‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পের বিরোধিতায় দেশের নানা প্রান্তে আন্দোলনের আগুন জ্বলতে থাকলেও প্রায় প্রতি দিনই কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি পাচ্ছেন হবু ‘অগ্নিবীর’রা। দেশের সেনাবাহিনীতে চার বছরের চুক্তিভিত্তিক কাজের পর রয়েছে অঢেল কাজের হাতছানিও। আজ পর্যন্ত তাঁদের কী কী প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে?
হবু ‘অগ্নিবীরদের’ জন্য প্রতিশ্রুতির বহর ক্রমশই দীর্ঘ হচ্ছে। তবে সে সবের তালিকা দেওয়ার আগে আরও এক বার নজর রাখা যাক ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পে।
চলতি মাসের ১৪ জুন, মঙ্গলবার ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পের ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। নরেন্দ্র মোদী সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, দেশের সশস্ত্র বাহিনীর তিন বিভাগ অর্থাৎ স্থল, নৌ এবং বায়ুসেনায় চার বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করা হবে। সাড়ে ১৭-২১ বছরের তরুণ-তরুণীরা এতে যোগ দিতে পারবেন। যদিও পরে এই বয়ঃসীমা বাড়িয়ে ২৩ বছর পর্যন্ত করা হয়েছে। ওই সেনানির পরিচয় হবে ‘অগ্নিবীর’ হিসাবে।
‘অগ্নিবীর’-রা বেতন হিসাবে প্রতি মাসে ৩০-৪৫ হাজার টাকা হাতে পাবেন বলেও জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। চার বছরের চুক্তি শেষে ২৫ শতাংশ ‘অগ্নিবীর’কে সেনায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বাকিরা অবসরের সময় এক লপ্তে ১১-১২ লক্ষ টাকা হাতে পাবেন। এই প্রকল্পে যোগদানকারীরা পেনশনের সুবিধা পাবেন না।
কেন্দ্রীয় সরকারের এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে আন্দোলনে নেমেছেন বহু তরুণ-তরুণী। তাঁদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে মোদী সরকারের বিরোধী দলগুলিও। রাজনাথ একে ‘ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত’ বলে তকমা দিলেও কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি রাহুল গাঁধীর দাবি, যুবসমাজের কাছে ক্ষমা চেয়ে একে প্রত্যাহার করতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে।
রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিবাদ ছাড়াও আন্দোলনে নেমেছে যুবসমাজের একাংশ। এই আন্দোলনের আঁচ লেগেছে বাংলা, বিহার, তেলঙ্গানা, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র-সহ দেশের বহু রাজ্যে। ভাঙচুর, ট্রেন ও পথ অবরোধ, অগ্নিসংযোগ— হিংসাত্মক আন্দোলনের পথে হেঁটেছেন বিক্ষোভকারীরা।
আন্দোলনের আঁচ তীব্র হলেও ‘অগ্নিবীর’দের কেন্দ্রের পাশাপাশি নানা রাজ্য সরকার এই প্রকল্পের অধীনে কাজের পর কর্মসংস্থানের ভরসা দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিশ্রুতি, ‘অগ্নিবীর’দের জন্য স্বরাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে ১০ শতাংশ পদ সংরক্ষিত রাখা হবে।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ঘোষণা, সেন্ট্রাল আর্মড পুলিশ ফোর্সেস (সিএপিএফ) এবং আসাম রাইফেলসে ‘অগ্নিবীর’দের ১০ শতাংশ আসন সংরক্ষিত থাকবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে আরও প্রতিশ্রুতি, সিএপিএফ এবং আসাম রাইফেলসে যোগদানের জন্য এই প্রকল্পের বয়ঃসীমার থেকে আরও তিন বছরের ছাড় পাবেন ‘অগ্নিবীর’রা। প্রথম ব্যাচের ‘অগ্নিবীর’দের জন্য তা বাড়িয়ে পাঁচ বছর পর্যন্ত করা হয়েছে।
সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ পাণ্ডে, নৌসেনা প্রধান অ্যাডমিরাল আর হরি কুমার এবং বায়ুসেনার প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল ভিআর চৌধরির সঙ্গে বৈঠকের পর শনিবার রাজনাথ জানিয়েছেন, ‘অগ্নিবীর’দের জন্য ভারতীয় উপকূলরক্ষী বাহিনীতে ১০ শতাংশ চাকরি সংরক্ষণ করা হবে। একই কথা প্রযোজ্য ১৬টি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায়।
অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রকের প্রতিশ্রুতি, কারিগরি ক্ষমতাসম্পন্ন ‘অগ্নিবীর’দের বিভিন্ন কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা শুরু করা হবে।
বন্দর, জাহাজ এবং জলপথ মন্ত্রকের ঘোষণা, ‘অগ্নিবীর’দের মার্চেন্ট নেভি-সহ ছ’টি পরিষেবামূলক শাখায় যাতে অন্তর্ভুক্তির পথ মসৃণ হয়, তা দেখা হবে।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরদীপ সিংহ পুরী জানিয়েছেন, আবাসন এবং পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের অধীনে যে সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রয়েছে, সেগুলিতে যাতে অবসরপ্রাপ্ত ‘অগ্নিবীর’দের কাজে লাগানো যায়, তার চিন্তা-ভাবনা চলছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ওপেন স্কুলিং-এর ঘোষণা, এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ‘অগ্নিবীর’দের দশম ও দ্বাদশ পাশের শংসাপত্র পেতে বিশেষ কোর্সের ব্যবস্থা করবে। এই শংসাপত্র গোটা দেশে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে।
কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের সিদ্ধান্ত, ‘অগ্নিবীর’দের জন্য স্নাতকস্তরে তিন বছরের একটি বিশেষ কারিগরি শিক্ষামূলক কোর্স চালু করবে।
কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রক ছাড়াও বিজেপি-শাসিত রাজ্য সরকারগুলিও নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ জানিয়েছেন, রাজ্যে পুলিশ-সহ সেই সম্পর্কিত কাজে ‘অগ্নিবীর’রা অগ্রাধিকার পাবেন।
হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টরের ঘোষণা, ‘অগ্নিবীর’দের চাকরিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
মধ্যপ্রদেশ সরকারের ঘোষণা, সেনায় কাজের পর রাজ্য পুলিশে ‘অগ্নিবীর’দের আগে কাজে নেওয়ার কথা ভাবা হবে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার ঘোষণা, যাঁরা এই প্রকল্পে চার বছর কাটাবেন, তাঁরা রাজ্য পুলিশের কাজে অগ্রাধিকার পাবেন। একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কর্নাটক সরকার।
বিজেপিশাসিত সরকার ছাড়াও বেশ কয়েক জন শিল্পপতি এই প্রকল্পকে সমর্থন জানিয়েছেন। সোমবার আনন্দ মাহিন্দ্রার ঘোষণা, যোগ্য এবং প্রশিক্ষিত যুবক-যুবতীদের (অগ্নিবীরদের) মাহিন্দ্রা গোষ্ঠীতে স্বাগত।
প্রায় একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন শিল্পপতি হর্ষ গোয়েন্কা। সোমবার তাঁর টুইট, ‘আরপিজি গোষ্ঠীও অগ্নিবীরদের নিয়োগ করার সুযোগকে স্বাগত জানায়। আশা করি অন্য কর্পোরেট সংস্থাগুলিও এই শপথ নেবে এবং আমাদের যুবসমাজের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে।’