শচীন কর্তা বললেন, ‘আজ তোমার আর ঘি খাইয়া কাজ নাই’

রসিক মান্না দে-র মুখে শোনা যেত এমনই কত হাসির গল্প। লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীঅনেকের ধারণা মান্নাদা খব রাগী মানুষ ছিলেন। আসলে ওটা বাইরের আবরণ। ভিতরে ছিল এক অন্য মানুষ। ভীষণ ইমোশনাল, কথা বলতে বলতে দু’চোখ জলে ভরে আসে এবং অসম্ভব রসবোধ তাঁর। মান্নাদার সঙ্গে দুর্লভ আড্ডার সঙ্গী যারা হতে পেরেছেন, ধনী হয়েছেন অমূল্য অভিজ্ঞতার ধনে। মান্নাদা বলতেনও এত সুন্দর, অতি রামগরুড়ের ছানাও না হেসে পারত না। এমন কিছু কিছু গল্প বলি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৫ ০০:০১
Share:

অনেকের ধারণা মান্নাদা খব রাগী মানুষ ছিলেন। আসলে ওটা বাইরের আবরণ। ভিতরে ছিল এক অন্য মানুষ। ভীষণ ইমোশনাল, কথা বলতে বলতে দু’চোখ জলে ভরে আসে এবং অসম্ভব রসবোধ তাঁর। মান্নাদার সঙ্গে দুর্লভ আড্ডার সঙ্গী যারা হতে পেরেছেন, ধনী হয়েছেন অমূল্য অভিজ্ঞতার ধনে। মান্নাদা বলতেনও এত সুন্দর, অতি রামগরুড়ের ছানাও না হেসে পারত না। এমন কিছু কিছু গল্প বলি।

Advertisement

‘অপরাধী কৌন’ বলে একটা ছবিতে সলিল চৌধুরীর সুরে, মজরু সুলতানপুরির লেখায় একটি মজার গান গেয়েছিলেন : ফির ওহি দর্দ হ্যায়। ছবিতে সিচুয়েশন এমন, কিছু একটা ‘আনইউজড’ শুরু চাইছিলেন পরিচালক ও সঙ্গীত পরিচালক। মান্নাদা একটা অদ্ভুত কাশি দিয়ে গানটা শুরু করেন। রেকর্ডিং তো হয়ে গেল। কয়েক দিন পরের ঘটনা। বেশ রাত। মান্নাদা এবং বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছেন। এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠল। এত রাতে ফোনটোন না করে কে এল রে বাবা! মান্নাদা ঘুমচোখে দরজা খুলে দেখলেন, সেই সময়ের ডাকসাইটে সঙ্গীত পরিচালক সি রামচন্দ্র। একটু মুচকি হেসে মান্নাদাকে বললেন, ‘ক্যায়া খাসা মান্নাদা! সাবাশ।’ ব্যস, এই কথা বলেই অ্যাবাউট টার্ন। বুঝুন অবস্থা! মান্নাদার কাশিটি ভাল লেগেছে, এ কথা জানাতে এত রাতে চলে এসেছেন মান্নাদার বাড়ি।

আর এক রাতে এলেন শচীনকর্তা। অবশ্য ফোন করে। এসেই খুব ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘‘মানা, এক বোতল হুইস্কি, জল আর বৌমাকে বল পাঁপড় আর নানারকম ভাজা করে আনতে।’’ মান্নাদা তো শশব্যস্ত হয়ে সব ব্যবস্থা করতে লাগলেন। মনে মনে ভাবছেন শচীনদার আবার কী হল? মাথায় গন্ডগোলটোল হয়েছে নাকি! শচীনদা গ্লাসে দু’চার ফোঁটা হুইস্কি ফেললেন, হোমিওপ্যাথি ডোজের মতো। জল ঢাললেন গ্লাসভর্তি। ততক্ষণে টেবিলও পাঁপড় এবং নানারকম ভাজায় ভর্তি হয়ে গিয়েছে। মান্নাদা শচীনদার কাণ্ড দেখছেন। গ্লাসের অতল জলে হারিয়ে যাওয়া কয়েক ফোঁটা হুইস্কি নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন, আর ‘অনেক খাব, অনেক খাব’ ভঙ্গি করে শুধু পাঁপড়ের ছোট্ট একটা টুকরো মুখে দিলেন। রাত একটু বাড়তে ‘বৌমা, আজ আসি গিয়া’ বলে শচীনদার অন্তর্ধান। আসলে হয়েছে কী, সেদিন সন্ধ্যায় এক প্রোডিউসর ও ডিরেক্টরের আসার কথা শচীনদার বাড়িতে। একটা মালয়ালি ছবিতে সুর করার জন্য। প্রচুর টাকার অফার। শচীনদার কথা : ‘‘ওই ভাষাটাই বুঝি না, সুর করুম কী কইর‌্যা!’’ তাদের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকার জন্যই চলে এসেছেন মান্নাদার বাড়িতে।

Advertisement

শচীনকর্তার বিষয়ে মান্নাদার অফুরন্ত স্টক। শচীনদা একদিন ডেকে পাঠিয়েছেন মান্নাদাকে। একটি গান নিয়ে বসতে হবে। একটু দুপুর করে আসতে বলেছেন। মান্নাদাকে দেখে বললেন, ‘‘মানা, আইসা গ্যাছো! ভাল হইছে। তুমি খাইছ?’’ মান্নাদা তো খেয়ে আসেননি। দুপুরে আসতে বলেছেন। মান্নাদা ‘না’ বলতে শচীনদা বললেন, ‘‘অ! তাইলে তুমি বসো। আমি চারটি খাইয়া লই।’’

আর এক দিন শচীনদা ও মান্নাদা খেতে বসেছেন। হঠাৎ শচীনদা একটা ঘিয়ে রঙের শিশি বের করে নিজের গরম ভাতে ঢালতে লাগলেন। ঢালতে ঢালতে বললেন, ‘‘তোমার বৌদি পাঠাইছে। ঘিয়ের গন্ধ দ্যাখছ? মানা, খাইবা নাকি একটু?’’ মান্নাদা কিছু বলার আগেই শচীনদা পরিপাটি করে ঘিয়ের শিশিটা বন্ধ করে বললেন, ‘‘আজ আর তোমার ঘি খাইয়া কাজ নাই।’’

মান্নাদা বাংলাদেশ গিয়েছেন অনুষ্ঠান করতে। সঙ্গে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। দারুণ ব্যাপার। মান্নাদাই বলতেন, আমার বাংলাগান এখান থেকে বাংলাদেশের লোকেরাই বেশি শোনে। এখানে তো সেই হাতে গোনা কয়েকটা গানের অনুরোধ আসে ঘুরেফিরে। আর বাংলাদেশের শ্রোতারা আমার সব গানই জানে। ওখানে ‘তুই কি আমার পুতুল পুতুল’, ‘যে সমাধি বেদীটা’, ‘দুঃখ আমাকে দুঃখী করেনি’, এমন কত সব গানের অনুরোধ পাই। গানের কথাও ওদের মুখস্থ। আমি ভুলে গেলে অডিয়েন্সই বলে দেয়।

অনুষ্ঠান ছিল ঢাকার সোনার গাঁ হোটেলে। সেদিন মান্নাদা দুঃখের গানই একটু বেশি গেয়েছিলেন। অধিকাংশ গানই পুলকবাবুর লেখা। শ্রোতারা তো কেঁদে আকুল। অনুষ্ঠান শেষে মহিলারা এসে ধরলেন পুলকবাবুকে। বললেন, মান্নাদার এত দুঃখ কেন? সেই মহিলা কত রূপসী, কত বিদুষী যে মান্নাদাকে এত আঘাত দেওয়ার পরেও আড়ালে লুকিয়ে থাকে? পুলকবাবু তো মনে মনে হাসছেন। মুখে বলেন, ‘‘আমি কী জানি মান্নাদার ব্যাপার? আমাকে যেমন বলেন আমি লিখে দি। আপনারা বরং মান্নাদাকে জিগ্যেস করুন।’’ সবাই এবার ছুটলেন মান্নাদার দিকে। মান্নাদা দেখলেন ভীষণ বিপদ। দুঃখ দেওয়া সেই মহিলাকে ওরা বের করবেই। মান্নাদা তাদের প্রাণের থেকেও প্রিয়। আর তাকেই এত দুঃখ দেওয়া? মান্নাদা, আপনাকে বলতেই হবে তার নাম। মান্নাদা তখন বললেন, ‘‘আরে এসব পুলকবাবুর ব্যাপার। আমাকে ওরকম লিখে দ্যায়, আমিও গেয়ে দি।’’

মান্নাদার মুখে শোনা শচীনকর্তার আরেকটি গল্প মনে পড়ে গেল। রেকর্ডিঙের আগে রিহার্সাল চলছে। শচীনদা তবলিয়াদের তবলার রিদম বোঝাচ্ছেন। নানা ভাবে বোঝাবার চেষ্টা করছেন, কিন্তু যেটা চাইছেন সেটা কেউ বাজাতে পারছে না। শেষে শচীনদা কী করলেন জানেন? গায়ের পাঞ্জাবি খুলে ফেলে হাত দিয়ে বগল বাজাতে আরম্ভ করলেন। তারপর তবলিয়াদের বললেন, ‘‘এইবার তোমরা বোজঝো তবলার এই প্যাটার্নটাই আমি চাইছি।’’

এই ধরনের রসিকতার সাহায্যে উৎসাহিত করতেন মিউজিশিয়ানদের। ২০০৬ সাল। দমদমে এইচ এম ভি স্টুডিয়োতে মান্নাদার পুজোর গানের রেকর্ডিং চলছে। মিউজিকের সঙ্গে লাইভ গাইছেন। টেক চলছে। মান্নাদা গাইতে গাইতে হঠাৎ থেমে গেলেন। রেকর্ডিস্ট, মিউজিশিয়ানরা সবাই সন্ত্রস্ত। কারও কি ভুল হয়েছে? তা নয়। মান্নাদা উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘‘সেতারটা কী দারুণ বাজাচ্ছ রাহুল (চট্টোপাধ্যায়), এমন বাজালে গাই কী করে?’’ মান্নাদার কথা শুনে রাহুল দ্বিগুণ উৎসাহে আরও ভাল বাজাতে শুরু করল।

আর একবারের ঘটনা। ফাইনাল টেকের আগে রিহার্সাল চলছে। মান্নাদা গাইছেন। চারপাশে বসে মিউজিশিয়ানরা বাজাচ্ছে। হঠাৎ হাতের ইশারায় মান্নাদা বাজানো বন্ধ করতে বললেন। দেখা গেল তখনও একটা গিটার বেজে চলেছে। মান্নাদা বললেন, ‘‘তোমরা ভূতের বাজনা শোনো।’’ আসলে ব্যাপারটা কী হয়েছে, একটি অল্পবয়সি ছেলে গিটার বাজাতে এসেছে। ফ্লোরে এসে সে জানল মান্নাদার সঙ্গে বাজাতে হবে। তাই ভয় পেয়ে, নার্ভাস হয়ে একটা থামের আড়ালে বসে বাজাচ্ছিল। সে কথা শুনে মান্নাদা একটু জোরে বললেন, ‘‘আরে ভাই, আপনি তো দারুণ বাজাচ্ছেন। সামনে আসুন, আপনার সঙ্গে একটু পরিচয় করি।’’ ছেলেটি সবাইকে টপকে মান্নাদার পাশে বসে বাজাতে আরম্ভ করল।

তবে মান্নাদার সঙ্গে একবার ভীষণ রসিকতা করেছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক দেবী শেঠী। বেঙ্গালুরুতে ড. শেঠীর হাসপাতালে তখন মান্নাদা ভর্তি ছিলেন। বাড়ি ফিরবেন কিন্তু ড. শেঠী কিছুতেই হাসপাতালের বিল দিচ্ছেন না। শুধু বলছেন, তা কী করে হয় স্যার! বাবা আপনার গানের অন্ধ ভক্ত, আমিও আপনার গান শুনে বড় হয়েছি। আপনার চিকিৎসার জন্য কী করে টাকা নিই? মান্নাদা কিন্তু বিল দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। শেষে ড. শেঠী বিল নিয়ে এলেন। সব খরচের পাশে লেখা ‘নিল’। মান্নাদাকে বললেন, আপনি বিল চেয়েছিলেন, আমিও দিলাম।

রসিকতা করেও এমন শ্রদ্ধা প্রকাশ করা যায়!

নির্ভেজাল আড্ডার সময় কোনও ধরনের ডিস্টার্বেন্স মান্নাদা পছন্দ করতেন না। কাছের মানুষের সঙ্গে আড্ডা জমে উঠেছে। এমন সময়ে একটা ফোন এল। মান্নাদা ফোন ধরলেন। যে ফোন করেছিল, মান্নাদার গলা শুনেই খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ল। সে কী যেন বলছে, আর মান্নাদা তাকে থামিয়ে বারবার বলছেন, ‘‘না না, আমি মান্নাদা নই। উনি তো বারাসতে ফাংশন করতে গিয়েছেন। আমি ওনার ছোট ভাই প্রভাস দে। হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন ভাই! আমাদের দু’জনের গলা প্রায় একরকম।’’ ফোন রেখে মান্নাদা হাসতে হাসতে বললেন, কী যে চায় পরিষ্কার করে বলতেই পারে না।

মান্নাদার পরিচিত এক গীতিকার তাঁর জন্য একটা গান লিখে নিয়ে এসেছে। মান্নাদা পড়ে বললেন, ‘‘ভালই তো লিখেছেন।’’ এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। এবার গীতিকার ভদ্রলোক অতি উৎসাহে বলল, ‘‘এ গানের আমি একটা সুরও করেছি। আপনাকে শোনাই।’’ মান্নাদাকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ভদ্রলোক গানটি গাইতে লাগলেন। গান শেষ হতে মান্নাদা বললেন, ‘‘আপনিই গানটা রেকর্ড করুন। সেটাই ভাল হবে।’’ এমন সময় ছোট ছোট গুটকা শিঙাড়া এসে গিয়েছে এক ঠোঙা। একদম হাতে গরম। মান্নাদা চোখের ইশারায় ঠোঙা খুলতে বারণ করলেন। সেই গীতিকার ভদ্রলোক অনেকটা সময় কাটিয়ে চলে যাওয়ার পর মান্নাদা বললেন, এবার সবাই শিঙাড়া খান। চা-ও আসছে। একজন বলল, একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে মান্নাদা। মান্নাদা সেই স্বর্গীয় হাসি হেসে বললেন, গানের যা সুর করেছে, ওকে শিঙাড়া খাওয়ানো যায় না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement