বাড়িতে হয়তো কোনও অতিথি আসার কথা। আপনি জানেন যে, তিনি মোটেই মাছ-মাংস খান না। বিশুদ্ধ শাকাহারী মানুষ আপনার সেই অতিথি। তা হলে তাঁকে খেতে দেবেন কী? স্বাভাবিক ভাবেই আপনার মাথায় আসে ডাল, পনির বা ছানার কোনও জমাটি পদের কথা। কিন্তু যেই আপনি শুনলেন যে অতিথি ‘ভিগান’, আপনার তো মাথায় হাত!
এ বার প্রশ্নটা হল, ভিগান কী? মানে, ভেজিটেরিয়ান শুনেছেন। কিন্তু ‘ভিগান’ বিষয়টা কি বেশ নতুন ঠেকল? তা হলে বলা জরুরি, এখন প্রায় গোটা বিশ্ব মেতে উঠেছে ভিগানিজম নিয়ে।
ভিগানিজমের প্রাথমিক পরিচিতি
ভিগানিজম হল এমন এক খাদ্যাভ্যাস, যেখানে মানুষ খাবারে প্রাণিজাত দ্রব্য সম্পূর্ণ ভাবে এড়িয়ে চলেন। তার মানেই যে তিনি শুধু মাছ, মাংস বা ডিম খান না, তা নয়। দুধ যেহেতু নানা রকম প্রাণীর কাছ থেকে আসে, তাই ভিগানরা দুধও এড়িয়ে চলেন। ফলে প্রাণীর দুধ থেকে তৈরি মাখন, ঘি, পনির, ছানা কিংবা মধু— সমস্ত কিছুই তাঁদের ডায়েটে ব্রাত্য।
ভাল-খারাপ দিকগুলি
যে সব বাড়িতে বিশুদ্ধ নিরামিষ খাওয়া হয়, সেই সব বাড়িতেও সম্ভবত সকলে দুধ খেয়ে থাকেন (যদি না কোনও রকম ডেয়ারি অ্যালার্জি থাকে)। অর্থাৎ খাদ্যাভ্যাস আমিষ হোক কিংবা নিরামিষ— দুধ আমাদের ডায়েটের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। যাঁরা মাছ-মাংস ছুঁয়ে দেখেন না, তাঁরাও শক্তির অন্যতম উপাদান হিসেবে বেছে নেন দুধ। তা হলে যাঁরা ভিগান ডায়েটের দিকে ঝুঁকছেন, তাঁরা কি নিজে যেচে এমন ডায়েট বেছে নিচ্ছেন, যা অপুষ্টিতে ভরপুর? ভিগান ডায়েট কি আদৌ শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ মেটাতে সক্ষম?
অনেক পুষ্টিবিদই বলছেন, যদি সুষম ভিগান ডায়েটে কেউ অভ্যস্ত হয়ে থাকেন, তা হলে হৃদ্রোগ-সহ নানা রোগকে সহজেই মোকাবিলা করা যায়। ভিগান ডায়েটে মূলত ডায়েটারি ফাইবার, ম্যাগনেশিয়াম, ফোলিক অ্যাসিড, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই ইত্যাদি বেশি পরিমাণে থাকে। আবার ডায়েটারি এনার্জি, স্যাচিয়রেটেড ফ্যাট, কোলেস্টেরল, লং চেন ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন ডি, ক্যালশিয়াম, জিঙ্ক তুলনায় কম পরিমাণে পাওয়া যায় এই ডায়েটে। তাই ভিগান ডায়েট তৈরির ক্ষেত্রে সমস্ত ভিটামিন এবং মিনারেল গ্রহণের দিকে খেয়াল রাখা জরুরি। ফলে কেউ যদি সুষমতা বজায় রেখে ভিগান ডায়েট নিতে পারেন, তা হলে তা ক্ষতিকর নয় বলেই মনে করেন পুষ্টিবিদরা।
একদম ছোট শিশু, সন্তানসম্ভবা এবং নতুন মা যাঁরা স্তন্যপান করান— তাঁরা ভিগান ডায়েট মেনে না চললেই ভাল।
আবার অনেকেই বলছেন, ভিগান ডায়েটের সঙ্গে আয়রন, বি টুয়েলভ সাপ্লিমেন্ট নেওয়াটা ভীষণ ভাবে জরুরি। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে খাবারে পুষ্টির অভাবের দিকটি পূরণ করে নিতে হবে।
কতটা স্বাস্থ্যসম্মত?
ভিগান ডায়েট কি আদৌ স্বাস্থ্যসম্মত? যে কোনও ডায়েটই যদি সুষম না হয়, তা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক। সেটা ভিগান, ভেজিটেরিয়ান বা নন-ভেজিটেরিয়ান... যা-ই হোক না কেন। তাই যদি ঠিক মতো মেপে শস্য, ফল, আনাজ, উদ্ভিজ্জ প্রোটিন— সবই ডায়েটে রাখা যায়, তা হলে ভিগান ডায়েটে কোনও সমস্যা নেই, এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। যে কোনও নিরামিষাশীকেই প্রোটিনের চাহিদা পূরণের জন্য বেশি পরিমাণে দুধ, ঘি, ছানা, পনির ইত্যাদি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ভিগানে যেহেতু সেগুলোই বাদ, সে ক্ষেত্রে রয়ে যায় প্রোটিনের প্রসঙ্গে প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে ভিগানরা প্রচুর পরিমাণে ডাল, বাদাম খেতে পারেন, যা থেকে প্রোটিনের চাহিদা মিটতে পারে। তবে হঠাৎ করে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের আগে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া শ্রেয়।
ভিগান হওয়ার পক্ষে সওয়াল
এ বার স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, আপনি কেন ভিগান ডায়েট বেছে নেবেন? তা কি শুধু আপনার পছন্দের কোনও তারকা ভিগান মন্ত্রে বিশ্বাস করেন বলে? না কি এর পিছনে সত্যিই লুকিয়ে রয়েছে অন্য কোনও রহস্য?
এই ডায়েট বেছে নেওয়ার প্রথম কারণটাই হতে পারে সহমর্মিতা। শুধু মাত্র পশুপাখির প্রতি দয়া এবং মায়ার কারণেই আপনি বেছে নিতে পারেন এই ডায়েট।
কিন্তু যদি শারীরিক দিকটাও লক্ষ করা যায়, তা হলে অনেক বিশেষজ্ঞই বলছেন, ভিগান ডায়েটের পিছনে লুকিয়ে আছে সুস্থ থাকার চাবিকাঠি। অতিরিক্ত ওজন কমানো, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা, কোলেস্টেরলের মাত্রা ঠিক রাখা, ডায়াবিটিস কিংবা হৃদযন্ত্রের নানা রোগ কমিয়ে দেওয়া, কিডনির সমস্যার দেখভাল, হজমে সাহায্য করা ইত্যাদি হাজারো কাজে সুবিধে করে ভিগান খাদ্যাভ্যাস। এমনকী ভাল ঘুম হওয়া, ত্বক আরও উজ্জ্বল রাখতেও সাহায্য করে এই ডায়েট।
স্বাস্থ্য সচেতনতা বা প্রাণিপ্রেম ছাড়াও ভিগানরা পরোক্ষ ভাবে নিজের পরিবেশ বাঁচানোরও কাজে সাহায্য করছেন। যেহেতু ভিগান ডায়েট মূলত শাক-আনাজের উপর নির্ভর করেই থাকে, তাই গাছও লাগাতে হয় বেশি পরিমাণে। এর ফলে পরোক্ষ ভাবে গ্রিন হাউস গ্যাসের কুপ্রভাব, জলের অপচয়, খরা ইত্যাদি সমস্যা মোকাবিলার কাজেও লাগে।
স্বাদে আপস নয়
সারা দিন ধরে খাচ্ছেন আনাজপাতি, ফলমূল। অথচ খাবারের স্বাদের সঙ্গে মোটেও আপস করবেন না, এ যেন ভাবাই যায় না। অথচ এটাই সত্যি। আপনি হয়তো বার্গার-অন্ত প্রাণ। কিন্তু মাংস ছেড়েছেন বলে কি বার্গার খাওয়া বন্ধ করবেন? তা নয়। বরং এঁচোড় দিয়ে জমিয়ে রাঁধতে পারেন বার্গারের প্যাটি। ভিগানরা বলছেন, সে স্বাদের ভাগ হবে না মোটেও। আবার দুধ আপনার বড্ড প্রিয়। ভিগান হওয়ার জন্য খাদ্যতালিকা থেকে প্রাণিজাত দুধ অবশ্যই বাদ। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আমন্ড বা সয়াবিন থেকে তৈরি দুধ খেতে পারেন নির্দ্বিধায়। এমনকী আমন্ড বাটারও চলবে স্বচ্ছন্দে। পনির খেতে পারছেন না, কিন্তু টোফু খেতে পারবেন দেদার। এর পাশাপাশি ডাল জাতীয় প্রোটিন, যে কোনও ধরনের বাদাম (তা থেকে তৈরি দুধ ও মাখনও), শিয়া বা ফ্ল্যাক্স জাতীয় বীজ, শাক খেতে পারেন প্রচুর পরিমাণে। ফলে এই ডায়েটে নিঃসন্দেহে খাবারের বাছবিচার বাড়ছে, কিন্তু একই ভাবে খুলে যাচ্ছে সবুজের দুনিয়া।
আপনার খাদ্যাভ্যাস ব্যক্তিগত। তাতে কী রাখবেন আর কী বাদ দেবেন, সেই সিদ্ধান্তও আপনারই। তবে আপনি আমিষ খেতে পছন্দ করেন এবং আপনার পাশের বন্ধুটি ভিগান বলে আপনি ভ্রু কুঁচকে তাঁকে জরিপ করছেন, তা ঠিক নয়। বরং পাশাপাশি থাকুক সব খাদ্যাভ্যাসই। এই বৈচিত্রময় পৃথিবীতে কারও সঙ্গে বৈরিতা নেই কোনও!
মডেল: মুনমুন রায়; মেকআপ: অভিজিৎ পাল; ছবি: অমিত দাস;
পোশাক: লাইফস্টাইল, কোয়েস্ট; লোকেশন: দ্য হলিডে ইন, এয়ারপোর্ট