জলসাঘর

জলসাঘর এবং ছবি বিশ্বাস। দুটি যেন সমার্থক শব্দ। ১২ জুলাই তিনি ১১৫। লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য ১৯৬২-র ১১ জুন গাড়ি দুর্ঘটনায় ছবি বিশ্বাসের মৃত্যুতে বাংলা ছায়াছবি কার্যত এবং বাঙালি সমাজ প্রকারান্তরে একই সঙ্গে পিতৃহীন হল। বাংলা সিনেমায় তত দিনে বাবার রোল মানে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ছবি বিশ্বাস, আর বাঙালি বাড়িতে বাড়িতে বাপ-জ্যাঠা-ঠাকুর্দাদের প্রায় ডাকনাম হয়ে গিয়েছিল ছবিবাবু। ছেলেপুলেরা সে সময় কোনও কোনও বাড়িতে সরস্বতী পুজোর চাঁদা চাইতে যেতে ডরাত, ছবি বিশ্বাসের ডায়ালগ শুনতে হবে বলে। ‘চাঁদা তো চাইছিস খুব, দিনে ক’বার বইয়ের পাতা ওল্টানো হয় শুনি!’

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৪ ০০:০৯
Share:

১৯৬২-র ১১ জুন গাড়ি দুর্ঘটনায় ছবি বিশ্বাসের মৃত্যুতে বাংলা ছায়াছবি কার্যত এবং বাঙালি সমাজ প্রকারান্তরে একই সঙ্গে পিতৃহীন হল।

Advertisement

বাংলা সিনেমায় তত দিনে বাবার রোল মানে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ছবি বিশ্বাস, আর বাঙালি বাড়িতে বাড়িতে বাপ-জ্যাঠা-ঠাকুর্দাদের প্রায় ডাকনাম হয়ে গিয়েছিল ছবিবাবু।

ছেলেপুলেরা সে সময় কোনও কোনও বাড়িতে সরস্বতী পুজোর চাঁদা চাইতে যেতে ডরাত, ছবি বিশ্বাসের ডায়ালগ শুনতে হবে বলে। ‘চাঁদা তো চাইছিস খুব, দিনে ক’বার বইয়ের পাতা ওল্টানো হয় শুনি!’

Advertisement

পাড়ার সুন্দরী মেয়েদের বাবারা তো ছবি বিশ্বাস ছিলেনই। যাঁদের দর্শন পাওয়া মাত্র তল্লাটের রোমিওরা নিমেষে অলিগলি বেয়ে বেপাড়ায় পাচার হয়ে যেত।

‘সপ্তপদী’ দেখে এসে এমন এক রোমিও রোয়াকে বসে কপাল চাপড়ে ছবির ক্রাইসিস বুঝিয়ে দিল, “সব ঠিকঠাকই যাচ্ছিল, ছবি বিশ্বাস এসে সব বিগড়ে দিল।”

এর পিছনের কারণটা বোঝা খুব কঠিন নয়। বাঙালি পরিবারের বাবা-জ্যাঠাদের দেখে ছবিবাবু যেমন তাঁর অভিনয় সাজিয়েছিলেন, তেমনই পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে বাড়ির বাবা-কাকারাও ওঁকে মডেল করে কায়দাকানুন রপ্ত করা শুরু করেছিলেন।

পাহাড়ি সান্যাল ও কমল মিত্রও সে সময় দিব্যি মানিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ির কর্তা বা জমিদারের রোলে। কিন্তু পরিবারের বয়স্কদের মেজাজমর্জিতে ভর করে থাকতেন ছবিবাবু।

উঠতি বয়সে ছোকরাদের কাছে যা ছিলেন উত্তমকুমার, পরিণতবয়সীদের কাছে তাই হয়েছিলেন ছবিবাবু। ছায়াছবির ছবি আর জীবনের ছবি প্রায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল।

অথচ ’৬২ সালে ওঁর মৃত্যু হল যখন, তখন ওঁর বয়সও মোটে বাষট্টি (জন্ম ১২ জুলাই, ১৯০০)।

১৯৪০-এ দেবকী বসুর ‘নর্তকী’ ছবিতে প্রবৃদ্ধ এক সাধুর অভিনয়ে অসাধারণ অভিনয় করেই প্রবীণ চরিত্রে প্রায় অবধারিত হয়ে উঠেছিলেন ভদ্রলোক। এর মাত্র চার বছর আগে, ১৯৩৬-এ, তিনকড়ি চক্রবর্তী পরিচালিত ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ ছবিতে প্রথম আবির্ভাবে ছবিবাবু কিন্তু নায়িকার স্বামীর ভূমিকায়।

জাকার্তা যাওয়ার পথে

মঞ্চের সফল অভিনয় থেকে রুপোলি পর্দায় এসে এত চমৎকার ধরে নিয়েছিলেন সিনেমার অ্যাক্টিং যে আগামী বিশ বছর ওঁর কাজের ঠিকানা হয়ে গেল ফিল্ম স্টুডিয়ো, আর ‘নর্তকী’-র সাফল্য ওঁকে অপরিহার্য করে তুলল প্রবীণ চরিত্রে। এতটাই যে, সত্যজিৎ রায় কবুল করেছিলেন ছবিবাবুর মৃত্যুতে উনি চিত্রনাট্যে প্রবীণ চরিত্র রাখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কারণ ওই শ্রেণির অভিনয় আর কোত্থেকে পাবেন?

আরও একটা মজার প্রসঙ্গ। ‘দেবী’তে সত্যজিৎ ছবি বিশ্বাসের ছেলের ভূমিকায় অভিনেতাটির অভিনয়ে খুব একটা খুশি হতে পারছিলেন না। তবু তাঁকে রেখেছিলেন কারণ ওঁর মুখের খুব মিল ছবিবাবুর মুখের সঙ্গে। পিতাপুত্রের মুখের এই আদলটা তিনি ছাড়তে চাননি।

খুব সাধারণ পরিবারের থেকে ক্রমে ক্রমে দর্পিত বড়লোক, জাঁদরেল পরিবারকর্তা বা জমিদারের ভূমিকায় যে ছবিবাবু জাঁকিয়ে বসলেন পঞ্চাশের দশকের একটা সময় থেকে, তারও কারণ সহজবোধ্য।

এক, উচ্চবিত্ত পরিবার নিয়ে বাণিজ্যিক ছবির একটা চলন শুরু হয়েছিল ওই সময়। সেখানে ছবিবাবুর জন্য, বলতে গেলে, চরিত্র ও সংলাপ লেখা হয়ে যাচ্ছিল।

আর দুই, ছবিবাবুর অভিজাত চেহারা, রাশভারী চালচলন, গম্ভীর ও কিছুটা আনুনাসিক কণ্ঠস্বর, ইংরেজি মিশিয়ে বাংলা বলার দাপুটে ডেলিভারি এবং অবশ্যই, পর্দাজোড়া উপস্থিতি একটা প্রায় টাইপকাস্টিং-এর দিকে ঠেলে দিচ্ছিল ওঁকে। কিন্তু ওঁর বাপ-জ্যাঠা-জমিদার বনাটা যে নিছকই টাইপকাস্টিং হল না তারও কারণ আছে। প্রথমত অভিনয়, সংলাপ বলা, ধরা, ছাড়া, হাতে পাইপ কী গায়ে আলোয়ান বা ড্রেসিং গাউন, চোখের কোণ দিয়ে ভ্রুকুটি, কী ভুরু ও চোখ তুলে জিজ্ঞাসার চাহনি— সব মিলিয়ে এমন এক নাটকীয় প্যাকেজ যে টাইপকাস্টিং-এর একঘেয়েমি কখনও ভারাক্রান্ত করার সুযোগ পায়নি ওঁর কাজকে।

টাইপ অতিক্রম করে ওঁর অভিনয় চরিত্রগুলোকে সুন্দর রক্তমাংসের মানুষ করে তুলত। যার এক চমৎকার উদাহরণ ‘সপ্তপদী’তে নায়ক কৃষ্ণেন্দুর পিতার চরিত্রায়ণ। অমন এক চরিত্রে ওঁর কী করণীয় আমরা জানতাম। কিন্তু কী ভাবে, তার এক অভিনব দৃষ্টান্ত তিনি তুলে ধরলেন ছবিতে। কিন্তু এহ বাহ্য।

এর বছর পাঁচেক আগে, ১৯৫৬-য়, ছবিবাবুর নতুন চালের এক অভিনয় শুরু হয়ে গিয়েছিল দু’দুটি ছবিতে। একটিতে নিতান্তই এক পার্শ্বভূমিকা— শম্ভু মিত্র পরিচালিত ‘এক দিন রাত্রে’ ছবিতে এক মাতালের গলায় গান ধরেছেন ছবিবাবু ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়, সব সত্যি, সব সত্যি’, আর দর্শক ধাঁ মেরে ভাবতে বসেছে, এ কোন ছবি বিশ্বাস!

অন্য ছবিটিতে ছবিবাবু নায়ক, কিন্তু কী এক অভাবনীয় ভূমিকায়। তপন সিংহের ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবির কাবুলিওয়ালা। ‘নর্তকী’ করে চরিত্রাভিনয়ে সরে যাওয়া ছবিবাবু যেন ক্রমশ ফিরে আসা ধরলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের নানা নায়কের চরিত্রে। যার শিখর ভূমিকা— জানানোর প্রয়োজনই হয় না— সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’-এর বিশ্বম্ভর রায়। যে প্রসঙ্গে একটু পরেই এসে পড়তে হবে।

কিন্তু তার আগে কয়েকটা স্মরণীয় চরিত্র ও ভূমিকা স্মরণীয়। স্মরণীয় মুহূর্ত?

ছবির নাম ‘জলসাঘর’

মনে করুন ‘লৌহকপাট’-এ জেলখানা জুড়ে পাগলা ঘন্টি বাজছে আর গারদের গরাদ ধরে যাবজ্জীবন দণ্ডিত ডাকাত ছবি বিশ্বাসের সেই বিহ্বল চাহনি ও স্মৃতিপথযাত্রা। কিংবা মনে করুন, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এ রাতের অন্ধকারে আকাশবাতাস কাঁপানো উন্মাদ মেহের আলির সেই ভৌতিক চিৎকার ‘সব ঝুট হ্যায়! সব ঝুট হ্যায়!’

চরিত্র ধরলে ধরতেই হয় ‘দাদাঠাকুর’-এর দাদাঠাকুর। যদিও যাঁর চরিত্র ভিত্তি করে ছবি সেই দাদাঠাকুরের পছন্দের হয়নি এই দাদাঠাকুর, তবু বাঙালি দর্শক বেজায় মুগ্ধ হয়েছিল তাদের প্রিয় ছবি বিশ্বাসের এই অপূর্ব বিবর্তনে।

কেউই বলতে গেলে ত্রৈলোক্য মহারাজকে চাক্ষুষ করেনি তার আগে, অনেকে এমনও মন্তব্য করে বসেছে যখন দাদাঠাকুর সাক্ষাৎ আবির্ভাব হলেন কলকাতায়, ‘কই, এঁকে তো ঠিক দাদাঠাকুরের মতো লাগছে না!’ লাগবে কী করে? তদ্দিনে দাদাঠাকুর বলতে তো ছবি বিশ্বাস।

ওই বছরই, ১৯৬২, ছবিবাবুর করা অপর স্মরণীয় চরিত্র সত্যজিতের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির মানী, অভিজাত, সাহেবি কেতায় দুরস্ত এবং দিশি সেন্টিমেন্টে অনভ্যস্ত পরিবারপ্রধান।

সত্যজিতের প্রথম রঙিন ছবির সম্ভবত সব চেয়ে রঙিন ব্যক্তিত্ব ছবিবাবুই পাইপে টান দিতে দিতে আর ইংরেজি ডায়ালগ দিয়ে ছবির শুরুয়াত করেন।

খুব শিগগির মেঘাচ্ছন্ন হয় দার্জিলিং-এর আকাশ এবং ছবির দু ঘণ্টার মধ্যেই গোটা পরিবারের জীবনেরও দু’ঘণ্টা বাঁধা পড়ে। যাঁর ইচ্ছে-অনিচ্ছে, মত ও অমতে পরিবার চলে সেই কাহিনির নায়ক ছবি বিশ্বাসের সোচ্চার, ঘোষণা ‘মেঘ কেটে গেছে’ দিয়েই যবনিকাপাত।

স্ত্রীর অপরূপ রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার সময় হয় না যে কোম্পানি ডিরেক্টর সাহেবের, তাঁর কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়োয় রোদ আবিষ্কারের উল্লাস ছবির চূড়ান্ত মুহূর্ত। সেই দৃশ্যে ছবিবাবুর যে অভিনয় ও আবেগ তা যেন শিল্পীর জীবনের এক ‘লাস্ট হুর্রে,’ বিজয়ীর বিদায়ী হাতনাড়া।

সে বছরই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ছবিবাবুর মৃত্যু হল এবং পর দিন আনন্দবাজারে ওই বিধ্বস্ত অ্যাম্বাসাডরের ছবি বেরোল। কোনও চলচ্চিত্রাভিনেতার ও রকম মৃত্যুর পেজ ওয়ান নিউজ বোধ হয় প্রথম পড়ল বাঙালি।

তবে কাঞ্চনজঙ্ঘার আগেই ছবিবাবুর এভারেস্ট জয় হয়ে গিয়েছিল ১৯৫৮-য় ‘জলসাঘর’ ছবিতে বিশ্বম্ভর রায় বেশে। এ হল মার্লন ব্রান্ডোর গডফাদার (‘গডফাদার’), পিটার ও’ টুলের টি.ই.লরেন্স (‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া’) বা হেনরি দ্য সেকেন্ড (‘বেকেট’), রিচার্ড বার্টনের বেকেট (‘বেকেট’), অ্যান্থনি কুইনের জোরবা (‘জোরবা দ্য গ্রিক’), আল পাচিনোর মাইকেল কোর্লিওনি (‘গডফাদার টু’) বা অ্যান্থনি হপকিন্সের হ্যানিবাল লেক্টরের (‘সাইলেন্স অফ দ্য ল্যাম্বজ’) মতো একটা লাইফটাইম রোল, চিরস্মরণীয়। একবারই আসে, চিরকাল থাকে।

এই ভূমিকা ছবিবাবুর কাছে আসারও একটা পশ্চাদ্পট আছে। ‘জলসাঘর’ করবেন যখন ঠিক করলেন সত্যজিৎ, তিনি ওই রোলে চেয়েছিলেন শিশিরকুমার ভাদুড়িকে। তাঁর নাটকের কাজ বন্ধ হয়ে গিয়ে মহান অভিনেতা তখন খুবই ভগ্নমনোরথ।

সত্যজিতের কদরই করেছেন, কিন্তু কাজটা তিনি নিতে চাননি। তাতে শিশিরবাবুরই অভিনয়ের টানে মঞ্চাভিনয়ে আসা ছবিবাবু বিশ্বম্ভর রায় করার প্রস্তাব পান। শিশিরবাবু যে আর রুপোলি পর্দায় আসতে চাননি তার একটা কারণ— তিনি সত্যজিৎকে বলেছিলেন— সিনেমায় তো পরিচালকই সর্বেসর্বা, ওখানে অভিনেতার আর কতটুকু কী করার।

‘জলসাঘর’ রিলিজের বছরই প্রয়াত হন শিশিরবাবু, কাজেই ওঁর অনুগত ছবি বিশ্বাসের ওই কাজ ওঁর দেখা হয়নি। দেখলে একটা পুলকিত বিস্ময় হয়তো জাগত যে, ছবিবাবু কী ভাবে মঞ্চাভিনয়ের ও সিনেমার অ্যাক্টিং-এর সেরা কাজ মিলিয়েছেন ওঁর বিশ্বম্ভর রায় চরিত্রায়ণে।

অপূর্ব সব নাট্যমুহূর্ত ও প্রায় নিখুঁত দৃশ্যায়ন মিলেই ‘জলসাঘর’কে এক রসের খনি করে তুলেছিল। আর সেই সব নাট্যময়তা ও দৃশ্যাবলির কেন্দ্রে এক ছবি বিশ্বাস।

মঞ্চসিদ্ধ ও সিনেমাঋদ্ধ অভিনয়ের এক সর্বোত্তম সমন্বয় কলকাতার বাঙালি দেখতে পেয়েছিল ষাটের দশকের শেষে যখন রুশ পরিচালক গ্রিগরি কোজিন্তসেভ-এর ‘হ্যমলেট’ এল শহরে। কী অপূর্ব চলচ্চিত্রায়ণ! এর কী অকল্পনীয় অভিনয় মূল ভূমিকায় ইনোকেন্তি স্মোকতুনভস্কির! সিনেমায় যে এ ভাবে নাটকের অভিনয় তুলে আনা যায় তা না দেখলে বিশ্বাস করা যেত না। সত্যজিৎ রায় সে সময় বিবৃতিই দিয়েছিলেন যে, স্মোকতুনভস্কি নিঃসন্দেহে পৃথিবীর এক শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। ছবির বিজ্ঞাপনে তার ব্যবহার হত।

এর ক’বছর পর ওই কোজিন্তসেভ-এর পরিচালনায় ছবি এল ‘কিং লিয়র’ এবং মূল ভূমিকায় সেই ইনোকেন্তি স্মোকতুনভস্কি। নাটক ও সিনেমার এই অভেদ উত্থাপন সমানে আমাদের প্ররোচনা দিয়েছে তুলনা খোঁজার। কখনও আমরা জ্যঁ আনুই-এর নাটক থেকে ‘বেকেট’ ছবি, বার্নার্ড শ’-এর নাটক থেকে ‘মাই ফেয়ার লেডি’, টেনেসি উইলিয়মজ-এর নাটক থেকে ‘আ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার’ বা ‘ক্যাট অন আ হট টিন রুফ’-এর কথা ভাবছি, আর দেশি ছবির কথা ভাবলে কেন কে জানে শুধু চোখের সামনে আসে ‘জলসাঘর’, যা কোনও নাটকই নয়।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে সত্যজিৎ চিত্রনাট্যটা লিখেছিলেন ইতিহাসের মেজাজ, সাবেক পোশাক ও সজ্জা, রাগসঙ্গীত, নাচ ও ট্র্যাজেডির আমেজ ও অভিনয় মিশিয়ে একটা বাণিজ্যসফল ছবি তৈরির অভিলাষে। কারণ তার আগের ছবি ‘অপরাজিত’ তুমুল প্রশংসিত হয়েও বক্স অফিসে বিপর্যস্ত হয়েছিল।

কিন্তু বক্স অফিস হিট বানাতে গিয়ে যা দাঁড়াল তা বাস্তবিকই এক জলসাঘর। গান শুনতে, নাচ দেখতে, পয়সা ছোড়াছুড়ি দেখতেই জড়ো হয়েছি আমরা, আর একটু একটু করে এক অনমনীয় প্রৌঢ়ের ক্রমান্বয় আত্মহনন দেখছি। প্রথমে শীতের সকালে আলোয়ান জড়িয়ে প্রাসাদের ছাদে। একটু একটু করে আলো ফুটছে তখন সানাইয়ের আলাপের সুরে।

শেষে জলসাশেষে সবাই চলে যেতে একে একে যখন বাতি নিভছে আর অন্ধকার ঘনাচ্ছে তখন দেওয়ালজোড়া বেলজিয়াম গ্লাসের আয়নায় বিশ্বম্ভর খুঁটিয়ে দেখছেন তাঁর শেষ হাসি হাসা মুখটা। তিনি নিঃস্ব হয়েছেন কিন্তু মহিম গাঙ্গুলির উঠতি বড়লোকি মেজাজকে ঢিট করেছেন।

বিশ্বম্ভরের এই জয়ের মুহূর্তের নিঃসঙ্গতাকে স্বগতোক্তি, খানসামা অনন্তকে উদ্দেশ করে সংলাপে আর চাহনির নীরব, করুণ ভাষায় ছবিবাবু ছবির মতো ফুটিয়ে তুলেছেন। ক্যামেরা ও অভিনেতার অভিনব সংলাপ সে এক।

জন রাসেল টেলর ‘জলসাঘর’কে বলেছেন হিপনোটিক, জাদুকরী। ডেরেক ম্যালকম বলেছেন সত্যজিতের ‘মোস্ট পারফেক্ট ফিল্ম’। নিউ স্টেটসম্যান পত্রিকায় জন কোলম্যান তো ওঁকে তুলনাই করে বসলেন জ্যঁ রনোয়ার সঙ্গে। আর মহৎ আলোকচিত্রী অঁরি কার্তিয়ের ব্রেসঁ তো চিরকাল আহ্লাদ প্রকাশ করে গেলেন ‘জলসাঘর’ নিয়ে। কাহিনি, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা ছাড়াও এতশত নিখুঁত কারিগরি বিদ্যার সমাবেশ এতে যে, ছবিবাবুর অসাধারণ অভিনয়কীর্তি নিয়ে বড়সড় করে বলার সুযোগ হয় না সমালোচকদের।

হয়তো সেটাই সেরা প্রশংসা ছবিবাবুর। এতই ভাল তাঁর অভিনয় যে নীরবে তাকিয়ে দেখাই এর একমাত্র কদর। উপরন্তু সত্যজিৎবাবুর দেওয়া একটা তথ্য জানলে সেই কদর এক অন্য মাত্রা পাবে।

‘জলসাঘর’-এর মতো সঙ্গীতপ্রধান ছবির নায়ক ছবি বিশ্বাসের গানের কান ছিল না। কিন্তু অভিনয়বিদ্যার জোরে তিনি গানের সঙ্গে নিখুঁত প্রতিক্রিয়া দিয়ে গেছেন। সন্ধে হলে নিমতিতার প্রাসাদের যেদিকটায় তিনি থাকতেন সেখানে নিজের পানীয় নিয়ে একঘরে হতেন। নিজের জগতে তিনি তখন।

এরকম এক দিন বাইরে থেকে এক ব্যান্ড পার্টি এল বাজনা বাজাতে। কী ভেবে সেদিনই হঠাৎ গেলাস রেখে বেরিয়ে এসে ব্যান্ডমাস্টারের কায়দায় বাজনা কন্ডাক্ট করা শুরু করলেন। সত্যজিৎ বলেছেন, ভাগ্যিস এর বেশি দূর গড়ায়নি ব্যাপারটা।

সত্যজিৎ ও ছবিবাবুর এই সমীহের সম্পর্কটা দিন দিন গাঢ় হয়েছিল। বন্যাত্রাণ ইত্যাদিতে যে ক্রিকেট ম্যাচ হত তাতে দু’দলের অধিনায়কত্ব করতেন সত্যজিৎ ও ছবিবাবু। বাংলা ছায়াছবির তখন এল্ডার স্টেটসম্যান ছবিবাবু। ওঁর সম্পর্কে সত্যজিৎবাবুর একটা মন্তব্য শুনিয়ে শেষ করব।

১৯৮০-তে প্যারিস থেকে ফিরে দেখা করতে গেছি সত্যজিৎবাবুর সঙ্গে। কথায় কথায় বললাম ফরাসি সাবটাইটেলে ওখানে ‘দেবী’ দেখার কথা। ওদের দারুণ লেগেছে শুনে জিজ্ঞেস করলেন, “সাবটাইটেল কেমন হয়েছে দেখলে?”

বললাম, “বেশ ভাল।”

বললেন, “‘জলসাঘর’-ও ওদের ভাল লাগার সম্ভাবনা। পিরিয়ড পিস, মিউজিক, অ্যাক্টিং...!”

জিজ্ঞেস করলাম, “সাবটাইটেল কী রকম হয়েছে?”

বললেন, “জানি না। তবে ছবিবাবুর ওটার দরকার হবে না।”

১৯৮১-তে প্যারিসে রিলিজ হয়ে ফরাসি দুনিয়াকে হাতে নিয়ে নিয়েছিল ‘জলসাঘর’।

প্রতিচ্ছবি

১৯০০ সালের ১২ জুলাই বনেদি বিশ্বাস পরিবারে ভূপতিনাথ বিশ্বাসের পুত্র শচীন্দ্রনাথের জন্ম। পরবর্তী কালের ছবি বিশ্বাস। ছবির মতো চেহারা নিয়ে এসেছিলেন বলে মা নাম রেখেছিলেন ছবি

ছাত্রজীবন শুরু নয়নচাঁদ দত্ত স্ট্রিটের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। এর পর সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুল। সেখান থেকে হিন্দু স্কুল। হিন্দু থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করা। তারপর প্রথমে প্রেসিডেন্সি, পরে বিদ্যাসাগর

অভিনয় ছোটবেলা থেকেই। বাড়ির প্রকাণ্ড হলঘরে ভাইবোনেরা প্রায়ই গানবাজনা, অভিনয়-আবৃত্তির আসর বসাতেন

কলেজ জীবন থেকে জড়িয়ে পড়েন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের সঙ্গে। এখানেই তাঁর শিশির ভাদুড়ির সঙ্গে অভিনয় করার সুযোগ মেলে। একটি সূত্র বলে, মদন মিত্র লেনে নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের বৈঠকখানায় ‘বারবেলা বৈঠক’ ক্লাবে মূলত পারিবারিক গণ্ডি ছাড়িয়ে বাইরের জগতে অভিনয়ে তাঁর হাতেখড়ি। আর শিশির ভাদুড়ির সঙ্গে তিনি ১৯৪০ সালের ৯ জুলাই অভিনয় করেন ‘ষোড়শী’-তে। ১২ জুলাই ছিলেন ‘সীতা’-য়। সেখানে শিশির ভাদুড়ি ছাড়াও অভিনয়ে ছিলেন অর্ধেন্দু চৌধুরী, প্রভাদেবী ও অন্যরা। অহীন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে তাঁকে মঞ্চে আবার দেখা যায় ১৯৪১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। ‘কেদার রায়’ ও ‘সাজাহান’ নাটকে।

এক সময় তিনি যুক্ত হন কাঁকুড়গাছি নাট্যসমাজ, হাওড়া নাট্যসমাজ ও সিকদারবাগান বান্ধব সমাজের সঙ্গেও। শেষের সংস্থাটিতে ‘নিমাই সন্ন্যাস’ পালায় নিমাই চরিত্রে অভিনয় করে তিনি প্রভূত জনপ্রিয়তা পান

পেশাজীবনের গোড়ায় তিনি কিছু দিন বিমা কোম্পানিতে কাজ করতেন। তারপর শুরু করেন পাটের ব্যবসা

পেশাদার রঙ্গমঞ্চে তাঁর প্রথম অভিনয় ‘সমাজ’ নাটকে। এর পর অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ধাত্রীপান্না’, ‘মীরকাশিম’, ‘দুইপুরুষ’, ‘বিজয়া’, ‘প্রফুল্ল’

তাঁকে চলচ্চিত্রে নিয়ে আসেন প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁকে সহায়তা করেন তিনকড়ি চক্রবর্তী। পর্দায় তাঁর প্রথম অভিনয় ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’-এ বিশুর ভূমিকায়

অবসর পেলেই তাঁর শখ ছিল ছবি আঁকার। সুচ-সুতোর কাজও করতেন। শোনা যায়, খুব ভাল টেবিলটেনিসও খেলতেন। জাগুলিয়ায় ছিল তাঁর প্রাসাদোপম বাড়ি। এককালে যেখানে প্রতিবছর দুর্গা পুজো করতেন তিনি। ছোট জাগুলিয়ায় সরকারি হেল্থ সেন্টারটির জন্য তিনি প্রায় ৮/১০ বিঘা জমি দান করেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, দানধ্যানের জন্য বিশ্বাস পরিবারের খ্যাতি ছিল বহুকালের

১৯৬২ সালের ১১ জুন এক মোটর দুর্ঘটনায় তাঁর জীবনাবসান হয়

সূত্র: সোনার দাগ (শতবর্ষের আলোয় বাংলা চলচ্চিত্র-প্রথম পর্ব)/গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement