেশায় স্কুলশিক্ষক ছিলেন। একটি স্কুলে প্রধানশিক্ষকের দায়িত্ব সামলাতেন স্লুটের বাবা। কিন্তু বেশি দিন পিতৃস্নেহ পাননি স্লুট। তাঁর জন্মের পর পরই বাবা মারা যান।
একটি ডাচ টেকনিক্যাল স্কুলে কিছু দিন পড়াশোনা করেছিলেন স্লুট। কিন্তু মাঝপথে স্কুল ছেড়ে দেন তিনি। স্কুল ছেড়ে একটি রেডিয়ো স্টেশনে চাকরি নেন। এক সময় ফিলিপ্স ইলেকট্রনিক্স সংস্থায় কাজ করতেন স্লুট। দেড় বছর ফিলিপ্সে চাকরি করার পর একটি অডিয়ো-ভিডিয়ো স্টোরে চাকরি নিয়ে চলে যান। এরও কয়েক বছর পর অন্য শহরে গিয়ে স্লুট নিজস্ব একটি সংস্থা চালু করেছিলেন, যেখানে টেলিভিশন এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি সারাই করা হত। এখান থেকেই বিপ্লবের শুরু।
১৯৮৪ সালের পর থেকে কম্পিউটার প্রযুক্তিতে মনোনিবেশ করেন স্লুট। ফিলিপস পি ২০০০, কমোডোর ৬৪, আইবিএম পিসি এক্সটি, এটি-র মতো কম্পিউটার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতেন তিনি। তা করতে করতেই দেশব্যাপী মেরামত পরিষেবার একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে ফেলেছিলেন স্লুট। তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘রেপাবেস’। এতে সমস্ত মেরামতির কাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রাখা হত। সেই সূত্রেই তথ্য সংরক্ষণের একটি বিকল্প কৌশল আবিষ্কার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন তিনি।
তথ্য বা ডেটা সংরক্ষণের প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে বেরিয়ে নতুন আবিষ্কারের কথা ভেবেছিলেন স্লুট। যাতে তুলনামূলক কম জায়গা লাগে। ১৯৯৫ সালে স্লুট দাবি করেন, তিনি একটি ডেটা এনকোডিং কৌশল তৈরি করেছেন, যার সাহায্যে আস্ত একটি সিনেমা মাত্র ৮ কিলোবাইটের মধ্যে সংগ্রহ করা যাবে। এর নাম দেওয়া হয় স্লুট ডিজিটাল কোডিং সিস্টেম (এসডিসিএস)।
কী ভাবে কাজ করে এই এসডিসিএস? বলা হয়, এই ব্যবস্থাপনা কোনও সিনেমাকে সিনেমা হিসাবে গণ্য করে না। তার কাছে সমস্তটাই সঙ্কেত। সিনেমাটি তৈরি হয়েছে যে শব্দ এবং বর্ণ দিয়ে, সেগুলিকে স্বতন্ত্র সঙ্কেত হিসাবে দেখা হয়।
যখন এসডিসিএস-এ কোনও নম্বর দেওয়া হয়, সেই নম্বর ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট বর্ণ এবং শব্দ টেনে নেয় সিস্টেম। তা দিয়ে তৈরি হয় সমগ্র সিনেমাটি। ফলে যে কোনও রকমের সিনেমা এই পদ্ধতিতে তৈরি এবং সংগ্রহ করা যায়।
প্রতি সিনেমার ক্ষেত্রে একটি করে সংখ্যা নির্দিষ্ট করা থাকে এসডিসিএস-এ, যা অনন্য। ২টি সিনেমায় এক সংখ্যা কখনও ব্যবহৃত হতে পারে না।
স্লুটের এই আবিষ্কার প্রযুক্তির দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দিয়েছিল। তাঁর এক সহকর্মী জস ভ্যান রসাম এসডিসিএস প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত করার জন্য এতে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৯৬ সালে তাঁরা ৬ বছরের স্বত্ব লাভ করেন। তাতে আবিষ্কর্তা হিসাবে স্লুট এবং স্বত্বাধিকারী হিসাবে রসামের নাম ছিল।
বিনিয়োগকারীরা স্লুটের এই এনকোডিং সিস্টেমে লাভের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন। অনেকেই তা কেনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। ফিলিপ্সের প্রাক্তন কর্তা রোয়েল পিপার স্লুট আবিষ্কৃত এই ব্যবস্থাপনার কথা জানতে পারেন। ১৯৯৯ সালের মে মাসে ফিলিপ্স ত্যাগ করে স্লুটের সংস্থায় সিইও হিসাবে যোগদান করেছিলেন তিনি।
পিপারের সঙ্গে স্লুটের চুক্তির কথাবার্তা হয়েছিল। পিপার তাঁর এনকোডিং সিস্টেম বাস্তবায়িত করার জন্য বিনিয়োগ করবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের ঠিক ১ দিন আগে (১১ জুলাই, ১৯৯৯) রহস্যজনক ভাবে মৃত্যু হয় স্লুটের।
বাড়ির বাগানে তাঁর দেহ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। আপাত ভাবে এই মৃত্যুর কারণ হিসাবে দেখানো হয় হৃদ্রোগকে। তবে স্লুটের পরিবার ময়নাতদন্তে সম্মতি দিয়েছিল। অভিযোগ, সেই ময়নাতদন্ত করা হয়নি।
স্লুটের আকস্মিক মৃত্যুর পর তাঁর আবিষ্কৃত কাজ বাস্তবায়নের জন্য হাত মিলিয়েছিলেন পিপার এবং পার্কিন্স। একটি বিশেষ এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফ্লপিডিস্কে সংরক্ষিত ছিল। স্লুটের মৃত্যুর পর তা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও নির্দিষ্ট সেই ফ্লপিডিস্ক মেলেনি। অধরাই থেকে গিয়েছে এসডিসিএস। ৮ কেবিতে আস্ত সিনেমা দেখার স্বপ্ন আর পূরণ করা যায়নি। ডাচ প্রযুক্তিবিদ স্লুটের মৃত্যুও থেকে গিয়েছে ধোঁয়াশার চাদরের আড়ালে।