বাংলা গানের ছশো বছর – বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস থেকে সলিল চৌধুরী- এই ভাবনা থেকে সম্প্রতি রবীন্দ্রসদনে এক সঙ্গীত সন্ধ্যার আয়োজন করেছিল ‘উতল হাওয়া’ সংস্থা। মনন ও ভাবনায় উল্লাস চট্টোপাধ্যায়। সাহসী ও গঠনমূলক ভাবনা সন্দেহ নেই। কিন্তু ঘণ্টা দেড়েক সময়ের মধ্যে কি এই বিপুল ভান্ডারকে যথাযথ তুলে ধরা সম্ভব! কিছু ভাল গান শোনার সুযোগ নিশ্চয় মেলে। কিন্তু এই দীর্ঘ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গানের চলনের পরিবর্তনগুলো ঠিকঠাক ধরা পড়ে না। ছ’শো বছরের বাংলা গান নিয়ে অন্তত তিনটি পৃথক সন্ধ্যার অনুষ্ঠান হতে পারত। উল্লাস চট্টোপাধ্যায়ের ভাষ্যরচনা যথাযথ। হয়তো সাউন্ড সিস্টেমের দুর্বলতাতেই ভাষ্যপাঠের সবটা শ্রোতার কানে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে না।
শিল্পী ছিলেন পাঁচজন। অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়, মহুয়া চট্টোপাধ্যায়, উৎসব দাস, স্বপন সোম আর সুছন্দা ঘোষ। গানগুলো ভাল-মন্দ মিশিয়ে। প্রথম গান ‘মাধব’ শুরু করলেন অনিন্দ্য। মহুয়া চট্টোপাধ্যায় লালনের গান সহ অনেকগুলি গান গেয়েছেন। রেওয়াজি গলা হলেও সব ধরনের গানে তিনি সাবলীল নন। অনিন্দ্যর গলা ভাল। কিছু গানে বেশ প্রখর হয়ে ওঠেন, কিছু গান নিষ্প্রাণ। ‘ওই দেখা যায় বাড়ি আমার’ স্বপন সোমের গলায় নাটকীয়তা আর পুরনো দিনের মেজাজ দুইই আছে। উৎসব দাস অনেক চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু ডি এল রায়ের ‘ঘন তমসাবৃত অম্বর ধরণী’-র মতো গান গাইবার আগে নিজেকে আরও প্রস্তুত করতে হবে। বরং ভাল লাগে সমবেত সঙ্গীত ‘মুক্তির মন্দির’। এরকম আরও কিছু সমবেত গান থাকলে হয়তো অনুষ্ঠান জমে যেত।
সুছন্দা ঘোষ তিনটি গান গাইলেন— রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘আমার মাথা নত করে’, অতুলপ্রসাদ ‘একা মোর গানের তরী’।
আর রজনীকান্ত ‘আমি অকৃতি অধম বলেও তো তুমি’। তিন গায়কিতেই তিনি সমান উজ্জ্বল। পূর্ণ নিবেদন তাঁর গলায় বড় সুন্দর আসে। বিশেষ করে বারবার কানে বাজে ‘একা মোর গানের তরী’।
জাগল নারীশক্তি
জি ডি বিড়লা সভাঘরে। লিখছেন পিনাকী চৌধুরী
প্রয়াস নিবেদিত ‘নারী রূপেণ সংস্থিতা’ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল জি ডি বিড়লা সভাঘরে। নারী শক্তির বিভিন্ন রূপ ফুটে উঠেছে কখনও নৃত্যের মাধ্যমে, কখনও বা কবিতা ও গানের মাধ্যমে। পরিচালনায় অভিরূপ সেনগুপ্ত। শুরুতেই চন্দ্রাবলী রুদ্রদত্ত শোনালেন আগমনি গান ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’। দীপাবলী গাইলেন ‘দুর্গে দুর্গতিনাশিনী’। অনুষ্ঠানের মাঝে ছিল ছোটদের নৃত্যানুষ্ঠান ‘সমর্পণ’। সুদীপ্ত ঘোষের নির্দেশনায় অনুষ্ঠানটি বেশ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’। অভিরূপ সেনগুপ্তের নৃত্যবিন্যাসে এবং রায়া ভট্টাচার্যের উদাত্ত কণ্ঠের পাঠ ‘এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’ এদিনের অনুষ্ঠানের সেরা প্রাপ্তি। নৃত্য ও পাঠের অপূর্ব মেলবন্ধন। ঠিক যেমন পরের নৃত্যালেখ্য ‘ও গঙ্গা’তে রায়ার সুললিত কণ্ঠে ‘হোরী খেলা’ পাঠের আমেজ উচ্চ প্রশংসিত হয়। রায়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অভিরূপ ও সহশিল্পীরা নৃত্যের তালে তালে অনুষ্ঠানের পরিপূর্ণতা এনে দিলেন।
কৃষ্ণভক্ত মীরার ভূমিকায় স্বাতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসাধারণ শরীরী-ভঙ্গিমার প্রশংসা না করলেই নয়। কৃষ্ণভক্ত মীরার কথা আজও এই শতকেও নারীকে প্রেরণা দেয়। তাই শুভ দাশগুপ্তের কবিতায় রায়া পাঠ করলেন ‘আমি সেই মেয়ে’। সব শেষে ছিল দুর্গাস্তুতি ‘দয়ানী ভবানী’।
অন্য রূপে অসাধারণ আঙ্গিকে দর্শকদের হাততালি কুড়িয়ে নিলেন জয়া শীল ঘোষ। তিনি অনুষ্ঠান কম করলেও তাঁর নৃত্যের প্রতিটি পদ-এ গভীর অনুশীলনের ছায়া।
শুরু ‘রঙ্গপূজা’য়
চৈতি ঘোষ
সম্প্রতি জ্ঞানমঞ্চে শিঞ্জন নৃত্যালয়ের অনুষ্ঠানের সূচনা হয় ‘রঙ্গপূজা’ দিয়ে। এর পর পরিবেশিত হয় ভৈরবী রাগে নিবদ্ধ ‘মঙ্গলাচরণ’। ‘মহাবিদ্যা’ উপস্থাপনায় দশমহাবিদ্যার চারটি রূপ তথা কালী, ষোড়শী, ছিন্নমস্তা ও বগলামুখী বন্দিত হন। ‘রাধার কৃষ্ণকীর্তনম্’ উপস্থাপনাটির মাধ্যমে কৃষ্ণের প্রতি রাধার সূক্ষ্ম আবেগ ও অনুভূতির ভিন্ন ভিন্ন রূপকে সুন্দর মুখজ অভিনয় ও পরিশীলিত শরীরী বিভঙ্গে ফুটিয়ে তোলেন বৈশালী কোলে, শ্রীপর্ণা বসু, কাবেরী সেন ও অর্পিতা ভেঙ্কটেশ।
‘বটু’ ও ‘নৃত্যবিলাস’ নৃত্যাংশ দুটিতে ওড়িশি নৃত্যের পদকর্ম ও নৃত্যবিন্যাসে জ্যামিতিক নক্শা ও ভঙ্গি ছিল মুগ্ধ করার মতো। অলোকা কানুনগোর নিখুঁত পরিচালনা ও পরিকল্পনাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।
সফল ভাবনা
রবীন্দ্রসদনে নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায়ের নৃত্য-জীবনের ষাট বছর পূর্তিতে অনুষ্ঠান করল ‘আন্তরিক’। মধুমিতা বসুর ভাবনায় পারমিতা চক্রবর্তী ও তাঁর সহশিল্পীরা নৃত্যের মাধ্যমে নিবেদন করলেন ‘এলেম নতুন দেশে’।
‘রাজা ও রানী’ পাঠ ও অভিনয়ে ছিলেন বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী ও মধুমিতা বসু। পারমিতার নৃত্যাভিনয়ে ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’ বেশ উপভোগ্য। পাঠে ছিলেন মধুমিতা বসু ও সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। সব শেষে ছিল ইন্দ্রাণী সেনের বেশ কয়েকটি গান।
শচীনকর্তার গানে
শচীনদেব বর্মনের গানগুলি শোনালেন দেবাশিস ভট্টাচার্য। আয়োজনে বৈতানিক ও ‘বাংলা নাটক ডট্ কম্’। দেবাশিস মূলত যন্ত্রসংগীতশিল্পী, কিন্তু কণ্ঠসংগীতেও যে তিনি অত্যন্ত সাবলীল, এ দিন তার প্রমাণ পাওয়া গেল। ‘শোনো গো দখিন হাওয়া’, ‘বর্ণে গন্ধে’, ‘কে যাস্ রে’ প্রভৃতি গানের গায়কি বেশ প্রশংসণীয়। গানের ফাঁকে শচীনকর্তার জীবনের বিভিন্ন কাহিনি শোনালেন সঞ্চালিকা শ্যামা ভট্টাচার্য।
যদি এমন হত
পিনাকী চৌধুরী
কাঁচড়াপাড়া থিয়েটার নান্দিক প্রযোজিত নাটক ‘সক্রেটিস’। টাইম মেশিনে যদি অতীতে ফিরে যাওয়া যায়, তাহলে কী দেখা যাবে? দেখা যাবে গণতন্ত্রের পক্ষে এবং স্বৈরতন্ত্রের বিপক্ষে কথা বলার অপরাধে সক্রেটিসকে কারাগারে বন্দি হতে হয়েছে। কিন্তু সক্রেটিস তো আদতে প্রতিবাদের স্বর। তাঁর কণ্ঠরোধ কি কখনও সম্ভব? এ নাটকে সক্রেটিস যেন বারে বারে স্বমহিমায় ফিরে এসেছেন। বরং তাঁর নির্ভীক কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে গণতন্ত্রের কথা। এ নাটকে রাষ্ট্র যেন এক শাসনযন্ত্র। প্রশ্ন উঠতে পারে গণতন্ত্র কী? গণতন্ত্রের বিপক্ষে কি কথা বলা যায়? কোনও একটি বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যমে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি তাঁর স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করায় তাঁর বাড়িতে ক্রমাগত হুমকি ফোন আসতে থাকে। নাটকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, এটা কি গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ?
সক্রেটিসের ভূমিকায় পার্থপ্রতিম ভট্টাচার্য এবং বিচারপতির ভূমিকায় মুকুল হালদার যথাযথ। তবে নাটকের স্বাভাবিক গতি কোথাও কোথাও হোঁচট খায়। তবুও পরিচালক নীলাদ্রি ভট্টাচার্য তাঁর মুনসিয়ানায় নাটকটিকে একটি সুন্দর পরিণতির দিকে নিয়ে গেছেন।
গীতসুধারসে
সম্প্রতি আইসিসিআর-এ অনুষ্ঠিত হল ‘গীতসুধারসে’। আয়োজক সৃষ্টি পরিষদ। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দিলীপ রায়ের একক গানে ছিলেন ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়। শুরুতেই গাইলেন রবীন্দ্রনাথের ‘যদি প্রেম দিলে না প্রাণে’। সুর, ছন্দ ও ভাবের মেলবন্ধনে শিল্পীর গায়কি অতুলনীয়। একই আমেজে গাইলেন দ্বিজেন্দ্রলালের ‘আমি সারা সকালটি’, অতুলপ্রসাদের ‘ওগো আমার নবীন’, রজনীকান্তের ‘প্রেমে জল হয়ে যাও’। শেষে গাইলেন হিমাংশু দত্তের ‘ঝরঝর ধারা’। অপূর্ব অনুভূতি।
মন-কাড়া গানে
কল্যাণ গুহর পরিচালনায় অরবিন্দ ভবনে অনুষ্ঠিত হল ‘নন্দিত তব উৎসব মন্দির’।
উদ্বোধনে গাইলেন সোমঋতা মল্লিক ‘বহে নিরন্তর’ ও তন্ময় মুখোপাধ্যায় ‘দাঁড়াও আমার’। সুমিতা দাসের পরিচালনায় ‘অরিত্র’র শিল্পীরা শোনালেন ভানুসিংহ পদাবলীর ‘কৃষ্ণ’। দর্পনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘পুনশ্চ’র শিল্পীরা শোনালেন তিনটি গান । শেষে ভাস্বতী দত্তের পরিচালনায় ও ছাত্রীদের অংশগ্রহণে পরিবেশিত হল ‘অভিসার’। ‘আজি শ্রাবণ ঘন গহনে’ ভাস্বতীর কণ্ঠে অন্য মাত্রা পায়।
তিন বোনের গান
বারীন মজুমদার
প্রয়াত পিতার জন্মদিনে তিন বোন বাবাকে একটি সঙ্গীতানুষ্ঠান উপহার দেন। শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়, রূপরেখা আর রাজ্যশ্রী। আমন্ত্রিত শিল্পী ছিলেন পল্লব ঘোষ। সম্মাননা জানানো হল সুধীন সরকারকে। রবীন্দ্রসদনে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠান মূলত ছিল পুরনো এবং প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের কণ্ঠে বহুশ্রুত জনপ্রিয় গানগুলি। প্রতি বছর যখন তাঁরা এই অনুষ্ঠান করছেন তখন একটা কথা বলতেই হচ্ছে, শিল্পীদের এই গতানুগতিক গান শোনানোর পরিবর্তনের প্রয়োজন। একমাত্র ব্যতিক্রম হলেন শ্রীরাধা। তিনি নিজের গীত গানগুলিই স্বকীয় ভঙ্গিতেই শুনিয়েছেন। রূপরেখা ও রাজ্যশ্রী দুজনের কণ্ঠই চর্চিত। রূপরেখার কণ্ঠে ‘চঞ্চল ময়ূরী’ বেশ জমজমাট। রাজ্যশ্রীর ‘এলোমেলো কথা’ শ্রোতাদের খুব আনন্দ দেয়। পল্লব ঘোষের গাওয়া গানগুলি যে বোধিতে গাওয়া হল তাতে মন ভরল না।
গান ও কবিতায়
ইন্দুমতী সভাগৃহে শোনা গেল কবিতা ও গানের কোলাজ ‘মেঘের ভেলায় এক সন্ধ্যা’। কৃষ্ণা বসুর ‘মেয়েমানুষের লাশ’ মন ছুঁয়ে যায়। পরে সুদেষ্ণা বসু শোনালেন ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’ গানটি। এই গানের সঙ্গে কবিতার মেলবন্ধন ঘটালেন সুস্মেলি দত্ত তাঁর নির্বাচিত কবিতায় ‘কেন ভালবাসলাম তোমাকে’। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে ছিল করবী ঘোষের রবীন্দ্র-নজরুলের কোলাজ ‘হৃদয়ে মন্দ্রিল’।
সব শেষে ছিল শ্রুতিনাটক ‘কলকাতার হৃদয় থেকে’।