স্মরণ ২...

কিছু মায়া রয়ে গেল

তাঁর বাউণ্ডুলে মনের অন্দরে বিলীন ছিলেন অন্য এক শক্তি চট্টোপাধ্যায়। লিখছেন সৌমিত্র মিত্র।তাঁর বাউণ্ডুলে মনের অন্দরে বিলীন ছিলেন অন্য এক শক্তি চট্টোপাধ্যায়। লিখছেন সৌমিত্র মিত্র।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৪ ১৫:১৮
Share:

সপরিবার বাড়িতে, ১৯৯৫।

শক্তিদা’র মৃত্যুর ঠিক আগের বছর রবীন্দ্র সদনে কবিপ্রণাম অনুষ্ঠানে কবি সম্মেলন। অনেকানেক কবির মধ্যে হাজির নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়। হলভর্তি শ্রোতা আর সুনীল-শক্তিকে ঘিরে একদল তরুণ কবি। তাদেরই একজন শক্তিকে অনুরোধ করলেন দুটি কবিতা পড়ার। ‘পাবো প্রেম কান পেতে রেখে’ ও ‘এ বার হয়েছে সন্ধ্যা’।

Advertisement

খানিকটা স্তব্ধ শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তারপর বললেন, ‘আমি কি নতুন কবিতা একদম লিখতে পারছি না?’ না, না তা কেন, মানে ইত্যাদি... উত্তর দিচ্ছিল তরুণ কবির দল।

এর পরই মঞ্চ আলো করে পড়লেন সদ্য লেখা দুটি কবিতা
তাঁর গুরুগম্ভীর কণ্ঠে স্বপ্নের কোথায় শেষ?
স্বপ্ন তোমাদের প্রতি আর চোখ ফেরাব না...

Advertisement

অন্যটি
বালুকায় ভেঙে পড়ে সমুদ্রের ফসফরাসের মতন
আবিল নক্ষত্রপুঞ্জ
মাছ জানে, বালুকা জানে না
দূরের দৈনিক চাঁদ
চোর পুলিশ খেলেছে কতই...

সদ্য নতুন দুটি কবিতা শুনে গোটা হল স্তব্ধ। সুনীলদা, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত হইহই করে বললেন, এই জন্যই শক্তিকে এত ভয়। পাশ থেকে তারাপদ রায়ের মন্তব্য, তা হলে রবিঠাকুরের জন্মদিন সেলিব্রেট করা যাক।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আতিথেয়তায় সস্ত্রীক শক্তি, স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, তারাপদ রায় লেক ক্লাবে রবিঠাকুরের জন্মদিন পালন করতে গেলেন। শ্রোতা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় জুড়ে গেলেন দলে। কৃত্তিবাস-এর দামাল কবিরা আসলে এমনই, বন্ধুর ভাল লাগা কবিতাকে রবিঠাকুরের জন্মদিনে মিশিয়ে প্রৌঢ়ত্বেও প্লাবন তুলতেন।

আশির দশকের মাঝামাঝি আমি ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের একটি অফিসে কর্মরত। শক্তিদা নিয়মিত বিকেলে চলে আসেন এবং আমাদের সান্ধ্য আড্ডার পরিভ্রমণ শুরু হয়। বিকেল শেষ হতে চলল, শক্তিদার দেখা নেই। কিছুটা চিন্তিত আমি আনন্দবাজারে ফোন করে শুনি বিকেল তিনটেয় বেরিয়ে গেছেন।

শক্তিদার গন্তব্যস্থলগুলো আমার জানা। দু’তিন জায়গায় ফোন করে হদিশ পাওয়া গেল না। হাঁটা দিলাম নিউ মার্কেটের সামনে দিয়ে প্রেস ক্লাবের দিকে। দেখি মনোহর দাস তড়াগের গম্বুজে বসে শক্তিদা। সঙ্গী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। গভীর গল্প চলছে।

রাস্তায় শক্তির সঙ্গে হঠাৎ দেখা সৌমিত্র’র। গাড়ি থেকে খেরোর খাতা বার করে সৌমিত্র শক্তিকে শোনাচ্ছেন পদ্য। নিবিষ্ট শ্রোতা মাঝে মাঝে প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন। সেখানেই ঠিক হল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একটি সন্ধ্যা-অনুষ্ঠান হবে। শক্তি লিখবেন নতুন কাব্যনাট্য। সৌমিত্র পাঠ করবেন।

অনুষ্ঠানের সব আয়োজন যখন তুঙ্গে, শক্তিদাকে খুঁজে পাচ্ছি না। কাব্যনাট্য লেখা হয়নি। শক্তিদা কলকাতায় নেই। মাঝে মাঝে অফিসে আসেন, বড় অনিয়মিত।

এক সন্ধেয় থিয়েটার রোডে ডা. কালীকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের চেম্বারে শক্তিদার দেখা মিলল। যেন কিছুই হয়নি, এমন ভান করে বললেন, ‘কাব্যনাট্য তো, লিখে দেব।’

পরদিন কর্নেল বিশ্বাস রোডের বাড়িতে সকালবেলা পাওয়া গেল কাব্যনাট্য ‘একা গেলো’।
এক অসাধারণ মর্মস্পর্শী কাব্য গ্রহণ করিনি আগে ভুল হয়ে গেছে
চুম্বন করিনি আগে ভুল হয়ে গেছে
তেমন বাসিনি ভালো ভুল হয়ে গেছে...

রুল টানা কাগজের সাত পাতা আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘সৌমিত্রকে দিয়ে আয়।’

শক্তিদার মাথায় থাকত নানা পরিকল্পনা। একদিন বললেন, ‘কবিতা উৎসব করব। বাংলাদেশ থেকে কবিরা আসবেন। এখানকার কবিরা থাকবেন।’

নিজের হাতে লিখে আমন্ত্রণ পাঠাবেন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, বেলাল চৌধুরী প্রমুখ কবিদের। কোন দিন কী হবে তার পরিকল্পনাও চূড়ান্ত হল।

এ দিকে প্রবল অর্থকষ্ট। শক্তিদা আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁর বন্ধুদের কাছে। কেউ আইএএস, কেউ আইপিএস, কেউ কোম্পানির বড় কর্তা। অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। নিজে গেলেন অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাড়িতে, তিনি উদ্বোধন করবেন। নিমন্ত্রণপত্র হাতে ছুটলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, অরুণ মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। প্রবীণ-নবীন কবিদের উপস্থিতিতে সে এক মহা যজ্ঞ।

পুরীতে, সঙ্গে মীনাক্ষীদেবী ।

সব মানুষকে একত্র করার এক সহজাত ক্ষমতা ছিল শক্তিদার। নিমাইসাধন বসু, সব্যসাচী ভট্টাচার্য প্রমুখ উপাচার্যদের কাছে হাত পাতলেন। সাগ্রহ সম্মতি পাওয়া গেল। শ্যামলী প্রাঙ্গণে কবিতা উৎসবে হাজির সকলেই। আর এই উৎসব ঘিরে আড্ডা, পানাহার সবই চলল। সেই সব দিনগুলো বড়ই অনির্বচনীয়। শক্তিদার শুরু করে যাওয়া ওই উৎসব সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত হয়ে আজও বহমান। বর্ধমানে আজ ও কাল সেই উৎসব।

প্রেসিডেন্সির অসমাপ্ত পাঠ শেষ করতে বুদ্ধদেব বসুর আহ্বানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য পড়তে গিয়েছিলেন শক্তি। অগ্রজ কবিদের সম্পর্কে তাঁর ছিল অগাধ শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালবাসা। বিশেষত, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে। নিত্যপ্রিয় ঘোষের বন্ধুত্বর সুবাদে শঙ্খ ঘোষ ছিলেন ছোড়দা। কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায়-গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শরৎ ব্যানার্জি রোডের বাড়িতে ছিল খোলামেলা আড্ডা। সুভাষ-শঙ্খ দু’জনেরই জন্মদিন ফেব্রুয়ারিতে, ১২ আর ৬ তারিখ। গীতাদির ১৬ জুন। শক্তিদা এই দিনগুলো ভুলতেন না।

একবার বিদেশ থেকে সুভাষদা নিয়ে এলেন সোডা তৈরির যন্ত্র। ইচ্ছে, গীতাদির জন্মদিনে যন্ত্রটি দিয়ে মকটেল তৈরি হবে। এ দিকে নানা কারিকুরিতেও সে যন্ত্র কাজ করছে না। অবশেষে শক্তিদা সেই যন্ত্রে মশলা দিয়ে ভুল বোতাম টিপতেই সোডাবৃষ্টি ঘর প্রায় প্লাবিত করল। শক্তিদার তখন সহাস্য উক্তি, ‘সুভাষদা এ সব আমাদের কাজ না। আমরা পদ্য লিখব। ঘুরে বেড়াব।’

শক্তিদার পদ্য সমগ্র’র প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় সুভাষদা লিখেছেন, “সত্যি বলতে কী, আমার চোখ ফোটে শক্তির কবিতা সম্বন্ধে শঙ্খ ঘোষের একটি লেখা পড়ে... গোড়ার দিকে ওর পদ্যে টলমল ভাব। পরে ওর অশ্বমেধের ঘোড়া ওকে সার্বভৌমত্ব দিয়েছে।” শঙ্খ ঘোষ শক্তিদাকে বলতেন, “এই শহরের রাখাল।”

বার্নপুরের ভারতী ভবনে বেশ জাঁকজমক করে বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন হত। উদ্যোক্তারা শক্তিদাকে ধরলেন একটি অনুষ্ঠানের জন্য। শক্তিদা বললেন, একটা নতুন ধরনের লেখা লিখব। তাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত, আধুনিক কবিতার মধ্যে দিয়ে একটা আলেখ্য হবে। শীতকুমারী আর বসন্তকুমারের সংলাপের মধ্যে থাকবে গান, কবিতা।

ভারতী ভবন অগ্রিম টাকা দিয়ে দিলেন, কিন্তু কোথায় লেখা? দু’মাস কেটে গেল, শক্তিদা লেখা দেওয়ার ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করছেন না। এদিকে কারা পাঠ করবেন, গান গাইবেন, কবিতা বলবেন সব ঠিক করা হয়ে গেছে। শক্তিদাকে বললাম, ‘চলো কলকাতার বাইরে। সেখানে লিখবে।’ সপরিবার শক্তিদা ও আমরা চললাম বর্ধমানের কানাই নাটশাল বাংলোতে। পর দিন উপুড় হয়ে শুয়ে শক্তিদা লিখলেন ‘শীত বসন্তের সংলাপ’এসো নীলাঞ্জন মেঘ/ পিঁড়ি পাতা আছে/দু’দণ্ডের জন্যে বসো/যদি হাতে থাকে সময়/জানো প্রবাসিনী,/দু’দণ্ড সুখের চেয়ে/দুঃখ খুবই, বড় অবিনাশী।

এই কাব্যনাট্যটির একটি সংলাপের উদ্ধৃতিতেই বোঝা যায় শিরদাঁড়ার রূপকল্প।

মহড়া হয়ে গেল। হঠাৎই শক্তিদা অসুস্থ হয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি। অনুষ্ঠানে শক্তিদার যাওয়া হবে না। বার্নপুর যাওয়ার আগের দিন সন্ধেবেলা শক্তিদার বাড়ি গিয়ে শুনি সকালবেলা বেরিয়ে গেছেন। তারপর বেপাত্তা। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিমর্ষ মুখে বাড়ি ফিরে দেখি, শক্তিদা বসে আমাদের বাড়িতে। কাঁচুমাচু মুখ করে বললেন, ‘আমাকে বার্নপুরে নিয়ে চল।’

নিয়ে গিয়েছিলাম। বার্নপুর থেকে শান্তিনিকেতন হয়ে কোথায় না কোথায় যাইনি। যেখানেই গেছি দেখেছি শক্তিদাকে ভালবাসতে। এই প্রকৃতি জল-জঙ্গল-সমুদ্র-বালি সব কিছুই ভাল বাসতেন। সংসার যেমন ভালবাসতেন, প্রকৃতিকেও তেমন ভালবাসতেন। সব মিলিয়ে নিজের কাছে টেনে নিতেন, যাকে বলে জড়িয়ে থাকা। আর ও ভাবে থাকতে থাকতে কবিতাকে নিয়ে গিয়েছিলেন জীবনের কেন্দ্রে। পাঠককে ভালবেসে টেনে এনেছিলেন কবিতা পড়তে। এমনকী এ বললেও অত্যুক্তি হবে না যে কবিতায় পুড়ে যেতেও পাঠককে টেনে ছিলেন।

আজ মনে হয়, উনি যখন লিখেছিলেন ‘ও চিরপ্রণম্য অগ্নি আমাকে পোড়াও’ ওই চিরপ্রণম্য অগ্নিই আসলে যেন কবিতা যাতে নিজে ছারখার হয়েছেন, পাঠককে ছারখার করেছেন।

লিখতে লিখতেই শক্তিদার অদ্ভুত একটা কবিতা মনে পড়ে গেল। যাকে বলে অসচরাচর। কবিতার নাম, ‘অবাস্তব মার্চ মাস’। এ কবিতার কথা বললাম, কেননা এই মার্চেই তো আমাদের রাঙিয়ে দিয়ে যাও, যাও গো এবার যাবার আগে, কাঁদিয়ে দিয়ে যাও বলে চলে গিয়ে গিয়েছিলেন। এ কবিতায় শক্তিদা লিখছেন
১৯৬৩, মার্চ, গ্রীষ্মকাল পতনবিমুখ
কলকাতা ও মফস্বল অনায়াসে গেঞ্জি খুলে ফেলে।

হ্যাঁ, আবার পুরনো কথায় ফিরে আসি। বার্নপুর নিয়ে যেমন গিয়েছিলাম, এই মার্চেই আবার তাঁকে নিয়ে এসেছিলাম শান্তিনিকেতন থেকে। আমার সামনে ট্রেনের কামরায় শক্তিদা শোয়া, কথা বলছেন না। বলবেনও না, আমি জানি। জানি ততক্ষণে ও চাঁদ চোখের জলে জোয়ার লেগেছে। আজ যেন মনে হয় সেই দিন যখন শক্তিদাকে নিয়ে বোলপুর থেকে ট্রেনে উঠেছিলাম, সেই নীরব, নিভে যাওয়া, অনেক দূর দেশে পাড়ি দেওয়া শক্তিদা সেবারও আমাকে বলেছিলেন, নিয়ে চল।

শক্তিদাই তো লিখতে পারেন, ‘মানুষ যেমন কাঁদায়, তেমন মানুষ আদর করে...’।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement