আপনার শেয়ার আপনার অধিকার

কোনও সংস্থার সামান্য শেয়ার হাতে থাকলেও কিছু অধিকার আপনার পাওনা। যা রক্ষায় আরও কড়া হয়েছে সেবি এবং কোম্পানি দফতর। এ বার সেই অধিকার বুঝে নিন আপনিও।গত পাঁচ-ছ’বছরে দেশে সঞ্চয়ের সার্বিক প্রোফাইল অনেকখানি বদলে গিয়েছে। শুধু ফিক্সড ডিপোজিট, রেকারিং বা পিপিএফ নয়, সাধারণ মানুষ এখন লগ্নির মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছেন শেয়ার বাজারকেও। এমন নয় যে আগে কেউ শেয়ার কিনতেন না। কিন্তু এখন শেয়ার বাজারে তাঁরা আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ।

Advertisement

অমিতাভ গুহ সরকার

শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:১৫
Share:

গত পাঁচ-ছ’বছরে দেশে সঞ্চয়ের সার্বিক প্রোফাইল অনেকখানি বদলে গিয়েছে। শুধু ফিক্সড ডিপোজিট, রেকারিং বা পিপিএফ নয়, সাধারণ মানুষ এখন লগ্নির মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছেন শেয়ার বাজারকেও। এমন নয় যে আগে কেউ শেয়ার কিনতেন না। কিন্তু এখন শেয়ার বাজারে তাঁরা আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ।

Advertisement

তবে টাকা ঢেলে শেয়ার কিনে ফেললেই আপনার কাজ সারা, এটা ভেবে বসলে ভুল হবে। কারণ, আপনি যখন কোনও সংস্থার শেয়ার কেনেন তখন কিন্তু ব্যাঙ্কের মেয়াদি জমার মতো তাতে স্রেফ লগ্নিই করেন না। বরং বলা যায় খুব ছোট করে হলেও এ ক্ষেত্রে ওই সংস্থার একজন অংশীদার হয়ে যান। আর অংশীদার হওয়া মাত্র অর্জন করেন বেশ কিছু অধিকার। সেই সুবাদে বর্তায় কিছু দায়িত্বও। তখন আপনি আপনার অধিকার ঠিক মতো প্রয়োগ করতে পারছেন কি না, তা দেখে শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সেবি এবং সংশ্লিষ্ট স্টক এক্সচেঞ্জ।

সম্প্রতি এই অধিকার রক্ষায় আরও কঠোর হয়েছে সেবি। এ নিয়ে আমূল বদলেছে কোম্পানি আইনও। যা আপনার-আমার মতো বিভিন্ন সংস্থার খুব ছোট অংশীদারদের অবস্থানকে আরও পোক্ত করেছে। অতএব শুধু লগ্নি নয়, আর্থিক ভাবে সত্যিকারের সচেতন ও দায়িত্বশীল হয়ে উঠতে নিজের সব অধিকার প্রয়োগ করে সংস্থাকে ঠিক পথে চলতে সাহায্য করাও কিন্তু জরুরি। তাই নয় কি? চলুন, আজ সেটাই দেখি।

Advertisement

আমার কী দায়?

হতে পারে আপনার হাতে কোনও সংস্থার খুব সামান্য শেয়ার রয়েছে। সে ক্ষেত্রে মাত্র ওইটুকু অংশের জন্য সংস্থায় নিজের অধিকার প্রয়োগ করতে যাওয়াকে আপনি ঝক্কির বলে ভাবতে পারেন। আপনার মনে হতে পারে ‘আমার কী দায়?’

কিন্তু আদতে তা নয়। বরং দায়টা আপনারই। কারণ, যত কমই হোক না কেন, যে টাকা ঢেলেছেন সেটা আপনার কষ্ট করে রোজগার করা। আর তা যতটা সম্ভব বাড়িয়ে নিতে যে-সংস্থার শেয়ার কিনেছেন, তার সার্বিক ভাল হওয়া জরুরি। সে ক্ষেত্রে বড় অংশীদারদের পাশাপাশি আপনার মতো ছোট ছোট শেয়ারহোল্ডার যদি নিজের নিজের অধিকার প্রয়োগ করেন, তা হলে সংস্থা সঠিক পথে চলবে। তার কোনও সিদ্ধান্ত ভুল হলে তা ধরিয়ে দেওয়া যাবে। এবং তারা শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থরক্ষার বিষয়ে বেশি মনযোগী হবে। এটা সংস্থার উন্নতির পক্ষে ভাল। আর সংস্থার উন্নতি হলে আপনার লাভ।

আপনার জন্য অনেক কিছু

বহু মানুষের ছোট-বড় লগ্নিতে ভর করে গড়ে ওঠে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি। বিশেষ করে শেয়ার বাজারে নথিবদ্ধ সংস্থাগুলি। যে- গোষ্ঠীর হাতে বেশি শেয়ার থাকে, সংস্থা পরিচালনার দায়িত্ব পায় তারাই। এরা বাজারের পরিভাষায় প্রোমোটার নামে পরিচিত। বাকি সদস্যরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকেন দেশে বা দেশের বাইরে। তবে যেখানেই থাকুন না কেন, নিয়ম অনুযায়ী, নিজের অধিকার এখন পুরোমাত্রায় প্রয়োগ করতে পারেন আপনি।

ই-মেলের মাধ্যমে যে কোনও মুহূর্তে যোগাযোগ করতে পারেন সংস্থার সঙ্গে। জানাতে পারেন অভিযোগ। এমনকী ইলেকট্রনিক বা বৈদ্যুতিন ভোটিং পদ্ধতিতে তাদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে বিশ্বের যে কোনও জায়গায় বসে প্রয়োগ করতে পারেন আপনার ভোটাধিকার। সে ক্ষেত্রে আপনার যদি কাগজের আকারে শেয়ার ধরা থাকে এবং ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট না-থাকে, তাতেও সেই অধিকারে কোপ পড়বে না। এত কাল যে-শহরে কোম্পানির রেজিস্টার্ড অফিস, তার বাইরে বসবাস করলে সদস্য হিসেবে নিজের অধিকার প্রয়োগ কষ্টসাধ্য ছিল।

মনে রাখবেন, মাত্র একটি শেয়ার হাতে থাকলেও সংশ্লিষ্ট সংস্থার সদস্য হিসেবে যে-সব অধিকার তৈরি হয় আপনার, সেগুলি থেকে আপনাকে কখনওই বঞ্চিত করা যাবে না। এর মধ্যে রয়েছে বার্ষিক ও অন্যান্য সাধারণ সভায় যোগ দেওয়া, সংস্থার আয়-ব্যয়, লাভ-ক্ষতির হিসাব-সহ বিভিন্ন তথ্য জানা, নিজেকে বা নিজের পছন্দের কোনও সদস্যকে ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগের জন্য আবেদন বা শেয়ার হস্তান্তর করার মতো অধিকারও। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে দেখে নিন সঙ্গের সারণি।

ভোট দেবেন না কেন?

যে শহরে সংস্থার রেজিস্টার্ড অফিস থাকে সেখানেই ডাকা হয় তাদের বার্ষিক সাধারণ-সভা (এজিএম)। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এই সভায়। এত কাল এই সভায় যোগ দিলে তবেই ভোটাধিকার প্রয়োগ করা যেত। অর্থাৎ যাঁরা অন্যত্র থাকেন তাঁদের পক্ষে এজিএম-এ ভোট দেওয়া এক রকম অসম্ভবই ছিল। কেউ কেউ অবশ্য প্রক্সির (প্রতিনিধির মাধ্যমে ভোট দিয়ে) মাধ্যমে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতেন।

তবে এ বার নিয়ম পাল্টেছে। শেয়ার বাজারে নথিবদ্ধ সংস্থার ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং (ই-ভোটিং)-এর ব্যবস্থা করা বাধ্যতামূলক হয়েছে। ফলে পৃথিবীর যে-প্রান্তেই থাকুন, সেখান থেকে ভোট দিতে পারেন অনায়াসে।

সংস্থা ই-ভোটিং শুরু হওয়ার সপ্তাহ তিনেক আগেই স্পিড পোস্ট, রেজিস্টার্ড পোস্ট অথবা ই-মেলে সভার নোটিস এবং ভোটিংয়ের পদ্ধতি পাঠিয়ে দেয়। পাঠানো হয় পাসওয়ার্ডও। আপনার কাজ, নোটিস পড়ে বোতাম টিপে পছন্দ মতো ভোট দেওয়া। ই-ভোটিং বন্ধ হয় বার্ষিক সাধারণ সভার তিন দিন আগে। এজিএমের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ফলাফল জানানো হয় সংস্থার নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে।

সবাই ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পাওয়ায় এ বার থেকে সংস্থার পরিচালন পর্ষদকে অনেক বেশি সাবধানে চলতে হবে। অনেক বেশি সক্রিয় হতে হবে সদস্যদেরও। সময় মতো প্রয়োগ করতে হবে ভোটাধিকার। ই-ভোটিং এ বছরই প্রথম চালু হওয়ায় এ বার এই পদ্ধতিতে তেমন ভোট পড়েনি। আশা করা যায়, ধীরে ধীরে ভোট দেওয়ার এই সহজ পদ্ধতি জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।

মতামত জানাতে ভুলবেন না

সংস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হলে তার উপর ভোট বাধ্যতামূলক ভাবে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে সংস্থা নোটিস এবং ব্যালট পেপার সময় মতো পাঠিয়ে দেয় সদস্যদের ঠিকানায়। সঙ্গে পাঠানো হয় টিকিটযুক্ত খাম, যাতে আপনি ভোট দেওয়ার পরে ব্যালট পেপার ফেরত পাঠাবেন। আপনাকে নোটিস পড়ে ব্যালটের উপযুক্ত খোপে টিক দিয়ে তা ভোট-পরীক্ষকদের কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে। এতে আপনার সামান্য সময় যাবে ঠিকই, কিন্তু খরচ নেই। সংস্থার সদস্যদের প্রতিটি ব্যাপারে ভোটের মাধ্যমে অবশ্যই নিজের মতামত প্রকাশ করা উচিত।

ঝক্কি কাটাতে ই-মেলই ভাল

সদস্যদের সঙ্গে খুব সহজে এবং কম খরচে যোগাযোগের জন্য আজকাল সরকার বেশি করে ই-মেল ব্যবহারে উৎসাহিত করছে সংস্থাগুলিকে। ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট মারফত বা আলাদা করে সংস্থার কাছে নিজের ই-মেল নথিবদ্ধ করলে তারা বার্ষিক রিপোর্ট, বিভিন্ন নোটিস এবং অন্যান্য বিজ্ঞপ্তি তার মাধ্যমেই সদস্যদের কাছে পাঠায়। এতে সংস্থা ও তার সদস্য, সকলেরই সুবিধা হয়। সংস্থার ছাপা এবং ডাক বাবদ খরচ বাঁচে। সদস্যরাও চটজলদি সব বিজ্ঞপ্তি এবং ভোট সংক্রান্ত নির্দেশনামা পেয়ে যান। ডাকযোগে হারানোর ভয় থাকে না। দেশে প্রচুর কাগজের সাশ্রয় হয়। অর্থাৎ ই-মেলের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা পরিবেশ রক্ষার জন্যও বিশেষ সহায়ক। যে কারণে সদস্যদের উচিত হবে নিজেদের ই-মেল কোম্পানির দফতরে নথিবদ্ধ করা। যাতে বিভিন্ন কারণে সংস্থার সঙ্গে চিঠি-চাপাটি ই-মেলেই করা যায়। এতে সবারই সুবিধা এবং সাশ্রয়।

নালিশ থাকলে জানাবেন

সদস্য বা লগ্নিকারী হিসেবে একটি সংস্থা থেকে আপনার যা যা পাওয়ার কথা, তা সময় মতো না-পেলে আপনি অনলাইনে অথবা চিঠি লিখে সেই সম্পর্কে অভিযোগ জানাতে পারেন সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কাছে। তা-ও প্রতিকার না-পেলে অভিযোগ জানান সেবির www.scores.gov.in ওয়েবসাইটে নথিবদ্ধ করে। অভিযোগের প্রতিকার হল কিনা, সেটাও এই সাইটের মাধ্যমেই জানতে পারবেন। sebi complaints redress system— scores-এর পুরো কথা।

অতএব...

সব শেষে বলি, শেয়ারহোল্ডার হিসেবে শুধু লগ্নি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা কোনও কাজের কথা নয়। বরং লগ্নির স্বার্থেই অন্য বিষয়গুলি মাথায় রাখা জরুরি।

একটি কোম্পানির সদস্য হওয়া মাত্র আপনি অর্জন করেন নানা রকমের অধিকার

যেখানেই থাকুন, ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন ই-ভোটিং মারফত

ভোট দেওয়া যায় পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমেও

ই-মেলের মাধ্যমে পাওয়া যায় কোম্পানির সব বিজ্ঞপ্তি, অ্যানুয়াল রিপোর্ট, ইত্যাদি

কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা এবং অভিযোগও জানানো যায় ই-মেল মারফত

কোম্পানির ওয়েবসাইট থেকে পেতে পারেন তাদের সম্পর্কে নানা প্রয়োজনীয় তথ্য

অভিযোগের প্রতিকার না-হলে তা নথিবদ্ধ করুন সেবির www.scores.gov.in ওয়েবসাইটে। এখানে দ্রুত প্রতিকার আশা করা যায়

একজন দায়িত্বশীল লগ্নিকারী হিসেবে সব সময়ে নিজের অধিকার প্রয়োগ করুন

লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)

জমিই হোক বা সঞ্চয়। আপনার যে কোনও বিষয়-সমস্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শের জন্য লিখুন।

ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানাতে ভুলবেন না। ‘বিষয়’, ব্যবসা বিভাগ,

আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা, পিন-৭০০০০১। ই-মেল: bishoy@abp.in

হক-কথা

একটি কোম্পানির সদস্য হিসেবে আপনি যে সব অধিকার ভোগ করেন, সেগুলি হল—

বার্ষিক সাধারণ সভা এবং অন্যান্য সাধারণ সভার নোটিস পাওয়া এবং সেই সভায় যোগ দেওয়ার

সংস্থার বার্ষিক রিপোর্ট পাওয়ার। এতে থাকে পরিচালন পর্ষদের বার্ষিক রিপোর্ট, আর্থিক হিসাব, বছরের শেষ দিনের ব্যালান্স শিট এবং তার উপর অডিটরের রিপোর্ট। বার্ষিক রিপোর্ট থেকে জানা যায় সংস্থার আয় ব্যয়, লাভ ক্ষতি, সম্পদ ও দায়ের বিবরণ এবং প্রস্তাবিত লভ্যাংশের (ডিভিডেন্ডের) হার

বার্ষিক সভায় অনুমোদিত হলে ৩০ দিনের মধ্যে ডিভিডেন্ড পাওয়ার

শেয়ার হস্তান্তর করার। এবং অন্যের থেকে কেনা শেয়ার নিজের নামে নথিবদ্ধ করার

কোম্পানি আইনে স্বীকৃত সংস্থা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য পাওয়ার। কোনও কোনও নথির প্রতিলিপি পাওয়ার

নিজেকে বা নিজের পছন্দের অন্য কোনও সদস্যকে ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগের জন্য আবেদন করার

সংস্থার সাধারণ সভায় ভোট দেওয়ার। এই অধিকার যে কোনও জায়গা থেকে ই-ভোটিং অথবা পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমেও প্রয়োগ করা যায়

উত্তরাধিকার সূত্রে শেয়ার পেলে তা নিজের নামে নথিবদ্ধ করার

সাধারণ সভায় অনুমোদিত হলে বোনাস এবং রাইট শেয়ার পাওয়ার

সংস্থার পরিচালনায় বড় রকমের গলদ আছে মনে করলে নিয়মমাফিক কোম্পানি মন্ত্রকে নালিশ করার

নিজের অধিকারগুলি প্রয়োগ করতে বাধা পেলে বা ইচ্ছাকৃত ভাবে অসুবিধা তৈরি করা হলে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement