শনিবারের নিবন্ধ...

পাশের বাড়ি

কবে যে হুশ করে দূরে চলে গেল! লিখছেন শ্রীজাতএকদিন হঠাৎ যদি ঘুম ভেঙে দেখি সামনের রোয়াকে ঘোষবাবু-রায়মশাইরা আড্ডা দিচ্ছেন না আর? মানিকদার মুদির দোকানে বেলা বাড়তে না বাড়তে গতকালের ম্যাচ নিয়ে জমে উঠছে না তর্ক? যদি দেখি সাতসকালে বাবার হাতে মার খাওয়ার ভয়ে এ গলি সে গলি পেরিয়ে সাঁ করে পুস্কানদের বাড়ি ঢুকে পড়ছে না ক্লাস সেভেনের রাজা?

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৪ ০০:০৫
Share:

একদিন হঠাৎ যদি ঘুম ভেঙে দেখি সামনের রোয়াকে ঘোষবাবু-রায়মশাইরা আড্ডা দিচ্ছেন না আর?

Advertisement

মানিকদার মুদির দোকানে বেলা বাড়তে না বাড়তে গতকালের ম্যাচ নিয়ে জমে উঠছে না তর্ক?

যদি দেখি সাতসকালে বাবার হাতে মার খাওয়ার ভয়ে এ গলি সে গলি পেরিয়ে সাঁ করে পুস্কানদের বাড়ি ঢুকে পড়ছে না ক্লাস সেভেনের রাজা?

Advertisement

কিশোর কল্যাণ সংঘের ছোট মাঠটায় হাতে হাত লাগিয়ে ফাংশনের ম্যারাপ বাঁধছে না রিন্টু-মনা-বাপি-সেলিম-আশুদের দল?

যদি দেখি এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি ডিশ চাপা মাছের ডিমের বড়া চালান হচ্ছে না আর?

বৃষ্টিতে কাপড় তুলতে এসে নাজেহাল হচ্ছে না অভ্র-আবিরদের নতুন গ্র্যাজুয়েট বৌদি?

আর যদি হঠাৎ একদিন দেখি পাশের বাড়ির ছাদে পড়া শেষ করে এসে বিকেলবেলায় দাঁড়াচ্ছে না খোলা চুলের স্কার্ট পরা পম্পি? যদি দেখি পাশের বাড়িটাই নেই আর?

কেমন ছিল সেই সব পাড়াগুলো? আর সেই সব পাশের বাড়ি? আমরা যারা এই প্রায় চল্লিশের চৌকাঠে, তাদের কৈশোর অবধি দিব্যি বেঁচে ছিল অলিগলির এই পাড়া সাম্রাজ্য, যেখানে এ বাড়ির সঙ্গে ও বাড়ির পাঁচিলটা নেহাতই এক টুকরো অজুহাত হয়ে থাকত, তার বেশি নয়। সে সব কমন প্যাসেজ আসলে ছিল মন প্যাসেজ। কারণ পাশের বাড়ি তো শুধু পাশের বাড়িই ছিল না, আমার বাড়ি, আমাদের বাড়িও বটে। আজ আর আছে কি?

কথায় কথায় আক্ষেপের সুরই উঠে এল দক্ষিণ কলকাতার এক বাসিন্দার গলায়। বন্দনা রায়, সত্তরের কাছাকাছি বয়স, সব চুল সাদা, মন এখনও রঙিন। তবে সে রংও আজ সেপিয়ার দিকে ঢলে পড়ছে।

“আমরা তো ওপার থেকে এসেছিলাম, তখন ছোট্ট একটা কলোনি ছিল। সবাই মিলেমিশে থাকতাম। ভাল হোক, মন্দ হোক, সব ভাগ করে নিয়েছি। মনে আছে, আমার ছেলে মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করায় পাশের পাড়ির মনুদা সারা পাড়ায় মিষ্টি বিলি করেছিলেন। ওঁর আনন্দ আমাদের চাইতে কিছু কম ছিল না”...কথাগুলো বলতে বলতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল তাঁর।

ঠিক এর উল্টো সামাজিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে উত্তর কলকাতার এক প্রৌঢ়ের বক্তব্যও কাছাকাছি। দেবোত্তম মুখোপাধ্যায়, যথারীতি পাড়ার দেবুদা। পাঁচ পুরুষের বাসিন্দা এই শহরে, বনেদি পাড়ায় রোজ বিকেলে পাশের বাড়ির রোয়াকে জমিয়ে দাবার আড্ডাটা আজও ভুলতে পারেন না। যেমন ভুলতে পারেন না কী ভাবে তিনি শহরের বাইরে থাকাকালীন তাঁর অসুস্থ মেয়েকে মাঝরাতে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন ওই পাড়ারই অন্যান্য বাড়ির মানুষজন। ‘ওরা না থাকলে সেদিন মেয়েটা বাঁচতই না আমার’ অকপটে স্বীকার করলেন তিনি।

এমনই তো ছিল পাশের বাড়ির লোকজন। বিপদ থেকে আনন্দ, পরীক্ষা, শোক থেকে সাফল্যে যারা মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত।

তবে মফসস্ল এলাকায় এই এ-বাড়ি ও-বাড়ির জাপটাজাপটি আদরটা বোধ হয় আরও বেশি ছিল। ‘তখন তো নভেম্বরে ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে যেত। আর সব বাড়িতে অন্তত দু’জন বাচ্চা থাকতই। ফলে সে এক দেদার আনন্দের সময়,’ বলছেন একদা রানাঘাটের বাসিন্দা জয় গোস্বামী। “শীতের ছুটিতে পাশের বাড়িতে আত্মীয়েরা এলে আমাদেরও মজা। তারা তখন আমাদেরও আত্মীয়। তাদের সঙ্গেই খেলেধুলে কেটে যেত ছুটির দিনগুলো। কখনও আলাদা বাড়ির মানুষজন বলে মনেই হত না তাদের,” বলছেন জয়।

“একবার হয়েছে কী, মা তখন স্কুলে গিয়েছেন, এ দিকে মাস্টারমশাইয়ের ভয়ে আমি আর ভাই পেয়ারাগাছে চড়ে বসেছি। মাস্টারমশাইও তেমন, তিনি পড়াতে এসে নীচে দাঁড়িয়েই নিউটনের থার্ড ল জিজ্ঞেস করছেন। ওদিকে পাশের বাড়ির রেবা, ভুতু, কনক তো দেখছে আমরা দুই ভাই পেয়ারাগাছে। তারা তো আর পাঁচিলের এপাশে গাছের নীচে দাঁড়ানো মাস্টারমশাইকে দেখতে পাচ্ছে না। ব্যস, সক্কলে মিলে চেঁচিয়ে পেয়ারা চাইতে শুরু করেছে। হঠাৎ ভাই খুব গম্ভীর গলায় উত্তর দিল দেখতে পাচ্ছিস না আমরা পড়া করছি? সেই ঘটনা আজও ভুলিনি,” বলতে বলতে হেসে ফেললেন ‘মা নিষাদ’-এর কবি।

কী আশ্চর্য! আরেকজনের পাশের বাড়ির স্মৃতিতেও ঝলমল করছে একটা পেয়ারা গাছ। “বাবার ছিল বদলির চাকরি, তা একবার আমরা থাকতে এলাম কাটিহারের সাহেবপাড়ায়” স্বভাবসুলভ গল্পের ছলে শুরু করলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। “তখন তো পুরোদমে ইংরেজ আমল, বেশ কয়েক ঘর সাহেব তখনও রয়েছে সেখানে। আমাদের বাড়ির ঠিক পিছনেই ছিল এক সাহেবের বাংলো, তার তিন ছেলে এক মেয়ে। তাদের বাড়িতে চমৎকার একখানা পেয়ারাগাছ ছিল, তাতে ভারী সুস্বাদু কাশীর পেয়ারা ফলত। একদিন দুপুরে দেখি, সেই সাহেবের ছেলেমেয়েরা গাছে উঠে পেয়ারা পেড়ে খাচ্ছে। আমার তো খুব লোভ হল। এদিকে মুখচোরা, চাইতেও পারছি না। শেষমেশ আমাদের বাড়ির কাজের ছেলে টুনটুনিয়াকে এগিয়ে দিলাম। সে ওদের দেহাতি হিন্দিতে কী বলল কে জানে, কিন্তু ওরা দিব্যি টপাটপ পেয়ারা পেড়ে আমাকে দিয়ে দিল। খেতে গিয়ে দেখি পেয়ারার গায়ে ওদের গায়ের কী সুন্দর গন্ধ লেগে রয়েছে। সেই গন্ধটা আজও মনে পড়ে,” বলতে গিয়ে বেশ নস্টালজিক হয়ে পড়লেন ‘পার্থিব’র স্রষ্টা।

ওই দুপুরের গন্ধ, ওই পেয়ারার গায়ে লেগে থাকা বিদেশি বন্ধুদের গায়ের গন্ধটুকুই আসলে পাশের বাড়ির গন্ধ, পাশের মানুষজনের স্মৃতি। আর সেই স্মৃতিতে একফালি জায়গা প্রেমেরও আছে বৈকি।

এ বাড়ির একুশের সঙ্গে ও বাড়ির উনিশের চাউনি বিনিময় তো হৃদয়ের রোজকার রুটিন ছিল। এই ছাদ থেকে ওই ছাদে ভেসে যাওয়া রুমাল তো জানতই অনেক গোপন কথার মানে। আর এই জানলা থেকে রেডিয়োয় লতার গান ভেসে যেতই ওই জানলার ধারে রাখা পড়ার টেবিলে।

কিছুতেই মন বসাতে না পেরে ছেলেটি শেষমেশ রাতের চিঠিতে লিখত, ‘বিন্তি কেমন আছ? বিপদ আমার... পরশু বিএ পার্ট টু, কী জানি কী লিখব খাতায়...’

এমনটা অনেক হয়েছে। জীবনে তো বটেই, জীবন থেকে টুকে সাহিত্যে আর ছবিতেও কম হয়নি। এক সময় বাংলা ছবিতে সাধারণ শার্ট প্যান্ট আর ছাপোষা শাড়ি পরা নায়ক নায়িকাকে দেখা যেত। তারা টেলিফোনে কম আর মুখোমুখি বেশি কথা বলত। কারণ তারা থাকত একে অপরের পাশের বাড়িটাতেই। প্রথম প্রথম মুখ ফিরিয়ে নেওয়া থেকে শেষমেশ মুখ কাছে আনার জার্নিটুকু ঘটে যেত একটা ছোট্ট পাড়ার মধ্যে।

ভেবে দেখতে গেলে, এই বাংলার সেরা রোম্যান্টিক জুটির দুজনেই তো পাড়া-প্রেমের আইকন। এমনকী হিন্দিতেও ‘পড়োশন’ বা ‘এক দুজে কে লিয়ে’ সেই পাশের বাড়ির প্রেমকেই সেলিব্রেট করেছে। আর হিন্দি সিরিয়ালের গোড়ার দিকের ‘নুক্কড়’ তো সম্ভবত পাড়া-সংস্কৃতির সেরা নিদর্শন।

অবশ্য এ হেন প্রেমে পাড়ার পুজো অথবা রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীর অবদান নেহাত কম নয়। মধ্যবিত্ত বাঙালি পাড়ায় পুজো মানেই চির আকাঙ্ক্ষিত মেয়েটির পাশে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি দিতে পারার অধিকার।

ঠিক যেমন বেলেঘাটার চল্লিশ ছুঁই ছুঁই রণজিৎ ওরফে রনি চোখ বুজলে আজও মনে করতে পারেন পাড়ার হার্টথ্রব রিনির কাছ থেকে হাত পেতে প্রসাদ নেওয়ার সময়ে মিহি চাউনি বিনিময় আর সন্ধের চেয়ার জড়ো করা আড্ডার ফাঁকে চকিত চিরকুট চালান। সে সব চাউনি পরের পুজোর হাওয়াতেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল, রনি-রিনি অনুপ্রাস বেশি দিন টেকেওনি। কিন্তু আস্তিনের এক ভাঁজে সে সব সন্ধের গন্ধ এখনও যত্ন করে তুলে রেখেছেন রনিবাবু।

এর পাশাপাশি চরম প্রেমের সুযোগ করে দিয়ে গিয়েছেন দুই গানওয়ালা। তাঁদের জন্মদিন পালনে বাঙালি পাড়ার মতো হার্দিক উদ্যোগ আর কোথাও দেখিনি। বিনিময়ের প্রত্যাশাহীন ভালবাসা নিয়ে দাদা-কাকা-মাসিমাদের পনেরো দিন ব্যাপী খাটাখাটনি যে সন্ধেয় রূপ পেল, সেদিন একটা না একটা ‘বধু কোন আলো’ চোখে এসে লাগবেই লাগবে। হয়তো কালবোশেখির তোড়ে উবে যাবে শতরঞ্চি, হয়তো লোডশেডিং এসে মাঝপথে থামিয়ে দেবে চূড়ান্ত আবৃত্তি, কিন্তু প্রেম আটকাবে না।

ঠিক যেমন নাকতলার বাবুয়া আর শ্যামলী। রবি ঠাকুর পুজোর সন্ধেবেলা চিত্রাঙ্গদারূপী শ্যামলীকে অতিরিক্ত ফোকাসে ধরতে গিয়ে পা হড়কে বাবুয়া সোজা নর্দমায়, অতঃপর বিছানায় দেড়মাস। সেই পা-ভাঙা পর্যায়ে অবশ্য জুড়ে গিয়েছিল দুই হৃদয়, আর সেই মজবুত জোড়ের সাক্ষী ছিল হাত-বদল হওয়া একখানা ‘শেষের কবিতা’। বাবুয়া আর শ্যামলীর কবিতাটা কিন্তু আজও লেখা হয়ে চলেছে।

এ সব তো আগেকার কথা। সেই পাড়াতুতো ভালবাসার প্যান্ডেলগুলো কি আজও বাঁধা হয়? কর্পোরেট পুজোর ভিড়ে, স্পনসর্ড রবীন্দ্র-নজরুলের ধামাকায় সেই কেবলমাত্র আনন্দের খাতিরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলা দাদা-কাকারাও এখন রিটায়ার্ড। বলা ভাল রিটায়ার্ড হার্ট। আর তার পরের প্রজন্মের হাতে তো অবসরের সন্ধে বলে কিছুই নেই। চাউনি উড়বে কোন আলোয়?

প্রেমের পাশের মাঠেই ছিল ক্রিকেট আর ফুটবলের চকখড়ি। শীত আর গরমের ছুটিতে নিয়ম করে আর বন্ধের দিনে নিয়ম ভেঙে দেদার ম্যাচ। তিন ওভারের ম্যাচ যেমন ছিল, তেমনই থাকত দু’ফুট চওড়া গোলপোস্ট। দুপুর বিকেল নাগাদ ডাক পড়লেই দুদ্দাড় করে সক্কলে হাজির। ছোটবেলার তো কোনও ধর্ম আর জাত থাকে না, তাই সকলের সাদর আমন্ত্রণ।

বাড়ির ছেলেও খেলছে, বাড়ির খাওয়া -পরার কাজের ছেলেটিও খেলছে। আর খেলছে মেয়েরা। কোমরে ওড়না বেঁধে দিব্যি বল হাঁকাচ্ছে, নো বলে আউট দিলে আম্পায়ারকে দু’ঘা বসিয়েও দিচ্ছে। আর ফ্রি কিকে গোল দেওয়ার পর সাত জনের টিম ঘামে মাখামাখি হয়ে নাচছে।

সন্ধে হয়ে আসা সেই সব ক্রিকেট ফুটবলের পাড়াগুলো টপশটে দেখলে মনে হত, একটা যৌথ পরিবার মাঠে নেমে এসেছে বুঝি। সেই সব মাঠেও এখন ফ্ল্যাট উঠে গিয়েছে, সেই সব ছেলেমেয়েরাও আজ দূরে দূরে। শুধু কি খেলাধুলো আর প্রেম? আত্মীয়তার সব ক’টা চেহারাই পাশের বাড়ির রঙে লুকিয়ে থাকত।

পাশের আর নিজের বাড়ির মধ্যেকার তফাত বুঝতে বুঝতে কৈশোর পেরিয়ে যেত তখন। যেমন বাড়িতে বাবা-কাকা, তেমনই পাড়াতুতো টেরর-এর রোলে দিব্যি মানিয়ে যেত মনার জ্যাঠা বা রন্টুর জাঁদরেল বাবাকে। তাঁদের সামনেও কোনও ট্যাঁ ফোঁ-র সাহস রাখত না উঠতি যুবকেরা। কারণ তাঁরাও নিজেদের বাবা-কাকার চাইতে কিছু কম স্ট্রিক্ট নন। সদ্য সিগারেট হাতে তাঁদের মুখোমুখি পড়ে যাওয়ার চাইতে এক খাঁচায় বাঘের সঙ্গে রাত কাটানোও বোধ হয় শ্রেয় ছিল। সেই সব দোর্দণ্ডপ্রতাপ পাড়াপুরুষদের কেউই অন্যের বাবা-জ্যাঠা বলে ভাবতে পারেনি।

যেমন আমাদের পরিবার থেকে আলাদা করে কখনও ভাবিনি পিন্টুদা আর বুয়াদাকে। যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম, সে বাড়ির দুই ছেলে। আমার চাইতে বয়সে বেশ খানিকটা বড়। তো সেই বুয়াদার কাছে এক সময় অঙ্ক করতে যেতাম আমি। বুয়াদা ছিল কৈশোর জীবনের অন্য এক জানালা।

এক দিন কাজ থেকে ফিরেই হাঁক পেড়ে বলল, ‘চলে আয়, একটা নতুন ক্যাসেট এনেছি, এক জন ভাল গাইছে।’ গানের নাম শুনেই দুদ্দাড় করে দোতলায় বুয়াদার ঘরে। সেই বুয়াদার হাত ধরেই প্রথম থিয়েটার দেখা, অ্যাকাডেমিতে। সেই বুয়াদার ঘরে বসেই প্রথম শোনা জগজিৎ-লতার ‘সজদা’।

আবার এক বর্ষার দুপুরবেলা বারুইপুর স্টেশনের ধারের ঘুপচি হোটেলে প্রথম রুটি আর কষা মাংসের স্বাদও সেই বুয়াদার দৌলতেই।

আজ ভাবি, কেন আমার মতো একজন অপরিণত কিশোরের সঙ্গে সে ভাগ করে নিয়েছিল অত কিছু? কারণ একটাই, পাশের বাড়ির মানুষকে কাছের মনে হয়েছিল তার। নিজের ভাই থাকলে সে ঠিক যা যা করত, আমাকে নিয়েও সেটুকুই করেছে। আর তার মধ্যে আলাদা করে কোনও বিশেষত্বও দেখেনি। কেবল আমি অঙ্ক খাতাটার বাইরে একটা বিরাট দিগন্ত দেখতে পেয়ে গিয়েছি, অজান্তেই।

এখন পর্যন্ত এ লেখায় সবই অতীত। তা হলে কি ধরেই নেব, ‘আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি’? আসলে ঘরগুলোই তো ভেঙে গিয়েছে একে একে, তৈরি হয়েছে অ্যাপার্টমেন্ট। সত্যিই আমরা হয়তো এখন অ্যাপার্ট। প্রেমের উঠোন ভাগ হয়ে তৈরি হয়েছে প্রেমাইসেস, ছাদের মাদুর পালটে হয়ে গিয়েছে কার্পেট এরিয়া। তবে এত সব নেগেটিভের মধ্যেও সময় কি ঠিক খুঁজে বার করে আনছে না একটা দুটো পজিটিভ প্রিন্ট?

“আমরা বাবা-মা-র কাছে শুনেছি পাশের বাড়ির কথা, এখানে তো ওভাবে কিছু হয় না, বড্ড ক্লাস্টার্ড জায়গা”, বলছিল নিউ আলিপুরের নতুন এক অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা কলেজ পড়ুয়া দুই ভাইবোন অপরূপ আর অনিন্দিতা রায়চৌধুরী।

“কিন্তু আমরা কোচিং-এর বন্ধুবান্ধবেরা মিলে দারুণ হইচই করি, এবারে তো একটা ফিল্ম ক্লাবও শুরু করব ভাবছি,” বেশ উচ্ছ্বাসের সঙ্গেই বলল অনিন্দিতা। “আর আমার হস্টেলের বন্ধুরাও মাঝেমধ্যেই বাড়িতে এসে আড্ডা দেয়, থেকেও যায়। সেটাও তো একটা পাড়া ফিলিং,” বলছে বছর একুশের অপরূপ।

একুশে যখন পা দিয়েছে শতক, তখন বদল তো আসবেই। “সারা বছর নিজেদের কাজে প্রায় মুখ দেখাদেখি না হলেও, পুজোর চারটে দিন মানে ভোর থেকে রাত একসঙ্গে ওঠা বসা, খাওয়া আর আড্ডা। এই ৮০টা ফ্ল্যাটের সক্কলে সারা বছর ধরে অপেক্ষা করে ওই চারদিনের জন্য”, বেশ গর্বের সঙ্গেই বললেন লেকটাউনের এক আবাসনের পুরোনো বাসিন্দা রঞ্জনা প্রধান।

কিন্তু সব ক্ষেত্রে ছবিটা বোধ হয় এত পজিটিভও নয়। ছোটখাটো দরকারে তো দূরস্ত, এমনকী ঘোর বিপদ হলেও সামনের ফ্ল্যাটের দরজায় মাঝরাতে টোকা দিতে সঙ্কোচই হয়। যদি বিরক্ত হয়? বলছিলেন রাসবিহারী অঞ্চলের রুমা ঘোষ।

“আমরা তো আগে পাড়াতেই থাকতাম, ভাড়ায় যদিও, কিন্তু একটা ফ্যামিলি ফিলিং ছিল, জানেন। রাতবিরেতে কাউকে ডাকতে গেলে কখনও দু’বার ভাবতে হত না। সেইটা খুব মিস করি,” অকপট স্বীকারোক্তি রুমাদেবীর।

আসলে ও বাড়ি থেকে এ বাড়িতে কখনও ট্যাংরা মাছের ঝাল আসেনি, এ বাড়ি থেকে ও বাড়িতেও কোনও দিন যায়নি একটা পুজোর ফতুয়া। তাই বিপদেও সাহায্যের হাত নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। উল্টে অ্যাপার্টমেন্টের অন্যান্য বাসিন্দাদের বিরোধিতা আর অসহযোগিতায় বাসস্থান থেকে মনই উঠে যেতে বসেছে। সামান্য এক আধটা প্রয়োজনে বাকিরা এমন বেঁকে বসেছেন যে ভবিষ্যতে তাঁদের সঙ্গে কথা বলবার প্রবৃত্তিটুকুও হারিয়ে ফেলছেন তিনি।

পৃথিবীটা কি ছোট হতে হতে কেবল নিজের জানলাতেই এসে ঠেকল তা হলে? ঘরের পাশেই যে আরশিনগর, যেখানে এক পড়শি বসত করে... সত্যিই কি তাকে একদিনও আর দেখব না আমরা? শুধু স্কোয়্যার ফিটের চৌখুপিতে আটকা পড়ে যাবে আমাদের যত ভাবনা? লোকালের আকুলতা ছেড়ে গ্লোবাল ভিলেজের দূরতর দ্বীপ হয়ে ভেসে থাকব, আর মনকে বলব, ‘আমরা দু’জন একটি গাঁয়ে থাকি/ সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ’? লোডশেডিং-এর জোনকির মতো ছোট ছোট পাড়াগুলোও টুপটাপ করে মুছে যাবে আমাদের ম্যাপ থেকে? আর বহু বহু বছর পর মাটির নীচ থেকে যখন আবিষ্কার করা হবে লাগোয়া দুটো ছাদ, মাঝের পাঁচিলে এলিয়ে পড়ে থাকা একটা ওড়নার কঙ্কাল আর লেখা ধুয়েমুছে যাওয়া একটা ছেঁড়া চিরকুট... তখন গভীর গবেষণা করে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা সেই আবিষ্কারের এক আশ্চর্য সুন্দর নাম রাখবেন‘পাশের বাড়ি’।

পাশাপাশি

পুঁইশাক রাঁধলে আমায় দিয়ে যায়
​মাধবী মুখোপাধ্যায়

আমার ‘পাশের বাড়ি’টা প্রায় একই রকম রয়ে গেছে। তফাত কিছু বুঝি না। আমার ছোটবেলা অনেক জায়গায় কেটেছে। বরিশালের কলসকাঠির বাড়িতে আমার থাকা হয়নি। সে গেছি, যখন মহেন্দ্র গুপ্তর ট্যুরিস্ট থিয়েটারে ছিলাম। বরিশাল, খুলনা, ফরিদপুর। চোখের দেখা দেখে চলে এসেছি।

আমার ছেলেবেলা কেটেছে উত্তর কলকাতায়। ৩৩ নম্বর বাগবাজার স্ট্রিটের ওই বাড়িটা ছিল শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির কাছে। এখন ভাঙা পড়েছে। ওই ভাড়াবাড়ির পর অনেক জায়গাতেই থেকেছি। আহিরীটোলা, গ্রেস স্ট্রিট এক্সটেনশন, কাশী মিত্র ঘাট স্ট্রিট...। সবখানেই ঘেঁযাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলোর মতো মানুষগুলোও কেমন যেন কাঁধে-কাঁধ লাগিয়ে দিন কাটাত।

এখন আমি যেখানে থাকি সেই গোবিন্দপুর রোডের কমপ্লেক্সটাও ঠিক যেন আমার ছেলেবেলায় ফেলে আসা বাড়িগুলোর মতো। লেক গার্ডেন্সের শেষে একই কম্পাউন্ডে ৭২টা ফ্ল্যাট।

আমার ফ্ল্যাটের নীচেই থাকেন এক ভদ্রমহিলা। তাঁর স্বামী রাইটার্সে চাকরি করতেন। একটু অন্যরকম করে দই পাতলেও তিনি আমায় দিয়ে যান। আমি পুঁইশাক খেতে ভালবাসি। যে যখন পুঁইশাক রাঁধেন, আমায় খাওয়ান। এমন শুধু আমি বলে নয়, সবার কাছেই এই একই কথা শুনবেন। অসুখ-বিসুখ হলেও এ-ওর পাশে।

পুজোর সময় গানবাজনা, নাটক হয়। মজার একটা খেলা হয়। লটারির। সে লটারিতে জিতলে এক-এক রকম পুরস্কার। তাতে কেউ সব্জি পেল, তো কেউ ঝাঁকা, তো কেউ আবার কসমেটিকস।

আমরা খুব মজা করে থাকি। আজকাল শুনি, একা যাঁরা থাকেন, তাঁরা নাকি মারা গেলে এক-এক সময় সৎকার করারও লোক পাওয়া যায় না। আমাদের এখানে কিন্তু তা হয় না। কমপ্লেক্সের লোকজনই দায়িত্ব নিয়ে সেসব কাজ করেন।

আসলে কী জানেন, আমার মনে হয়, আমরা যাঁরা মিশতে ভুলে গেছি, তাঁদের মধ্যেই হা-হুতাশটা বেশি। মিশতে জানলে পাশের বাড়িই বলুন আর পাশের মানুষই বলুন, সঙ্গীর অভাব হয় না কোনও কালেই।

বাড়ির বড় কাউকে যেমন চোখে
দেখতাম জ্যোতিষ জ্যাঠাকেও তাই

​সুচিত্রা ভ্যট্টাচার্য

আমার বাপের বাড়ি লেক মার্কেটে। ও বাড়ির পাশেই থাকতেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জ্যোতিষ গুহ। আমরা জ্যাঠা ডাকতাম। বাবা-কাকারা ওঁকে দাদা বলতেন। একেবারে বাড়ির বড় কাউকে যে চোখে দেখতাম, জ্যাঠা ছিলেন আমাদের কাছে তেমনই।

অনেক দক্ষিণী পরিবারও থাকতেন ও পাড়ায়। ওদের কারও না কারও বাড়ি থেকে ইডলি, ধোসা, মুড়ুক্কু যখন তখন আমাদের বাড়িতে চলে আসত। এখন আর পাড়াটা তেমন নেই। কেউ কাউকে যেন চেনেই না।

আমি এখন ঢাকুরিয়ায় যেখানে থাকি, রেল লাইন টপকে যেতে হয়। এ দিকটা তা’ও এক রকম। লাইনের ও দিকটা, এক্কেবারে পাল্টে গেছে। আমাদের পাড়াতেও তার হাওয়া লাগল বলে। পাশের বাড়িতে কেউ মারা গেলেও টের পাই না। এই তো কিছু দিন আগে এক বৃদ্ধা চলে গেলেন। একেবারে নিঃসাড়ে।

আমাদের নীচের ফ্ল্যাটের এক মহিলা অবশ্য অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখেন। আমার বাড়িতেও কেউ-কেউ আসেন। এক ডাক্তার ভদ্রলোক আছেন কাছেই। তিনিও দরকার পড়লে, খবর দিলে ছুটে আসেন। ধীরে ধীরে এগুলোও বোধহয় হারিয়ে যাবে।

একমাত্র রাস্তায় জল জমলে এ বাড়ি ও বাড়ি মিলে যায়
​দেবশঙ্কর হালদার

পাইকপাড়ার জীবনকৃষ্ণ মিত্র রোডেই ছিলাম। এখনও সেখানে আছি। তফাত বলতে, আমাদের সেকেলে বাড়িটা ভেঙে চার তলা হয়েছে। এ পাড়ায় শুরু থেকেই মধ্যবিত্ত-নিম্ন-মধ্যবিত্তদের বাস। দুটো বস্তি। এক বাড়ির ছাদ থেকে অনায়াসে অন্য বাড়ির ছাদে যাওয়া যায়।

ছেলেবেলায় দেখতাম, মা রান্না বসিয়ে নুনটা, হলুদটা কম পড়লে দিব্যি পাশের বাড়ি থেকে বাটি করে আনতেন। আবার বাজার থেকে সে সব কিনে আনলে ফেরতও যেত বাটি করেই। এ বাড়ির রান্নায়, ও বাড়ির মশলা, সে এক অন্য রকম স্বাদ!

সব মিলিয়ে বাড়িগুলো আর ‘পাশের’ ছিল না। গোটা পাড়াটাই যেন আমাদের সকলের একটা বাড়ি। আমার বন্ধু বদা। বদার মা আমাদের মাসিমা। উনি একটু বেশিক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলে আমরা বুঝতাম কেউ নিশ্চয়ই ফিরতে দেরি করছেন। আমরা কেউ না কেউ তখন সদরে দাঁড়িয়ে মাসিমাকে অভয় দিতাম। “এই ফিরে আসবে, দেখুন না। ওদিকটায় আজকাল খুব জ্যাম হয়।” সেই দেরি করা মানুষটিকে যখন মোড়ের মাথায় এক ঝলক দেখা যেত, তখন কে আগে মাসিমাকে খবরটা দেবে, তা নিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। সে যেন বিশ্বকাপ জেতার মতো আনন্দ!

আমার বাবার হাঁপানি ছিল। খুব কাশতেন। বাবা তো যাত্রাদলে ছিলেন। পাশের বাড়ির লোক বাবার কাশি শুনতে না পেলে বুঝত, অভয়বাবু বাড়ি নেই। যাত্রায় গেছেন।

দাদার বিয়ে হবে। আমরা পাশের বাড়িকে না জানিয়েই ঠিক করে ফেললাম ও বাড়িতে ম্যারাপ বাঁধা হবে। জানি যে, ও বাড়ি কোনও আপত্তি করবে না। বরং অন্য জায়গায় ভাড়া নিলেই ওঁদের কষ্ট হবে। “আমাদের বাড়িটা থাকতে অত খরচার কী দরকার ছিল!”

শুধু বিশ্বকর্মা পুজোর সময় যখন ছাদে ছাদে ঘুড়ি উড়ত, তখনই কেবল মনে হত, এ বাড়িটা আমাদের, ওটা ওদের।

এখন আর সেদিন নেই, এ তো সত্যি। একগাদা রংচটা বাড়ির মাঝে আমাদের নতুন বাড়িটা যেমন চারপাশের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আমরাও কেমন যেন ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে বেঁচে থাকাটা রপ্ত করে ফেলেছি। আমাদের যে এখন নিজের নিজের ‘স্পেস’ চাই!

একমাত্র রাস্তায় যখন জল জমে, এ বাড়ির জল, ও বাড়িতে ঢুকে পড়ে, তখনই কেবল মনে হয়, পাশাপাশি বাড়িগুলো কেমন যেন মিলেমিশে গেল। বচ্ছরকার বাকি সময়টা এখন আমরা আলাদা-আলাদাই থাকি। পাশের বাড়িটা পুরনো শরীরেই হয়তো আছে। কিন্তু মনে মনে সে অনেক দূরে চলে গেছে।

সাক্ষাৎকারভিত্তিক রচনা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement