বড়দিনেই মুক্তি পেতে চলেছে মিঠুনের ‘কাবুলিওয়ালা’। গত বছরেও বড়দিনে মুক্তি পেয়েছিল তাঁর ছবি। সঙ্গে রয়েছে আরও ছবি। গত বছরের সঙ্গী দেব এই বারে রয়েছেন বিপক্ষের আসনে। তবে সেই সব ভুলে এগোতে চান দু’জনে। সঙ্গে সুমন ঘোষের ‘কাবুলিওয়ালা’ মিঠুন চক্রবর্তীর মুখোমুখি আনন্দবাজার অনলাইন। শুনলেন পৃথা বিশ্বাস। কী বললেন তিনি?
‘প্রজাপতি’র বলেছিলেন, চিত্রনাট্যে কোনও চমক না থাকলে এখন আর তিনি রাজি হন না…। সে বিষয়ে প্রশ্ন করতেই তাঁর উত্তর, ”৪০০টা ছবি করা হয়ে গিয়েছে। গল্পে একটু কাতুকুতু না থাকলে এখন আর অভিনয় করতে ভাল লাগে না। একঘেয়েমি চলে এসেছে। তবে শেষ যে ক’টা ছবি করেছি সব আলাদা স্বাদের। ‘কাশ্মীর ফাইল্স’, ‘দ্য তাসকেন্ট ফাইল্স’, ‘রিওয়াজ়’, ‘বেহিসাব’, ‘প্রজাপতি’— সবই আলাদা। কিন্তু ‘কাবুলিওয়ালা’ তো সে অর্থে আলাদা নয়। তা হলে কেন প্রশ্নে মিথুন জানান, “৩০-এর বেশি যাঁদের বয়স, তাঁরা হয়তো সকলেই পড়েছেন। কিন্তু ২০ থেকে ২৫-এর মধ্যে যাঁরা, তাঁদের নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। জানি না কত জন পড়েছেন। আমি তাঁদের অনুরোধ করব এক বার দেখার। কারণ, এটা এমন একটা গল্প, যেখানে ধর্ম নির্বিশেষে আবেগ রয়েছে। সুমনকে (ঘোষ, পরিচালক) আমার কুর্নিশ যে, এই সময় দাঁড়িয়ে ও এই গল্পটা ভেবেছে। আমি মনে করি, সত্যিকারের অনুভূতির কাছে কোনও জাতি-ধর্ম বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।“
কমবয়সিদের কথা মাথায় রেখে ছবি। কিন্তু তাঁদের কাছে রবীন্দ্রনাথ এখন কতটা প্রাসঙ্গিক? মিঠুন বলেন, “আমার তো মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ চিরকাল প্রত্যেকের কাছে প্রাসঙ্গিক। কারণ, রবীন্দ্রনাথ ধর্ম নিয়ে ভেদাভেদ করতে শেখান না। আমিও সে মতাদর্শেই বিশ্বাস করি। তবে কে কতটা মনোযোগ দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করবেন, তা তর্কসাপেক্ষ। বাবা-মায়েদের আগামী প্রজন্মকে শেখানো উচিত। আমি যেমন আমার ছেলেমেয়েদের শেখাই।“
‘কাবুলিওয়ালা’-এ রহমত যে মানুষদের প্রতিনিধি, বর্তমানে ভারতীয়দের যে ভারতের স্বপ্ন দেখানো হয়, সেখানে কি সেই শ্রেণির মানুষরা ব্রাত্য? মিঠুন বলেন, “এটাই সুমনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। পরিচালক এমন একটা গল্প বলছে, যা দেখে বর্তমান সময় একদমই হয়তো অসম্ভব মনে হতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি, সেটা সম্ভব। ভালবাসা সত্যি হলে দুটো ধর্মের যে সব বাধা ভেঙে যেতে পারে, ‘কাবুলিওয়ালা’ তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। আজকের দিনে সবচেয়ে বড় সত্য হবে ‘কাবুলিওয়ালা’। তাই আমার জন্য দেখার দরকার নেই। কিন্তু নিজে সচেতন হওয়ার জন্য ছবিটা দেখা খুব প্রয়োজন। কারণ, এই ছবিটা এই সময়ে খুব প্রাসঙ্গিক।“ এখন তো সব রাজ্যেই বহিরাগত নিয়ে নানা রকম আলোচনা হয়। সেখানে আফগানিস্তান থেকে আসা এক জন ব্যবসায়ীকে মানুষ বাস্তবে মেনে নেবেন জিজ্ঞেস করাতে? মিঠুন হেসে বলেন, “এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। যেখানে স্বার্থ জড়িয়ে থাকে, সেখানে এই ধরনের আলোচনা হবেই। যে দিন স্বার্থ ফুরিয়ে যাবে, তখন এই ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নগুলো তোলা সম্ভব। বাইরে থেকে কেউ এসে যদি আপনাকে এক কোটি টাকা দেয়, আপনি ঠিক গলা জড়িয়ে আত্মীয়তা তৈরি করবেন। এক বছর নিজের বাড়িতে রেখে খাইয়েদাইয়ে সেই আত্মীয়তা পালন করবেন। কিন্তু কোনও স্বার্থ না থাকলেই সে ‘বহিরাগত’ হয়ে যাবে, তাই না”
শেষে কী ভাবে রাজি হলেন তিনি? জানালেন নিজেই, “সুমনের রবীন্দ্রযোগ খুব বেশি। কারণ, ও ঝুঁকি নিতে জানে। নোবেল চুরি হয়েছিল। কিন্তু ক’জন তা নিয়ে ছবি করার কথা ভেবেছে! কিন্তু ও সেই চ্যালেঞ্জটা নিয়ে খুব বিশ্বাসযোগ্য ভাবে কাজটা করতে পেরেছিল। গত পাঁচ বছর ধরে ও ভাবছিল, কী করে দাদাকে বলি যে তোমায় ছাড়া ‘কাবুলিওয়ালা’ করব না। এই সব ভেবে দেড় বছর আগে ও সাহস করে মুম্বই এসে আমায় এক দিন বলল, ‘দাদা একটা কথা বলে চলে যাব’। আমি তখন ‘হুনারবাজ়’-এর শুটিং করছি। ওর প্রস্তাব শুনে আমি বললাম, ‘তুই কি পাগল হয়ে গিয়েছিস! দু’-দু’জন মহারথী (বলরাজ সাহনি এবং ছবি বিশ্বাস) যে চরিত্র করেছেন, আমি তা করব! সরি, তুই চলে যা। পরে কথা হবে’। তার পর ও হতাশ হয়ে চলে গেল (হাসি)। আবার ফোন করে এক দিন বলল, ‘তুমি কোথায়? আমি একটা অন্য বিষয় ভেবেছি’। সব মিথ্যা কথা! সেই ঘুরেফিরে ও বার বার ‘কাবুলিওয়ালা’র কথাই বলে। এই সব কথা হতে হতে আমি জানতে চাইলাম, প্রযোজক কে। কারণ, সাহসী প্রযোজক না হলে এই ছবি হবে না।“
সব ছবির ক্ষেত্রেই কি আগে প্রযোজক দেখে নেন মিঠুন? “না, তেমন নয়। এ ক্ষেত্রে দেখেছিলাম। কারণ, ১৯৬৫ সালে এমন ছবি করার সাহস প্রযোজকেরা সহজেই দেখাতে পারতেন। এখন বাংলা সিনেমার সেই সাহস কম। কোনও ছবির উপর প্রযোজকের আস্থা না থাকলে সেই ছবি করে লাভ কী!” কী ভাবে নিয়েছিলেন ‘কাবুলিওয়ালা’ চরিত্রের প্রস্তুতি? মিঠুন জানান, “আমার জীবনে যে ক’টা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আমি করেছি, বাস্তবে কাউকে না কাউকে পেয়ে গিয়েছিলাম যাকে দেখে আমি অনুপ্রাণিত হতে পারি। বার বার আমার সঙ্গে এমন হয়েছে। কোথাও না কোথাও আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং পর্যবেক্ষণ কাজে লেগে গিয়েছে। ‘কাবুলিওয়ালা’র ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আফগানিস্তানের এক পাঠান আমার বন্ধু ছিল— জামাল। যে আমায় রান্না করা শিখিয়েছে। ওর হাঁপানির রোগ ছিল। ১৯৮৩-৮৪ সালের কথা হবে। আমি যেখানেই শুটিং করতাম, ও ঠিক ওর ছোট্ট একটা ডাব্বা নিয়ে আমার জন্য কিছু না কিছু রান্না করে নিয়ে যেত। শুটিংয়ে বলা থাকত সব জায়গায়, যাতে ওকে ভিআইপি ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়। ও ‘মিঠুন’ বলতে পারত না। বলত, ‘মঠন’। ও কিন্তু আমায় বরাবর বলত, ‘আমি আল্লাহকে বলেছি, তুই এক দিন নম্বর ওয়ান হবিই’। ও সত্যিই আমার পাশে ছিল। যখন আমি এক নম্বর হতে পেরেছিলাম, তখন ও দেশে ফিরে যায়। মেয়ের বিয়ে দেয়। আমি সে সময় ওকে কিছু আর্থিক সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ও কিছুতেই নেয়নি। ওর চরিত্র এতটাই দৃঢ় ছিল। যদি ও আজ বেঁচে থাকে, তা হলে এই ছবিটা আমি ওকে উৎসর্গ করতে চাই। আমি শুধু পরিচালককে ওর কথা বলার ধরনটা দেখিয়েছিলাম। সুমন বলল, ‘আমার এটাই চাই। আমার কাবুলিওয়ালা এ রকমই হবে’।“
মিঠুনের জীবনে তা হলে সত্যিই এক জন ‘কাবুলিওয়ালা’তো ছিলেন।কিন্তু ‘মিনি’র মতো বন্ধু রয়েছে কি? “আছে এক জন। প্রদ্যোতের (সহকারী) ছেলে। এখন ওর ছয় বছর বয়স। কিন্তু আমরা বেস্ট ফ্রেন্ডস বলতে পারেন। আমরা খাবার নিয়ে একে অপরে মাঝেমাঝেই আক্রমণ করি। বেজায় চিৎকার-চেঁচামেচি লেগে থাকে! ওর নাম অগ্রদূত হালদার (সহকারীকে ডেকে প্রিয় বন্ধুর ছবি দেখালেন)। তিন-চার বছর বয়স থেকেই ও আমার বন্ধু। আমরা আবার গালাগালিও দিয়ে থাকি (হাসি)। কিন্তু ও আমায় ছাড়া থাকতে পারে না। যেখানেই থাকি, আমাদের এক বার হলেও কথা হয়। ও আবার আমায় নাম ধরে ডাকে না। ‘জন সেনা’ (ডবলিউ ডবলিউ ই তারকা) বলে ডাকে। আমি নাকি জন সেনার মতো খুব শক্তিশালী।“
চার সন্তানের বাবা তিনি। অথচ কখনও সন্তানের জন্য কোনও প্রযোজকের কাছে যাননি কেন। মিঠুনের সটান জবাব, “ভাগ্য আগে থেকে লিখে রাখার ধারণাটা ভুল। আমার কাছে ডেস্টিনির আর এক নাম হল স্বপ্ন। যে স্বপ্ন দেখতে জানে, সে তার ভাগ্য নিজে লিখবে। তবে স্বপ্নটা ঠিক হতে হবে। আমি যদি এখন বাড়ি বসে ভাবি, আমি চার্লস রাজার ছেলে হব, সেটা তো সম্ভব নয়। তাই ঠিক স্বপ্ন দেখতে হবে। আমি জানতাম, আমায় হিরোর মতো দেখতে নয়। তাই ভিলেন হতেই গিয়েছিলাম। কেউ যদি বলে, ‘কেন আপনি তো ‘মৃগয়া’র নায়ক’? তাকে বলব, ভাল করে ভেবে দেখতে। আমি কি সত্যিই নায়ক? ওই ছবিটা একদমই গ্ল্যামারহীন। যে ছবিতে হিরোইজ়মের কোনও ছোঁয়া নেই, আমি সেই ছবির নায়ক ছিলাম। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে অন্য ভাবে তৈরি করা, গ্ল্যামারের দুনিয়ায় নিজেকে নিয়ে যাওয়া— সেটা আমার অন্য লড়াই ছিল। কিন্তু আমি বরাবরই আনকনভেনশনাল হিরো ছিলাম। সেটা আমার ডেস্টিনি। ছেলেমেয়েদের জন্য আমি কোনও দিন কোনও প্রযোজককে ফোন করিনি। আমি বলেছিলাম, নিজের লড়াই নিজে করো। যদি সঠিক স্বপ্ন দেখতে পারো, তা হলে ভাগ্যও তোমার সঙ্গ দেবে।“
সন্তানদের কোনও রকম প্রত্যাশা ছিল না? মিঠুনের উত্তর, “আমি কাউকে ফোন করলেও কী হবে বলুন? যদি কিছু হওয়ার না থাকে, তা হলে হাজার চেষ্টা করলেও হবে না। আমার মেয়ে বিদেশে নিজেই অভিনয় নিয়ে পড়াশোনা করছে। আমেরিকার দুটো জাতীয় স্তরের বিজ্ঞাপনে অভিনয় করেছে। ওর অভিনয় দেখে আল পাচিনো পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেছেন, ‘হু ইজ় দিস গার্ল’! ওর শো দেখতে গিয়েছিলেন। আমার মেজ ছেলেও নিজের মতো ছোট ছোট ছবি বানিয়ে বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে পাঠায়। মাত্র ১৯ বছরে ভ্যানকুভার ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ওর ছবি সেরার পুরস্কার জিতেছিল। আমি সবাইকে বলি, নিজেই নিজের কাজ করতে হবে। আমি বাবা হিসাবে পাশে থাকব। বেঁচে থাকার জন্য যা যা প্রয়োজন, সেই জোগান দেব।“
গত বছর ‘প্রজাপতি’ দারুণ হিট হয়েছিল। এ বছরও বড়দিনে ছবি আসছে। কী মনে হয়, আবার বক্স অফিসে একই রকম জাদু করা যাবে? উত্তরে বলেন এ আমি বলতে পারব না। প্রযোজকেরা বুঝে নেবেন। আবার সেই ডেস্টিনির কথাই চলে আসবে। তবে এই ছবির মধ্যে খুব সুন্দর একটা বার্তা রয়েছে। অনেক অনুভূতি জড়িয়ে রয়েছে। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে তো মনে হয় এই ছবিও বড়সড় হিট হবে। সবার ভাল লাগা উচিত। কারণ, সত্যিকারের ভালবাসা তো ধর্ম-জাতি-ভাষার ঊর্ধ্বে।
সাক্ষাৎকারের আগে প্রযোজনা সংস্থার তরফে বার বার বলা হয়েছে, আপনাকে রাজনীতি নিয়ে কোনও প্রশ্ন করা যাবে না। কেন বলুন তো? মিঠুন চক্রবর্তী কি তা হলে আর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকছেন না? সোজাসাপ্টা মিঠুন বলেন “রাজনীতি নিয়ে কোনও প্রশ্ন করবেন না। আমি দুটো জিনিস মেলাই না। যখন ছবি করি, রাজনীতি নিয়ে কথা বলি না। যখন রাজনীতি করি, তখন আর সিনেমা নিয়ে কথা বলি না। যখন বাড়িতে থাকি, তখন আমি শুধুই স্বামী আর বাবা। যখন অভিনয় করি, তখন আমি পরিচালক-প্রযোজকদের কথা ভাবি। যখন হোটেলে যাই, তখন শুধু হোটেলের কাজই দেখি। কোনও জিনিস মেলাই না। আমি নিজেকে সে ভাবে তৈরি করেছি। এক সময় শুধু একটাই কাজ মন দিয়ে করি। রাজনীতি নিয়ে ২০২৪-এর লোকসভার আগে কথা বলব।“