ছবি: ধ্রুবনারায়ণ চৌধুরী
অক্সফোর্ড নগরীর ২০ ল্যাদবেরি রোডের তিনতলা বাড়ির গেটে ইংরেজরা সেটির প্রাক্তন বাসিন্দার সম্মানে একটা নীল প্লাক বসিয়েছে।
বলা হয়েছে সেই মান্যজন— এক লেখক— সেখানে বাস করেছেন ১৯৮২ থেকে ১৯৯৯ অবধি।
লেখকের নামও অবশ্যই আছে, এবং জন্ম ও মৃত্যুর সন— ১৮৯৭-১৯৯৯।
সেই লেখক তাঁর প্রথম বই, ইংরেজি আত্মজীবনীর নাম যতই রেখে থাকুন ‘দ্য অটোবায়োগ্রাফি অফ অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’, তাঁকে এখন অচেনা, অজানা বলে চালানো বেশ কঠিন।
দেশি ও বিদেশি মহলে জব্বর নাম করার জন্য যা করার তা ওই প্রথম বইতেই করে রেখেছিলেন ভদ্রলোক, কিন্তু সেখানেই তিনি থামেননি। তার পর আরও অর্ধশতক ধরে লিখে লিখে সাহেব-মেম এবং স্বদেশের পড়ুয়াদের অকাতরে তাতালেন এবং মাত করে গেলেন।
ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জের সেই নীরদচন্দ্র চৌধুরীকে তাঁর ইংরেজি লেখার দাপটের জন্য সবাই উল্লেখ করেন নীরদ সি চৌধুরী বলেই হামেশা। প্রায়শ কেবল নীরদ সি বলেই।
অক্সফোর্ডের ডি.লিট পেয়েছিলেন নীরদ সি ১৯৯০-এ, ইংলন্ডেশ্বরীর অর্পিত সি বি ই ১৯৯২-এ, একশ’ বছর বয়সে যে ‘থ্রি হর্সমেন অফ দ্য অ্যাপোক্যালিপস’ বইটি লিখলেন তা’ও ইংরেজিতে। কিন্তু ১০২ বছরের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থেকে গেলেন মনেপ্রাণে বাঙালি। অক্সফোর্ডের ডি.লিট নিতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় দেখা করতে গিয়েছিলেন নীরদ সি-র সঙ্গে। বেল দিতে, ‘আসুন! আসুন!’ করে দরজা খুললেন যে ইংরেজমুগ্ধ লেখক তাঁর পরনে কী? না, ধুতি, পাঞ্জাবি আর বিদ্যাসাগরী চটি।
মনেপ্রাণে তো থাকলেন বাঙালি, কিন্তু একবার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে সদ্য বিলেত ফেরত নীরদ সি যখন দেখা করতে গেলেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে, তখন ব্যাপারটা কী রকম দাঁড়িয়েছিল?
নীরদ সি গপ্পোটপ্পো সেরে বেরিয়ে যাচ্ছেন যখন, সুনীতিবাবু দেখলেন সাদা শার্ট, কালো স্যুট এবং টাইয়ে নিপাট বাবুটির ট্রাউজার্সের পকেট থেকে এক দেদার লম্বা লাল সিল্কের রুমাল উপচে পড়ে মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলছে।
সুনীতিবাবু ভদ্রতার বশে দৌড়ে গিয়ে রুমালটার তলার অংশ তুলে নিয়ে নীরদ সি-র হাতে দিলেন। নীরদ সি ফের সেটাকে মাটিতে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “ওটাই স্টাইল। ওটা ওভাবেই যাবে।”
নীরদ সি-র কাঙ্ক্ষিত ইংরেজিয়ানা এবং স্বভাব-সত্তার বাঙালিয়ানা মিলেজুলে কত যে কাণ্ড ঘটাত তার একটা নমুনাই যথেষ্ট। শেষ বারের মতো অক্সফোর্ডে গিয়ে তো শেষ জীবন ওখানেই কাটিয়ে দিলেন। গিয়েছিলেন একটা বৃত্তি নিয়ে এবং সে বৃত্তির মেয়াদ শেষ হতে অক্সফোর্ডের বিদ্বজ্জনেরা চেষ্টা চালালেন কোনও একটা আর্থিক সংস্থান করে ভদ্রলোককে ওখানে রেখে দিতে।
এই উদ্যোগ চলছে যখন নীরদ সি বন্ধুজনদের ধন্যবাদ জানাতে বাড়িতে একটা পার্টি দেন। সেখানে গিয়ে তো সাহেব-মেমদের চক্ষুস্থির। যাঁর জন্য টাকা তোলার কথা তাঁর পার্টিতে সুখাদ্য ও অভিজাত পানীয়ের কী ঢল! কী ঢল! তাঁদের আর কী খোঁজ পূর্ববঙ্গের বাঙালের (এই ‘বাঙাল’ শব্দটার জন্য আগেই মাফ চাইছি, আমিও বাঙাল) দাওয়াত কোন সুমেরু, কুমেরু অবধি দৌড়তে পারে?
চৌধুরী পরিবার। ছবি: পরিমল গোস্বামী
নীরদ সি এবং নীরদচন্দ্রের মধ্যেই দোলায়মান থেকে গেছে চৌধুরীমশাইয়ের জীবনটা চিরকাল। ম্যাক্স মুলর ও লর্ড ক্লাইভের জীবনী দু’টো এবং হিন্দুধর্ম বিষয়ে ‘হিন্দুইজম’ নামে বইটি বাদ দিলে ওঁর চোদ্দোটি ইংরেজি বইয়ের বাকি এগারোটিই কোনও না কোনও ভাবে ওঁরই আত্মজীবনী।
জীবনের প্রথম পঞ্চাশ বছর নিয়ে ‘আননোন ইন্ডিয়ান’ এবং ১৯৮৭-তে লেখা ‘দাই হ্যান্ড, গ্রেট অ্যানার্ক’-কে সরাসরি আত্মজীবনী ধরা হলেও বাকি সবের মধ্যেই এক বাঙালিরই ক্রমান্বয়ে আত্মানুসন্ধানের তাড়না চোখে পড়ে। কেন এই নিজেকে খোঁজা তা নিয়ে পাঠকের জিজ্ঞাসা তৈরি হওয়া আশ্চর্যের নয়, তবে তারও একটা যুক্তি তিনি গোড়াতেই জুগিয়ে গেছেন মহামতি প্লেটোকে উদ্ধৃত করে। দার্শনিক যেখানে বলছেন, একটা অপরীক্ষিত জীবন বাঁচার যোগ্য নয়। ইংরেজিতে দাঁড়িয়েছে, ‘অ্যান আনএগজামিন্ড লাইফ ইজ নট ওয়র্থ লিভিং’।
‘আননোন ইন্ডিয়ান’ এবং ওঁর আট সপ্তাহের প্রথম ইংল্যান্ড সফর নিয়ে লেখা বই ‘আ প্যাসেজ টু ইংল্যান্ড’-এ এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা এক অভিনব জীবনদর্শনেরই ছবি তুলে ধরে। তবে প্রথম বইটি খুঁটিয়ে পড়লে ধরা যায় কিশোরগঞ্জ থেকে উঠে আসা কিশোর নীরদকে কী কষ্টই না দিয়েছে তখনকার কলকাতা। ‘বাঙাল মনুষ্য নয়, উড়ে এক জন্তু’ এ সব তো শুনতেই হয়েছে, এবং তলে তলে টের পেয়েছেন কলকেতে মানুষ আড়ে ‘বাঙাল’ শব্দটার আগে একটা অনুচ্চারণীয় ইংরেজি শব্দ ‘ব্লাডি’-ও যোগ করে দেয়। ঠিক এই কথাটাই উনি বেদনার সঙ্গে লিখে গেছেন ওঁর আত্মজীবনীতে হুবহু।
বড় হয়ে এই কলকাতাতেই অবশ্য লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের সঙ্গে একই মেসের বাসিন্দা হয়েছেন। এক সময় সম্পাদকীয় দফতরে কাজ করেছেন ‘মডার্ন রিভিউ’, ‘প্রবাসী’ এবং ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকার। নিজেও পত্তন করেছেন স্বল্পজীবী দুই পত্রিকা ‘সমসাময়িক’ এবং ‘নতুন পত্রিকা’-র। তথাপি প্রথম ইংরেজি বইটি লেখার সময় ভূমিকায় বলেছেন, আমি জীবনের প্রথম পঞ্চাশটা বছর মুছে ফেলে নতুন করে বাঁচতে চাই। বন্ধুরা মনে করেন আমি এক ব্যর্থ মানুষ, আর এই বই লিখে সেই ব্যর্থতার এক অজুহাত খাড়া করতে চাইছি। তবে আমি সেই তথাকথিত পরাজয় এবং সেই পরাজয় স্বীকারের মাঝখানে একটা সরু, লোনা জলের দুরতিক্রম্য নদী বইয়ে দিতে চাইছি। রণে ভঙ্গ আমি দিচ্ছি না।
বই জুড়ে কাদের ক’ হাত নিলেন তার চেয়েও বড় সমস্যা হল বইটির উৎসর্গপত্র। কাকে উৎসর্গ? না, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্মৃতিতে। আর যোগ করা হল কী? না “যেহেতু আমাদের মধ্যে যা কিছু সুন্দর ও সজীব সৃষ্টি হয়েছিল, আকার ও শক্তি পেয়েছিল ওই ব্রিটিশ শাসনেই”! বলতে নেই, সদ্য স্বাধীন ভারতে এর চেয়ে বড় দেশদ্রোহিতা আর কী হতে পারত? কেউ খেয়ালই রাখল না নীরদ সি ওই উৎসর্গের মধ্যেই খেদ করেছেন যে ব্রিটিশ রাজ আমাদের প্রজা রেখেছেন কিন্তু নাগরিকত্ব দেননি।
নীরদ সি পরে লিখেছেন যে উৎসর্গপত্রের ছদ্ম মেজাজ ও বাণী তখনকার রাজনীতি ও প্রশাসন মহল ধরতেই পারেনি। বড় কথা, উৎসর্গটুকু পড়েই তাঁরা ক্ষান্ত দিয়েছিলেন, বইটার মধ্যে পূর্ববঙ্গ, কলকাতা ও ভারতজীবনের যে সূক্ষ্ম বর্ণনা ও বিশ্লেষণ ছড়িয়ে তাতে ঢোকার চেষ্টাও করেননি।
আরও বড় কথা, নীরদ সি বইয়ের টাইটেল পেজ-এ ফরাসি সূক্তিকার লা রশফুকোর ‘মাক্সিম্’ থেকে যে অপূর্ব উদ্ধৃতিটা দিয়েছিলেন তা তাঁদের মাথায় ঢোকেনি, কারণ কথাটা দিয়েছিলেন তিনি ফরাসিতেই, ইংরেজি তর্জমায় নয়। তাতে নিজেকে নিয়েও যে কিছুটা ঠাট্টা ছিল তাও বোঝা যায়। কথাটা ছিল: যত বুড়ো হয় মানুষ, ততই জ্ঞান বাড়ে তার, আর সেই সঙ্গে পাগলামিও।
ব্রিটিশ শাসন, শিক্ষা ও সংস্কৃতির গুণগ্রাহিতা প্রকাশ করতে নীরদচন্দ্রকে ১৯৫৯-এ ‘আ প্যাসেজ টু ইংল্যান্ড’ লেখা অবধি অপেক্ষা করতে হয়নি। ‘আননোন ইন্ডিয়ান’-এর চতুর্থ পরিচ্ছেদটাই তিনি নিয়োগ করেছেন বিলাতের প্রভাব ব্যাখ্যায় এবং সেটির নামকরণ করেছেন ‘ইংল্যান্ড’।
নিজের জন্মস্থান, পুরনো গ্রাম এবং মায়ের গ্রাম নিয়ে তিনটি অতীব সুলিখিত এবং অবিস্মরণীয় তিনটি পরিচ্ছেদের পর হায় হায় কী এক চ্যাপ্টার! শুরুই করেছেন এই বলে যে, আমি মনেই করতে পারি না এমন একটা সময় যখন আমি রানি ভিক্টোরিয়া, প্রিন্স অ্যালবার্ট, নেপোলিয়ন, শেক্সপিয়র বা রাফায়েলের নাম জানতাম না।
রামায়ণ ও মহাভারত পড়া ধরতে বালক নীরদের পরিচয় ঘটে যায় হোমারের নামের সঙ্গে। প্রায় একই নিঃশ্বাসে ও প্রশ্বাসে তখন ধারণ করা শুরু হয়েছে দেশি ও বিদেশি জ্ঞানের রসবস্তু।
কিশোরগঞ্জের মতো এক ক্ষুদ্র জায়গার পাবলিক লাইব্রেরিতে কিশোর নীরদ পেয়ে গেছে নেপোলিয়নের খানসামা কঁস্তঁ-র স্মৃতিকথা। আর নিজেদের বাড়ির বইয়ের আলমারি থেকে স্যর নিল ক্যাম্বেলের-এর ‘নেপোলিয়ন অ্যাট ফঁত্যানব্লো অ্যান্ড এলবা’ বইয়ের এক ছেঁড়াফাটা কপি। ভারতে ইংরেজরা না এলে এ ঘটনা কখনও সম্ভব ছিল না বলে মনে করতেন নীরদচন্দ্র।
নীরদচন্দ্র এই মনে করাটা সারা জীবন ধরে রেখেছিলেন। ওঁর রচনাবলি পাঠ করলে এই ধারণাটাকে এক বিশুদ্ধ বাঙালির আন্তরিক অনুভূতি বলে মনে হয়। কোনও খাদ নেই, তবে তাতে রশফুকো কথিত একটা পাগলামি আছে। যা ভদ্রলোকের ওই বিশ্রুত জেদ ও উৎকেন্দ্রিকতার ভিত্তি হয়তো।
এক অপূর্ব স্বাভিমানী বাঙালি যেভাবে সারা জীবন ইংরেজিয়ানা চর্চা করে গেলেন তা বাঙালি মনীষার বিকাশেরও একটা রূপরেখা স্পষ্ট করে। এবং সেই ছবিটার ভুল ব্যাখ্যা করার কোনও সুযোগই তাঁর বিরোধীরা কখনও হাতছাড়া করেননি।
জানি না সে জন্যই কিনা নীরদচন্দ্র একবার এক কাণ্ড ঘটালেন কলকাতার ম্যাক্সমুলার ভবনে। বিবরণটা শুনেছিলাম আমার কলেজের বন্ধু, ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী ছাত্র এবং পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সচিব প্রদীপ ভট্টাচার্যের মুখে।
সেই অনুষ্ঠানে কবি অধ্যাপক পুরুষোত্তম লাল নীরদ সি-কে কালিদাস নাগ পদক অর্পণ করেছিলেন। নীরদ সি-র দায়িত্ব ছিল একটা বক্তৃতা দেবার। তিনি বিলকুল স্যুটবুট পরে জমকালো হয়ে মঞ্চে এলেন। বহু নিন্দুকের বহু প্রশ্নের জবাব দেবার ব্রাহ্মমুহূর্ত যেন। প্রদীপ বললেন, আমরা হাঁ হয়ে গেলাম দেখে নীরদবাবু কোমরে ঝুলিয়ে এনেছেন ঝাঁ চকচকে এক লম্বা বিলিতি সোর্ড। ঘটা করে সেটা খাপ থেকে বার করে সামনের টেবিলে শোয়ালেন। একটু নাড়ানাড়িও করলেন, তারপর বলা শুরু করলেন। কাদের জন্য এই আস্ফালন তা কারও বুঝতে বাকি রইল না।
একটা ছেলেমানুষের হেক্কারিও ছিল নীরদ সি-র। একশ’য় পৌঁছে শেষ বইটা লিখে বলেছিলেন, কোথায় গেল আমার সেই সব ক্রিটিকরা? আমি তো এই বয়সেও কলম চালাচ্ছি, তারা তো মরে ভূত!
অথচ এই নীরদচন্দ্রের বিয়ে হল যখন অমিয়া ধরের সঙ্গে তখন বাবুটি টিঙটিঙে রোগা।
রাতে বুকে হাত ডলে দিতে দিতে স্ত্রী বলেছিলেন, বড্ড রোগা তুমি। তবে ভেবো না, আমি তোমার দেখাশোনা করে শরীর ঠিক করে দোব।
ভাল দেখাশোনাই করেছিলেন নিশ্চয়ই, না’হলে জীবনের প্রথম পঞ্চাশ বছর এত ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে গিয়েও এত দীর্ঘ জীবন পেলেন কী করে নীরদচন্দ্র! আবার এই স্ত্রীকে বিয়ে করে ঘরে আনার যে বৃত্তান্ত শুনিয়েছেন তিনি আত্মজীবনীতে তাও বড় মর্মস্পর্শী।
নীরদচন্দ্রের বিবাহ ঠিক হয়েছে অমিয়ার সঙ্গে। সেই খবরে এক পারিবারিক বন্ধু ওঁকে বিবাহ সংক্রান্ত উপদেশ-পরামর্শ দিতে হাজির হলেন। পরামর্শ হল, একটা শ্যামবর্ণ মেয়েকে কেন বিয়ে করতে যাচ্ছ? তাতে যে কন্যারা জন্মাবে তাদের বিয়ে দিয়ে পার করতেও তো হিমশিম খাবে। ফর্সা মেয়ের কি এতই অভাব!
প্রথম প্রথম ব্যাপারটা হেসে ওড়াবার চেষ্টা করেছিলেন নীরদচন্দ্র, শেষে ভেতরে ভেতরে এতই ক্ষিপ্ত হন যে সটান বাবাকে গিয়ে জানিয়ে দেন যে তাঁর বিয়েতে এই লোকটি যদি আমন্ত্রিত হন তো তিনি বিয়েই করবেন না। বাবা বড়ই বিব্রত হয়েছিলেন কারণ ভদ্রলোক পরিবারের নানা উপকারে এসেছেন আগে। শেষে কোনও মতে রাগ সামলে নীরদচন্দ্র চুপ করে গেলেন, আপত্তি বাড়ালেন না। এই ক্রোধ সংযম ওঁর কাজে এসেছে বলে পরে মনে হয়েছে। কন্যার বদলে তাঁকে তিন-তিন পুত্রের জনক করেছেন ভাগ্যবিধাতা, এবং তাদের গাত্রবর্ণ কালো নয়, বড় জোর বাদামি।
১৯৫৫ সালের বসন্তে বিবিসি-র আমন্ত্রণে তাঁর প্রথম ইংল্যান্ড সফরে যেতে পারলেন নীরদ সি, তখন আর তিনি কোনও অর্থেই অচেনা, অজানা, কেউ একটা নন। ইংল্যান্ডে বেরিয়ে বিবিসি-র ওভারসিজ সার্ভিসের জন্য কিছু বক্তৃতা দেবার কথা ছিল ওঁর। সেই বক্তৃতাবলি এবং আনুষঙ্গিক সংযোজন সমেত ১৯৫৯ সালে প্রকাশ পেল ইংল্যান্ড নিয়ে নীরদ সি-র অপরূপ মানসভ্রমণ ‘আ প্যাসেজ টু ইংল্যান্ড’। কেন অপরূপ, প্রায় রূপকথার মতো, সেটা বলা দরকার। তবে সে বলাটা নীরদ সি-ই বলে রেখেছেন ‘আ প্যাসেজ টু ইংল্যান্ড’-এর শুরুতে। বলছেন.....
“যেদিন ইংল্যান্ডের প্লেনে চড়লাম আমার বয়স সেদিন ঠিক ২,৯৯২ সপ্তাহ। আমি বিদেশে ছিলাম আট সপ্তাহ। তাতে আমার বয়স দাঁড়াল সফর শেষে ৩,০০০ সপ্তাহ। যে কারণে এই সংখ্যাগুলো গুরুত্বপূর্ণ তা হল এই আট সপ্তাহে আমি যা নাটক, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, ইমারত ও সৌধ, গির্জা ও ক্যাথিড্রাল, সুন্দর দৃশ্যপট, বাগান ও ফুল দেখলাম এবং সঙ্গীত ও কাব্য শুনলাম তা বাকি জীবনে দেখিনি বা শুনিনি।
“...তাতে এমনটা মনে করতে পারি না যে পাশ্চাত্য সম্পর্কে উচ্ছাসী হওয়ায় আমাদের সব চেয়ে বড় অন্তরায় আমাদের দেশাত্মবোধ। একজন মানুষের পক্ষে নিজের দেশকে একভাবে এবং বিদেশকে আরেক ভাবে ভালবাসা খুবই সম্ভব।”
এই দ্বিবিধ প্রণয় যে সম্ভব তার জলজ্যান্ত প্রমাণ নীরদচন্দ্র স্বয়ং এবং তাঁর প্রথম দুটি বই। ‘আননোন ইন্ডিয়ান’-এ কিশোরগঞ্জ ও অন্য কিছু গ্রামের যে বর্ণনা নীরদচন্দ্র ইংরেজিতে লিখেছেন অমন অপূর্ব, সূক্ষ্ম, সুললিত অথচ বাস্তব বর্ণনা, আমি বাংলা ভাষাতেও বিশেষ একটা পড়েছি বলে মনে হয় না। অমন দেখার চোখ রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ ও বিভূতিভূষণের সঙ্গে তুলনীয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষে খুলনা শহরে গেছি যখন পৈতৃক ভিটা দেখতে কেনই জানি না প্রথমেই স্মরণে এসেছিল নীরদচন্দ্রের কিশোরগঞ্জের বর্ণনা। কী যে অনুরাগ ও ভালবাসা ভিটেমাটি, নদনদী, মানুষের প্রতি যে আজও আমার চোখে জল আনে ‘আননোন ইন্ডিয়ান’-এর বহু অংশ। মাফ করবেন, আমি তাঁর অগণিত পাঠকবর্গের সামান্য একজন মাত্র।
আর এই নীরদচন্দ্র, থুড়ি নীরদ সি যখন প্রথম ইংল্যান্ড সফরে দিল্লি থেকে প্লেনে উড়তে উড়তে শনাক্ত করতে থাকেন রাজপুতানার মরুভূমি, বেলুচিস্তানের পাথুরে তীরভূমি, জলধিকে কুর্নিশ করা ওমানের স্থলভূমি, ইতালির নেপলসের চারপাশ ঘিরে থাকা সবুজ কাম্পানিয়া, ক্রমে জার্মানি, বেলজিয়াম এবং অবশেষে লন্ডনের সন্নিকটে কেন্ট গ্রামদেশ— তখন কি আমরা বিস্মিত না হয়ে পারি? শুধু ভদ্রলোকের আশ্চর্য ভূগোলজ্ঞানেই নয়, ওঁর প্রায় অতুল্য আত্মীকরণ শক্তিতে। ইউরোপের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও নৃতত্ত্বকে প্রায় গুলে খেয়ে রক্তে চালান করেছেন যেন। এই মানুষের ভালবাসাকে রোধ করে কে?
ভূগোল প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল একটা দৃশ্য। সংস্কৃত পণ্ডিত ও প্রাবন্ধিক সদ্য প্রয়াত সুকুমারী ভট্টাচার্য অক্সফোর্ডে দেখা করতে গেছেন নীরদচন্দ্রের সঙ্গে। গিয়ে দেখেন নব্বই-এর কোঠায় বয়স নীরদবাবু আতস কাচ ধরে একটা ম্যাপ অধ্যয়ন করছেন। আমায় বলেছিলেন সুকুমারীদি, ওই একটা দৃশ্যই মনটা শ্রদ্ধা ও সমীহে ভরিয়ে দিল।
১৯৬৭ সালে দেশ পত্রিকায় একটা প্রবন্ধ লিখে মস্ত ঝড় তুলেছিলেন নীরদচন্দ্র। প্রবন্ধের বিষয় ‘দুই রবীন্দ্রনাথ’। তাতে ওঁর অভিযোগ ছিল যে অত গভীর ও শিকড়গত ভাবে বাঙালি (যদিও বাঙালির দ্বারা সর্বাপেক্ষা লাঞ্ছিত) রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্যের সম্মান ও স্বীকৃতিতে অযথা বেশি গুরুত্ব দিয়ে নিজের ক্ষতি করেছেন। ওঁর ওই বক্তব্য নিয়ে আলোচনায় যাব না এখানে। তবে উল্লেখ যে করলাম তার কারণ প্রথম বইটি লেখার পর থেকেই নীরদচন্দ্র এবং নীরদ সি-র মধ্যে অনুরূপ এক বিভাজন তৈরি করার চেষ্টা হয়ে এসেছে। নীরদবাবু সেটা মানেননি, কিন্তু তর্কটাকে ক্রমাগত উস্কে গেছেন। শেষ দিকে অঢেল সমালোচনাও করেছেন ব্রিটিশদের। তাতে হয়তো ওঁদের কাছে আরও প্রাসঙ্গিক হয়েছেন। কিন্তু এ দেশে?
যুক্তি, প্রশ্রয় ও ভালবাসা দিয়ে পড়লে নীরদচন্দ্র ও নীরদ সি কিন্তু অবলীলায় এক হয়ে যেতে পারেন আমাদের ভাবনাচিন্তায়ও।