শ্যামল মিত্রের মৃত্যুর পর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একটা ভাববার মতো কথা বলেছিলেন, “আমার পরে বাংলা রোম্যান্টিক গানে তো ও-ই ছিল।”
কথাটার সত্যতা নিয়ে খুব যে ভাবার আছে তা নয়, কারণ ১৯৫৫-৫৬ থেকে ১৯৬৫-৬৬ অবধি বাংলা রোম্যান্টিক গানে শ্যামলের জনপ্রিয়তা ছিল হেমন্তর প্রায় সমতুল্য।
তখন বাংলা সিনেমায় হেমন্ত একের পর এক রোম্যান্টিক গান দিয়ে যাচ্ছেন, আর নন-ফিল্মিকে রোম্যান্সের জোয়ার ডেকে দিচ্ছেন শ্যামল। কী রকম জোয়ার তাতে পরে আসছি, তার আগে বলি ভাবার বিষয়টা কী?
ভাবার হল, কী ভাবে হেমন্ত ও শ্যামল বাংলা রোম্যান্টিক গানকে নিজেদের মতো করে দুটো আকার-প্রকার গোত্রে ভাগ করে নিচ্ছিলেন।
এক হল, প্রেমের গান, লাভ সং, যেখানে হেমন্তর বিচরণ।
দুই, যাকে বলা হয় লাভার বয় সং, তরুণ উচ্ছল প্রেমিকের গান, উষ্ণ প্রেমের মিঠে-নোনতা যে গান কখনও প্রিয়ার কণ্ঠ জড়িয়ে, কখনও প্রিয়াকে বিব্রত, রক্তিমাভা করার জন্য দুনিয়াকে শুনিয়ে গাওয়া হয়।
এই দ্বিতীয় ধারার পত্তনই বলা যায় শ্যামলের গায়কিতে। এবং এ গানে ওঁর কোনও চ্যালেঞ্জার কখনও তৈরি হয়নি।
এই লাভার বয় সঙের পাশাপাশি সে সময় তিনি কিন্তু ‘এমন দিন আসতে পারে’, ‘আমি তোমার পাশে যেমন আছি’, ‘যদি ডাকো এপার হতে’-র মতো গভীর অনুরণন ও চোখের জলের প্রেমের গানও রেকর্ড করে গেছেন। কাউকে ভুলতে দেননি যে, ওঁর হিট গানের জয়যাত্রা ১৯৫২-য় সুধীরলাল চক্রবর্তীর মৃত্যুতে ‘স্মৃতি তুমি বেদনা’ গুরুপ্রণাম দিয়ে।
লাভ সং ও লাভার বয় সঙের বিলিতি চেহারাটার দিকে একটু চোখ ফেললে হয়।
ন্যাটকিং কোল, ফ্র্যাঙ্ক সিনাট্রা, জিম রিভজ-রা যে প্রেমের গান গাইতেন তা লাভ সং, আবার এলভিস প্রেসলির একেবারে প্রথম দিকের ‘লাভিং ইউ’, প্যাট বুন-এর ‘ও, ও, বার্নাডিন!’ ও হরেক এ রকম, টোনি ব্রেন্ট-এর ‘সামওয়ান এলস্ ইজ ইন ইওর আর্মজ টুনাইট’, ক্লিফ রিচার্ড-এর প্রায় সবই, অ্যান্ডি উইলিয়ামজ-এর কত কিছু কিংবা এঙ্গেলবার্ট হাম্পারডিঙ্ক-এর ‘প্লিজ রিলিজ মি লেট মি গো’-কে নমুনা করা হত লাভার বয় সঙের।
তবে শ্যামল যে প্রেমিকের গানের ধারার সূচনা করলেন তার কোথাও কোনও বিলিতি ছাপ নেই, পুরোটাই ওঁর নিজস্ব ধরন, বলন, গায়ন ও গঠনে ধরা। যা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বাঙালিকে বিলকুল পাগল করে ছেড়েছিল।
পঞ্চাশের দশকে শ্যামল যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তখন জলসা আলো করার মতো এক রম্য, রোম্যান্টিক উপস্থিতিও ছিল ওঁর।
টিকোলো নাক, কোঁকড়া চুল, ভাসা-ভাসা আয়ত চোখ ও আকর্ষক মাজা গায়ের রঙের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্মোহনে কাজ করত একটা গম্ভীর আনুনাসিক কণ্ঠধ্বনি। শচীনদেবের মতো ওঁরও ন্যাজাল টোনের একটা জাদু ছিল আজকালকার বাগবুলিতে ইউএসপি।
হেমন্তর মতো শ্যামলেরও বিপুল সাফল্যের হেতু ওঁর সহজ ও সরল অ্যাপ্রোচ। সুর নিয়ে অনাবশ্যক প্যাঁচ পয়জারে বিশ্বাস ছিল না, রোম্যান্টিক কণ্ঠের রোম্যান্টিকতা যতখানি সম্ভব বাঁচিয়ে রেখে আলতো করে সুর দিয়ে বাণীকে স্পর্শ করতেন। কিন্তু ওঁর গলা ছিল খোলা— যেটা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও উল্লেখ করেছেন— এবং ক্লিফ রিচার্ড, টোনি ব্রেন্ট জাতীয় লাভার বয় সংস্টারদের মতো ক্রুনিং বা শিল্পিত চাপা ধ্বনির চর্চা করতেন না। বড় অনায়াসে লম্বা লম্বা সুরের টান দিতেন এবং ধ্বনির রেশ ধরে রাখতেন, ওঁর গলার মধ্যে কোথাও যেন একটা ভায়োলিন টাচ আসত।
ওঁর খাদের আওয়াজটা ছিল চমৎকার, ওপরের সপ্তকে প্রবেশ ঘটত আনুনাসিক ধ্বনির, এবং দুইয়ে মিলে প্যাথস বা বিষাদ সৃষ্টির সুন্দর ব্যবস্থা হত। প্রেমিকের গানকে এত সরল ভাবে বরাবর গেয়ে গেছেন যে ওঁর চলে যাওয়াকে সে সময় উল্লেখ করা হয়েছিল ‘এক প্রেমিকের প্রস্থান’ বলে।
বাঙালির কাছে এই প্রেমিকটি কেমন ছিলেন তার কয়েকটা ছবি দিই। মধ্য কলকাতার ক্রিক রো পাড়ার বিখ্যাত ভানু বোসের জলসায় শ্যামল ছিলেন স্টার অ্যাট্র্যাকশন নাম্বার ওয়ান। অত্যন্ত রক্ষণশীল বাড়ির সুন্দরী মেয়েরা সারা রাত শাল মুড়ি দিয়ে জলসা শুনত শ্যামলকে শুনবে ও দেখবে বলে। ওঁর কালো হিন্দুস্তান ফোর্টিনটা ঘেরাও হয়ে যেত ফ্যানদের দ্বারা।
একবার প্যান্ডেলে ঢুকেছেন, বালিকা-যুবতী-মহিলারা গিয়ে ছেঁকে ধরলেন অটোগ্রাফের জন্য। সাফারি টাইপের জোড়া বুকপকেটের ছাই ছাই গ্যাবার্ডিনের শার্ট পরনে ছিল ওঁর সেদিন। শ্যামল পকেট থেকে ফাউন্টেন পেন বার করে সই করবেন, হঠাৎ কলমটা ছিটকে পড়ল মাটিতে। সেই কলম কুড়োতে তখন পাঁচ যুবতীর মধ্যে ঠেলাঠেলি। ততক্ষণে এক মহিলা নিজের কলমটা ওঁকে দিয়ে বললেন, “আপনি আমারটা দিয়ে সই করুন আর কলমটা রেখে দিন।” শ্যামল লাজুক হেসে বললেন, “আপনারটা দিয়েই লিখছি, কিন্তু রাখছি না। ওটা হয় নাকি?” যা শুনে পাড়ার এক দাদা মন্তব্য করলেন অদূর থেকে, “এই হল কলির কৃষ্ণ।”
শ্যামল মিত্রের মধ্যে সত্যিই একটা কৃষ্ণ-কৃষ্ণ ব্যাপার ছিল। স্টেজে বসলে উনি জানতেন অডিয়েন্স ওঁকে তারিয়ে তারিয়ে দেখছে ও গিলে খাচ্ছে। ওঁর সুরে গান করা ও অনুরাগিণী বনশ্রী সেনগুপ্ত যেমন বললেন, “অঙ্গভঙ্গিটঙ্গি কিছু ছিল না। কী সুন্দর মুখ নিচু করে শুধু গানটায় ডুবে থাকতেন স্টেজে বসলে। ওঁর রোম্যান্টিক স্টাইলেরই অঙ্গ ওই ভঙ্গিটা।”
আর অডিয়েন্সকে হাতে নেওয়ার আয়োজনে এক বড় ব্যাপার ছিল গানের সিলেকশন। লম্বা টানের গান দিয়ে আসরের মুখপাত করতেন। আজও ভুলতে পারিনি ভানু বোসের জলসায় ওঁর মঞ্চে বসে গেয়ে ওঠা ‘সেদিনের সোনাঝরা সন্ধ্যা’, আরেকবার (গানটা কী করুণ তা মাথায় রেখেও) ‘যদি ডাকো এপার হতে’ এবং একবার ছন্দে আর গা-শিরশিরে রোম্যান্সে ‘সারাবেলা আজি কে ডাকে’। বালক ছিলাম বলে মেয়েদের ভিড়ে বসতে পেতাম, তাই শুনতে পেতাম ‘চমকে ঠমকে গরবী গরবে’ কথাগুলোর সঙ্গে ওদের বড় বড় নিশ্বাস পড়া।
সঙ্গতে মহানায়ক
জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় শ্যামল মিত্রকে নিয়ে বলতে গিয়ে ব্যবহার করলেন ‘প্যাকেজ’ শব্দটা। বললেন, “শ্যামলবাবুর আওয়াজ খুব বড় নয়, কিন্তু খুব সুরেলা। সুর করতেনও খুব ভাল। ওঁর অনেক হিট গানেরই তো সুর ওঁর নিজের। খুব কাজে লাগিয়েছেন ওঁর কণ্ঠের আনুনাসিক ধ্বনি। আর গাইতেনও রোম্যান্টিকালি। ফলে সব মিলিয়ে একটা চমৎকার প্যাকেজ। যা ওঁকে দারুণ সাফল্য দিয়েছে।”
এই প্যাকেজিং ছাড়াও শ্যামল মিত্রের সাফল্যে আরও যে দুটি ব্যাপারের প্রবল প্রভাব— ওঁর অপূর্ব জিনিয়াস ও এলিগ্যান্স— সেই প্রতিভা ও চারুতা নিয়ে ওঁর ভক্তরা ভাবার সুযোগই পাননি ১৯৮৭-তে মাত্র আটান্ন (মতান্তরে উনষট্টি) বছরে ওঁর অকালমৃত্যুর আগে। কী অবলীলায় যে কত লোকাশ্রয়ী, রাগাশ্রয়ী গান গেয়েছেন ও সুর করেছেন, কিন্তু এতটাই নির্দর্প, নির্ভার স্বাক্ষরে যে সে গানের পিছনের তালিম নিয়ে কেউ ভাবার কথাও ভাবেনি।
সুধীরলাল চক্রবর্তীর কাছে বছর পাঁচেকের তালিম, চিন্ময় লাহিড়ির রচনা গাওয়া বা সলিল চৌধুরীর অবিশ্বাস্য সব কম্পোজিশন (‘আহা, ওই আঁকাবাঁকা যে পথ’, ‘যা যা রে যা, যা পাখি’, ‘যদি কিছু আমারে শুধাও’ বা কলাবতী রাগিণীতে ‘লাল পাথর’ ছবির ‘ডেকো না মোরে ডেকো না গো আর’) অমর করে যাওয়া কোন স্তরের শিক্ষা, মেধা ও ক্রিয়ার ছবি তুলে ধরে তা ওঁর অবর্তমানেই শ্রোতার খেয়ালে আসছে।
ওঁর সেরা সময়ে শ্যামলের গাওয়া বা সুর করা গান রেকর্ড হবে আর বাজার ধরে নেবে এটাই নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। এত ঘন ঘন এটা ঘটত যে একটা সময় শ্যামল মিত্র বলতে এক স্বপ্নের ব্যাপারি বোঝাত। নিজেকে নিয়ে মানুষের জাদুচিত্র বয়নে আবার ইন্ধন জুগিয়েছে ওঁর অতীব সফল চলচ্চিত্র প্রযোজনার উদ্যোগ। ১৯৬৩-তে উত্তমকুমার ও তনুজাকে নিয়ে প্রযোজিত ও সুরারোপিত ‘দেয়া নেয়া’ ছবি যে কী তোলপাড় ফেলেছিল বাঙালিজীবনে, তা আজ বললে গল্পকথার মতো শোনাবে। পর পর তিন বারের চেষ্টায় এক বন্ধুকে নিয়ে পাঁচ সিকির টিকিটে হলে গলতে পেরেছিলাম। শো চলাকালীনই বন্ধুটি তনুজার প্রেমে পড়ে যায় এবং শো থেকে বার হয় উত্তমের লিপে শ্যামলের গান গুনগুন করতে করতে। কিন্তু তখন ক’জন বালক, কিশোর, যুবক বা আরও বড়রা ধারণা করতে পেরেছিল যে ছবির গল্পটা আসলে শ্যামল মিত্রেরই জীবনের বৃত্তান্তের আদলে গড়া!
নৈহাটির প্রসিদ্ধ ডাক্তার বাবা সাধনবাবুর বাসনা যে ছেলে তাঁর মতোই ডাক্তারিতে আসবে, আর শ্যামলের আকাঙ্ক্ষা সে গায়ক হবে। এক সময় সান্নিধ্যে আসা হল সলিল চৌধুরীর গণনাট্য সঙ্ঘের। মিছিলে গলা মেলানো হল ‘ও আলোর পথযাত্রী’তে এবং ১৯৪৬-এ বাড়ি ছেড়ে ওঠা হল কলকাতার মেসবাড়িতে। আর যাওয়া শুরু হল গুরু সুধীরলালের কাছে।
কিছু দিন আগে অবধি গল্পের পিছনের এই গল্প জানা ছিল না আমারও। ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’-র গায়কও পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের গানপাগলদের কাছে খুব একটা রক্তমাংসের মানুষ নন, যতটা কল্পনা ও কিছুটা স্বপ্নে ধরা। যে স্বপ্নটায় রক্তের ছোপ এসে পড়ল ১৯৬৯-এর ২১ মে তারিখে ওঁর মোটর গাড়ির অ্যাক্সিডেন্টে।
সেটা টিভিতে ঘণ্টায় ঘণ্টায় খবর ছড়ানোর দিনকাল নয়, শিল্পীদের নিয়ে পত্রপত্রিকার পাতায় পাতায় খবর আসার দিনও নয়। গেয়ে গেয়ে, লোকের মনে মনে দাগ কেটে সেলিব্রিটি হওয়ার যুগ তাঁদের। কাগজে কী এসেছিল জানি না, তবে শ্যামলবাবুর দুর্ঘটনার দুঃসংবাদ মুখে মুখেই চরে গিয়েছিল এবং পাড়ায় পাড়ায় লোকমুখে ঘুরতে শুরু করেছিল। অনেকটা উত্তমকুমারের হার্ট অ্যাটাকের খবরের মতো। ‘দেয়া- নেয়া’-র পর থেকেই যে উত্তম ও শ্যামল অত্যাগমন জুটি।
পাড়ার রকে রকে শ্যামলের খবর ভর করার আরেক কারণ, এই শ্যামলের গানই দেড় দশক ধরে মাত করে রেখেছিল রকে রকে। আশেপাশে বাড়ির মেয়েদের লক্ষ্যে প্রেমপত্র পাঠানোর বিকল্প ছিল সুরেলা বন্ধু ধরে গাওয়ানো ‘নাম রেখেছি বনলতা’, ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’, ‘কার মঞ্জির বাজে রিনি ঠিনি ঠিনি’, ‘তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর’ বা ‘ভালবাস তুমি শুনেছি অনেক বার’।
উত্তম-হেমন্তের মতো উত্তম-শ্যামল গোছের একটা সমীকরণ দীর্ঘদিন চালু চিল ফ্যানদের মধ্যে। সম্ভবত ‘সাগরিকা’ ছবিতে ওঁদের মেগাহিট নাম্বার ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’ দিয়েই যার শুরু।
মৃত্যুর সঙ্গে লম্বা লড়াই করে শ্যামলের প্রাণে ও গানে ফিরে আসা এবং এঁর গান ও সুরের প্রসঙ্গে যাবার আগে আরেকটা ছোট্ট ছবি তুলে দেব ’৫৭-’৫৮ সালের এক পয়লা বৈশাখ সন্ধ্যার। আমার প্রাইভেট টিউটরের সঙ্গে কলেজ স্ট্রিটে বই কিনে ফিরছি, পূরবী সিনেমা পেরিয়ে একটা রেকর্ড রেডিয়োর শপ উইন্ডোর সামনে থ মেরে দাঁড়িয়ে গেলাম বড় ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবির সামনে। স্যুট পরা তরুণ শ্যামল মিত্র। আমার টিউটর মানবেন না ওটা শ্যামল। আমরা বাজি ধরে ভিতরে ঢুকে কাউন্টারে বসা ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম। উনি হেসে বললেন ‘‘হ্যাঁ, ওটা শ্যামল মিত্র। ওই ছবি দেখেই তো বায়াররা ঢুকে আসে।” শ্যামলের অ্যাক্সিডেন্টে যে রক্তের ছোপের কথা বলেছিলাম সেই রক্ত এসে লেগেছিল মনের এই অমলিন ছবিটার উপর।
মনের সেই ছবির ছোপটা অ্যাদ্দিনে সরে গেছে, ছবিটা আরও ঝকঝকে হল আরতি মুখোপাধ্যায়ের কথায় সেদিন। বললেন, “‘হেমন্তদা’, ‘মান্নাদা’ তো বড় গায়ক, ওঁদের পাশাপাশি শ্যামলদাও যে কত বড় একজন তা তো নতুন করে বলতে হয় না। কী সুর গলায়, আর কী রোম্যান্টিসিজম! এত সুন্দর করে গানের কথাগুলো বলতেন যেন প্রেম ঝরে পড়ছে। যে মানুষটার মুখে কোনও দিনও কারও সমালোচনা বা নিন্দের একটা কথা শুনিনি সেই মনটারই একটা ছাপ ওঁর গানে।
কাজ তো প্রচুরই করেছেন। গাওয়া, সুর করা, ফিল্মে সুর দেওয়া ছাড়াও ছবির প্রোডাকশন। এই সমস্ত কাজের মধ্যেই কিন্তু ওঁর ওই রোম্যান্টিক মনটা ছড়ানো। গোছানো, নিপুণ, পার্ফেক্ট।”
আরতির এই উচ্ছ্বাস ও অনুরাগের যথেষ্ট কারণ আছে। বম্বে থেকে তনুজাকে নায়িকা করে এনে অত অপূর্ব অনুরাগে অনুলিপ্ত ছবিতে প্লেব্যাকের ব্রেক দিলেন আরতিকে এমন একটা গানে যা আজও বেজে উঠলে মনের অ্যালবামের পাতা ওল্টানোর কাজটা শুরু হয় মানুষের। কী গান? না, ‘মাধবী মধুপে হল মিতালি’।
আরতি মুখোপাধ্যায় ও কিশোরকুমারের মাঝে
কাজটায় সেই সময়ে আধুনিক সুরের রোম্যান্সের ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু গানটা হয়েছে বহুকালের জন্য। শ্যামলের ‘বয় মিটস গার্ল’ মেজাজের (প্রেমের প্রথম ঝলক ও শিহরনের) গানেও এমন একটা Wit বা চোখা রস ও melodic intuition বা সুরের স্বজ্ঞা, যে তারা অনায়াসেই বয়স ও সময় অতিক্রম করে। ওঁর লাভার বয় সং গোত্রের গানও সব মানুষের মন ভোলায় আজও। কেউ সে-সব গাইলেই মনটা দুলে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে একটা খোঁচও ধরে। কই, সে-সব নিখুঁত সুর লাগানো বলার মাধুরী ও এলিগ্যান্সটা তো এল না!
মে মাসের সেই অ্যাক্সিডেন্টের পর গানে ফিরে শ্যামল গেয়েছিলেন বন্ধু-গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় ‘তোমাদের ভালবাসা’ তাঁর অগণিত শ্রোতা-ভক্তকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন হিসেবে। চোখে জল আনা অসম্ভব সুগীত গানটা কিন্তু মানুষকে সেদিনও চমকে দিয়েছিল। হয়তো সেই প্রথম সে ভাবে তাঁরা নজর করলেন যে তাঁদের প্রেমিক-গায়ক জীবনের প্রথম থেকেই বিদায়, বিচ্ছেদ ও হারিয়ে যাওয়ার বিষাদগীতি গেয়ে এসেছেন। ‘ও শিমুল বন দাও রাঙিয়ে মন’-এর মতো প্রাণোচ্ছল রচনার পাশাপাশি ‘এমন দিন আসতে পারে যখন তুমি দেখবে আমি নাই’ বা ‘যদি ডাকো ওপার হতে’-র মতো মন-মুচড়ানো এলিজি।
অনেকের হয়তো মনে পড়ল যে অ্যাক্সিডেন্টের বছর তিনেক আগেও তিনি গৌরীপ্রসন্নর লিরিকে রেকর্ড করেছেন, “এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মন মোর যেতে নাহি চায়/ না না না যাব না’। চমকের আরেকটা কারণও লোকে খেয়াল করল। নিজের সুরে গাওয়া শ্যামলের অধিকাংশ গানই বিরহবেদনার। শৃঙ্গার ও করুণ রসের মধ্যে ওঁর কান্না হাসির দোলদোলানি বরাবর জারি ছিল। আমরা দেখি বা না দেখি। ওঁর এই বিরহ সুরের প্রবণতার পেছনে কাজ করছে আমার আজ মনে হয়, ওঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি ভাললাগা-ভালবাসার টান।
আশ্রম-ইস্কুল-গুরু ধরে তো ওঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতে আসা নয়, কেবল ভাল লাগা আনুগত্য থেকে। তাতেও তো নিটোল সুরে অনুরাগের ছোঁয়া দিয়ে গেয়েছেন কত গান! ছেলেবেলার একটা বিশেষ স্মৃতি মনে আসছে যা আগেও বলেছি। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ বিদ্যালয়ে এক সন্ধ্যায় আমাদের জনাকয়েককে নিয়ে গানের ক্লাস নিচ্ছিলেন অন্ধশিক্ষক গোপীদা। কী একটা বোঝাচ্ছিলেন হারমোনিয়াম ধরে। পাশের ব্রেইল লাইব্রেরি থেকে কার ট্রানজিসটরে ভেসে এল শ্যামলের কণ্ঠে, ‘চোখের আলোয় দেখেছিলাম চোখের বাহিরে’।
কোনও অন্ধ মানুষের কাছে বিশেষত গোপীদার কাছে এ গানের অন্য একটা তাৎপর্য আছে। কিন্তু সে দিন তিনি এবং আমরা সবাই আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম শ্যামলবাবুর রেন্ডারিং-এ। অদ্ভুত একটা কথাও বললেন গোপীদা, “দেখো, কবির কথা ও সুরের সঙ্গে কী সুন্দর চলছে শ্যামল। গানের কান্নাটা ধরছে কীরকম!”
গানের মধ্যে কান্না ধরার একটা সহজাত ক্ষমতা গোড়ার থেকেই তৈরি ছিল শ্যামলের। দু’দশক ধরে তারই পরিশীলনে হয়তো ষাটের দশকের মাধ্যমে ডবল্ ভার্সান ছবির ‘অমানুষ’-এ ওঁর সুরে বেরিয়ে এল কিশোরকুমারের ওই চার্টবাস্টার নাম্বার, ‘কী আশায় বাঁধি খেলা ঘর বেদনার বালুচরে’। সর্বকালের বাংলা আধুনিকের সেরার কোটায় থেকে যাবে সে-গান।
সলিল চৌধুরী, রবীন চট্টোপাধ্যায়, সুধীন দাশগুপ্তর মতো সেরা কম্পোজার এবং গৌরীপ্রসন্ন, পবিত্র মিত্রের মতো বড় গীতিকারদের সঙ্গে যেমন দুরন্ত সব কাজ করেছেন শ্যামল, তেমনি অকাতরে সুর দিয়ে গেছেন অন্যের সেরা গানে। কখনও সেটা কিশোর, কখনও নিজের সঙ্গে ডুয়েটে হেমন্ত (‘ও বিধি রে’) বা মানবেন্দ্র (‘দোলে দোদুল দোলে’), কখনও আরতি (‘মাধবী মধুপে’), আশা (‘নেই সেই পূর্ণিমা রাত’) অথবা হৈমন্তী (‘এমন স্বপনও কখনও দেখিনি আগে’)।
তবে একটা গান শ্যামল গাইতেনই জলসায় এলে ষাটের দশক জুড়ে। ‘দ্বীপের নাম টিয়ারঙ’ ছবিতে রবীন চট্টেপাধ্যায় সুরে লোকাঙ্গিক ‘আমি চান্দেরি শাম্পান যদি পাই’। একটা লম্বা সময় ধরে লোকাশ্রিত সুরে অপূর্ব সব আধুনিক কম্পোজ করেছেন শ্যামল নিজেও। এত বিচিত্র অঞ্চলে যার চলাফেরা সেই শ্যামলকে কেন যে শুধু প্রেমের গানের শিল্পী করে ধরে রাখল বাঙালি, এটাই এখন বড় ভাবাচ্ছে।
অগুনতি স্মরণীয় বাংলা হিট উপহার দেওয়া, প্রায় একশো ছবির নেপথ্যে কণ্ঠ দেওয়া আর প্রায় পঞ্চাশ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করা শ্যামল মিত্রর শেষ ক’টা বছর খুব ভাল কেটেছে বলা যায় না। বাংলা আধুনিকের স্বর্ণযুগের অবসান লগ্ন সেটা। নতুন কাজ তেমন হচ্ছে না, সেরা শিল্পীদের কাজ হয়েছে, তাঁদের পুরনো গান নিয়ে জলসায় বসা।
এর মধ্যেও ছবিতে সুর করেছেন। গলা দিয়েছেন শ্যামল। কিন্তু হেমন্ত, সতীনাথ, মানবেন্দ্রর মতো তিনিও টের পাচ্ছিলেন যে বাংলা আধুনিক একই সঙ্গে দুই শিল্পেই (কলা অর্থে ও ব্যবসা অর্থে) মার খাচ্ছে। হেমন্ত, সতীনাথ, মানবেন্দ্রর সঙ্গে কথাবার্তাতেই বুঝতে পারতাম ওঁদের আশঙ্কার কথা। শ্যামলের শেষ দিকের দুটি আসরে উপস্থিত থেকেও ওঁর বেদনার একটা আঁচ হয়তো পেয়েছিলাম।
প্রথমটা কলামন্দিরের একটা সান্ধ্য আসর, যেখানে ওঁর গানের আগে অনুষ্ঠান ছিল সংযুক্তা পানিগ্রাহীর ওড়িশি নৃত্য। আমার ধারণা, নাচের আগেই হওয়া উচিত ছিল শ্যামলের নির্ভার অন্তরঙ্গ গানগুলো। সংযুক্তা নেচেছিলেন অতি চমৎকার, কিন্তু নাচের আসরের ওই তুমুল ধ্বনি তরঙ্গের পর শ্যামল যখন নম্র আওয়াজের টানে বলছেন, ‘তরীখানি ভাসিয়েছিলেম ওই কূলে’ কিংবা ‘গানে ভুবন ভরিয়ে দেবে ভেবেছিল একটি পাখি’ বা ‘আমি তোমার কাছেই ফিরে আসব’, আমাদের অনেকেরই মনে হয়েছে, এ হেন গানের জন্য এক সন্ধ্যার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তত দিনে স্বর্ণযুগ ও বাংলাগানের রাশ তো ক্রমশই চলে যাচ্ছে ভিন্ন হাতে। ভিন্ন জমানায়...। দ্বিতীয় আসর, গল্ফ গ্রিনের গায়ে বিজয়গড়ের কালীপুজোর জলসায়। সেই পুরনো শান্ত মেজাজে পুরনো হিটই গাইলেন। শ্রোতার বয়েস বিচার করে ছন্দ ও গতির গান। ‘ও শিমুল বন’, ‘মহুল ফুলে জমেছে মউ’। ‘চৈতালী চাঁদ যায় ডুবে’, ‘নীল আকাশের ওই কোলে’, ‘এই পথে যায় চলে’ এমনকী সলিলের সুরে ‘আহা আঁকাবাঁকা যে পথ যায় সুদূরে’।
বুঝলাম, অডিয়েন্স বিচার করেই যুগের সঙ্গে নিজেকে মানাতে হচ্ছে শ্যামল মিত্রকে। শরীরও খুব দুর্বল দেখালো, স্টেজে উঠতে-নামতে বেগ পেলেন। তবু একবারটি মনে হয়নি ‘ওই আঁকাবাঁকা পথে’র এত সুদূরে চলে যাবেন।
এই আসরের ঠিক কুড়ি দিন পর চলে গেলেন বাঙালির প্রিয় প্রেমিক গায়ক।