স্মরণ ২

রফিসাবের কোনও প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল না

বলিউডে তাঁর সাফল্যের পিছনে মহম্মদ রফির অবদান আজও ভোলেননি তিনি। বলছেন বিশ্বজিৎসাতের দশকে ম্যাডাক্স স্কোয়ারে অজয় বিশ্বাসের জলসায় আমি আমন্ত্রিত। তিল ধারণের জায়গা নেই। স্টেজে রফিসাবকে দর্শকদের সঙ্গে আমিই পরিচয় করিয়ে দিলাম। এক-একটি গান শেষে ঝড়ের মতো হাততালি আর তারিফ। তাঁর মুখে হাসি। হাতের আঙুল আকাশে তুলে মাথা নিচু করে সে তারিফের উত্তরে যেন একটি বার্তা দিচ্ছিলেন— আল্লাই সব। আমি কেউ না। কখনও তাঁর গম্ভীর মুখ দেখিনি। সর্বদাই হাসি হাসি মুখ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৪ ০০:১০
Share:

সাতের দশকে ম্যাডাক্স স্কোয়ারে অজয় বিশ্বাসের জলসায় আমি আমন্ত্রিত। তিল ধারণের জায়গা নেই। স্টেজে রফিসাবকে দর্শকদের সঙ্গে আমিই পরিচয় করিয়ে দিলাম। এক-একটি গান শেষে ঝড়ের মতো হাততালি আর তারিফ। তাঁর মুখে হাসি। হাতের আঙুল আকাশে তুলে মাথা নিচু করে সে তারিফের উত্তরে যেন একটি বার্তা দিচ্ছিলেন— আল্লাই সব। আমি কেউ না। কখনও তাঁর গম্ভীর মুখ দেখিনি। সর্বদাই হাসি হাসি মুখ। তাঁর পাশে বসে থাকলেও ভাল লাগত। অথচ এই সাদামাটা আদ্যন্ত ধার্মিক মানুষটির জন্যই না সিনেমা হলে একের পর এক ছবি ‘সিলভার জুবিলি’ বা ‘ডায়মন্ড জুবিলি’ পার করেও সমানে টেনেছে দর্শক।

Advertisement

তাঁর চলে যাওয়ার এত বছর পরেও রফিসাবকে মিস করি। এই তো গত বছর দিল্লির সিরি ফোর্টে তাঁর মৃতুবার্ষিকীতে ‘ট্রিবিউ টু মহম্মদ রফি’ উপলক্ষে আমাকে ডাকা হয়। রফিসাবের ছেলেমেয়ে-নাতি-নাতনিরা প্রায় সবাই এসেছিলেন। ‘মহম্মদ রফি ট্রাস্ট’ থেকে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয় আমার হাতে ।

বলিউডে শুরু থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার গভীর বন্ধুত্ব। ‘বিশ সাল বাদ’ ‘কোহরা’ ছাড়া তিনি গান গেয়েছেন আমার প্রায় সব ছবিতেই। হিন্দি ছবিতে আমার সাফল্যের পিছনে তাঁর বিশাল অবদান। আর শুধু আমার কেন? দিলীপকুমার থেকে বিশ্বজিৎ, এমন কী জনি ওয়াকার— সবার সাফল্যের পিছনেই ছিল ওই স্বর্ণকণ্ঠীর অনলস চর্চা আর সাধনা। যা তাঁকে কিংবদন্তি করে তুলেছিল।

Advertisement

একটু আধটু গানবাজনা আমিও করেছি, গান আমিও বুঝি। বলিউডে এক-সে-এক গায়ক। কিশোরকুমার, মুকেশ, মান্না দে, মহেন্দ্র কপূর। প্রত্যেকেই বড় গায়ক। যে যার নিজের জায়গায় দুরন্ত। কিন্তু আমার বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে, প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে রফিসাবের কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। তিনি ছিলেন সবার আগে। একে তো তাঁর ওই মেলোডিয়াস কণ্ঠস্বর। তার পরে কী রাগাশ্রয়ী, কী ভজন, কী রোম্যান্টিক, কী রক-অ্যান্ড রোল (‘হমদম মেরে মান ভি যাও, ‘এপ্রিল ফুল বনায়া’র মতো গান)— এমন রেঞ্জ সেই যুগে আর কারও ছিল কি?

সিচুয়েশন অনুযায়ী গান গাওয়ায় তাঁর জুড়ি ছিল না বললেই হয়। জাস্ট একবার চোখ বুজে ভাবুন ‘নাইট ইন লন্ডন’ ছবির ‘ও মাই লভ’ গানটি। অথবা ‘মেরে সনম’ ছবির ‘পুকারতা চলা হু ম্যায়’ বা ‘টুকরে এ মেরে দিলকে বরবাদ এ তেরা আঁসু’। তাঁর মতো গুণী গায়ক যে-কোনও যুগে বিরল। রেকর্ডিংয়ের আগে রিহার্সাল করতেন ১২-১৪ দিন। জেনে নিতেন কোন নায়কের জন্য গাইবেন। স্টুডিওয় আমাকে ডেকে নিতেন রেকর্ডিংয়ের দিনে। আমার মতে, তাঁর কণ্ঠসম্পদ আর গায়কি ছিল তুলনাহীন। অসাধারণ।

‘দো দিল’ ছবিকে হেমন্তদার সুরে গেয়েছিলেন ‘তেরা হুস্নু রহে ইয়া মেরে ইশকি রহে’। ‘সেহনাই ছবিতে ‘না ঝটকো জুলফো সে পানি’। কী দরদ! কী আবেগ! অথচ পর্দায় দেখলে কখনও মনে হবে না এ সব গান গাইছেন রফিসাব। দর্শকদের মনে হত, পর্দায় নায়ক বিশ্বজিৎ নিজেই যেন গাইছেন আজও কানে বাজে এ সব গান।

আমি মান্নাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ক্লাসিক্যাল গানে আপনি তো সবার আগে। তা হলে প্লে-ব্যাক গায়ক হিসেবে কেন এগিয়ে রাখেন রফিসাবকে? নির্দ্ধিধায় মান্নাদা বলতেন, ‘রফিই এক নম্বর ঘোড়া। হ্যাঁ, হয়তো ক্লাসিক্যালে আমি একটু এগিয়ে। কিন্তু ‘টোটালিটি’তে বা ‘ভয়েস থ্রো’তে ও তুলনাহীন।’ দেব আনন্দ, বা রাজেশ খন্নার লিপে কিশোরকুমারও অসাধারণ। কিন্তু রফিসাব সবার জন্য। সে নায়কই হোক কি সাধুবাবা অথবা পানওয়ালা। ‘হি ইজ গ্রেটেস্ট’। সব জায়গায় বলি। ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়েছি শো করতে। রাতে হঠাৎ শুনি স্টিল ব্যান্ডে বাজছে পরিচিত হিন্দি গানের সুর— ‘সুহানি রাত ঢল চুকি’। ঘর থেকে বাইরে এসে দেখি ব্যান্ড বাজাচ্ছে কয়েক জন কৃষ্ণাঙ্গ। হিন্দি বোঝে না কিন্তু সুর চেনে। বিদেশে সব জায়গায় শো করতে গিয়ে শুনেছি, ‘পুকারতা চলা হু ম্যায়’ আর ‘ও মাই লভ’ গাওয়ার আবদার।

আর শুধু গায়ক হিসেবেই যে তিনি সবার আগে তা নয়, এমন নিরহংকার, সজ্জন, নিজের সাফল্যেও নির্বিকার কোনও মানুষের সাক্ষাৎ আজ পর্যন্ত পাইনি।

তাঁর জন্মই হয়েছিল গান গাওয়ার জন্য। কত বার তাঁকে দেখেছি না গুনেই পারিশ্রমিক পকেটে ঢুকিয়ে নিতে। প্রয়োজনে বিনা পারিশ্রমিকেও গান গেয়েছেন। কাউকে ফেরাতেন না। সব অর্থেই তিনি ছিলেন হিন্দি সিনেমার নায়ক, সুরকার-গীতিকারদের ‘মসিহা’।

সাক্ষাৎকারভিত্তিক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement