শৈল্পিক: দেবভাষা গ্যালারিতে আয়োজিত সনৎ করের প্রদর্শনী। ফাইল ছবি।
দেবভাষা গ্যালারিতে আয়োজিত সনৎ করের প্রদর্শনীতে তাঁর ছাপাই ছবি রাখা হয়েছিল কমবেশি ষোলোটি। এ ছাড়াও প্যাস্টেল ড্রয়িং, টেম্পারা এবং ওয়াশের ছবি দেখা গেল বাইশটির মতো। ওই গ্যালারির প্রথম প্রদর্শনীটিই ছিল সনৎ করের ছবির, বছর কয়েক আগে আয়োজিত। সেই কারণেই হয়তো শিল্পীর জীবনাবসানের পরে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে দেবভাষা।
এ ছাড়া ছবির সঙ্গে আছে সাদা কাপড়ের মলাটে কালো একটি স্কেচ খাতা, যেটি সাধারণ খাতার মতো নয় একেবারেই। এতে আছে সনৎ করের বহু ড্রয়িং এবং তাঁর শিল্প সম্পর্কিত নানা চিন্তাভাবনা, যেগুলি অমূল্য সম্পদ। এই ধরনের স্কেচ খাতা থেকেই আমরা শিল্পীর মনের গভীরে কী ছিল, ছবি সম্পর্কে কী কথা বলে গিয়েছেন তিনি, টেকনিক নিয়ে কিছু সমস্যার কথা— সেই সব কিছুর সন্ধান পাই। ওই খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় হার্বার্ট রিডের একটি কথা উদ্ধৃত করেছেন সনৎ ‘The world of art is a world without justice’। শিল্পকর্মের পুরো জগৎটাই পৃথিবীর সাধারণ ন্যায়-অন্যায় বিচারের বাইরে। সনৎ করের শিল্পকর্মে ওই উক্তির ছায়া হয়তো পাওয়া যায়।
শিল্পী বলেছেন যে, শিল্পের সঙ্গে একটা সম্প্রীতি সৃষ্টি করা যায় বা শিল্প সৃষ্টি তখনই সম্ভব, যখন ধরাছোঁয়ার জগৎটাকে ছাড়িয়ে একটা অতীন্দ্রিয় বাস্তবতাকে চেনা যায়, যেটাকে অনেকে চরম বা চূড়ান্ত সৌন্দর্য বা প্রেম বলেন। সেই উত্থান থেকে আবার নেমে এসে অনুরূপ আর এক প্রেম এ জগতের মুখোমুখি হওয়া। এই দু’টির মাঝামাঝি জায়গাতেই শিল্পের সাফল্য। সেটাই যেন বারবার ফিরে এসেছে সনৎ করের শিল্পকর্মে।
সনৎ কর এচিং স্টুডিয়ো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বহু যুগ আগে। তারই সঙ্গে কমিউনিটি গ্রাফিক্স ওয়ার্কশপের কাজও চালু রাখেন। ব্লক-মেকার কালীদা তাঁকে সন্ধান দেন ছাপা কালির নাইট্রিক-অ্যাসিড সহিষ্ণুতার। তারপর থেকেই নানা ভাবে ছাপাই ছবি করতে শুরু করেন। উড ইন্টালিয়ো বা কাঠের উপরে খোদাই করে তার ছাপ নেওয়া, কার্ডবোর্ডের উপরে ছাপাই কাজ, সানমাইকার উপরে কাজ... ইত্যাদিতে পারদর্শিতা অর্জন করার পর, এমনকী মেসোনাইটের উপরেও ইন্টালিয়োর কাজ শুরু করেন। নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন শিল্পী, ফের অন্য পথে যাত্রা। তখন ভেবেছিলেন ছাপাই ছবির সাধারণ পদ্ধতিতে নান্দনিক গুণাগুণ অসম্ভব। কিন্তু পরবর্তীকালে সে সবই নিজের ছাপাই ছবিতে আনতে সক্ষম হন সনৎ। আসলে ব্রোঞ্জ বা জিঙ্ক প্লেটের দাম বাড়াতে কাঠের কাজ করা শুরু। তারপর দামি সেগুন কাঠের উপরে ছাপাই করা ছেড়ে সাধারণ প্লাইবোর্ড ব্যবহার করা শুরু করেন।
ওয়াশে যে ছবি এই প্রদর্শনীতে আছে তা সম্পূর্ণ নিজের মতো করেই করেছেন সনৎ। আমাদের পুরনো বেঙ্গল স্কুল ওয়াশের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তুলি দিয়ে কালির রং কাগজে ভাসিয়ে একটি বিস্মিত মুখের আদল।
কাঠের উপরে রঙিন খোদাই করা একটি ছবিতে বৈষ্ণব পদাবলীর শ্লোক খোদিত অবস্থায় আছে। এটি বোধহয় সনৎ করের প্রথম উড ইন্টালিও ছবি। ডিজ়াইনে চমৎকার নকশা রয়েছে, খানিকটা স্টেনড গ্লাসের ধাঁচের।
একটি ছবিতে সানমাইকার উপরে এনগ্রেভিং করা একটি মুখ। সেই খোদাইয়ে অসম্ভব পারদর্শিতার পরিচয় রেখেছেন শিল্পী। আপাতদৃষ্টিতে একটি ঘোড়া বা ওই জাতীয় পশুর মুখ বলেই মনে হয়, কিন্তু আসলে সেটি একটি পুরুষের পার্শ্ব-মুখ। সানমাইকার উপরে ছাপাই ছবির নজির বড় একটা ছিল না তখন। মোটামুটি ভাবে কার্ডবোর্ডের উপরে বা সানমাইকার উপরে ছাপাই কাজে অন্যতম পথিকৃৎ বলা যেতে পারে তাঁকেই। এ ছাড়া ঐতিহ্যগত ব্রোঞ্জের ছাপাই কাজ তো অনেক করেছেন।
আরও একটি ছবি, সেখানে কাগজে টেম্পারা রং দিয়ে একটি নারীমূর্তি এঁকেছেন। সেখানে দেখা যায় সনৎ করের সেই বিখ্যাত বিস্ফারিত চোখ। আধা-বিমূর্ত এই শরীরে ওই চোখই তাঁর ছবিকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়।
এর পরে আর একটি ছবিতে মিলেমিশে তালগোল পাকানো কিছু মুখ। মানুষগুলোর শরীরী উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে। এটি ছাপাই ছবি নয়। দেবভাষার সংগৃহীত ছবির সম্ভার থেকে উঠে আসে চারকোল এবং প্যাস্টেলে করা একটি ছবি। আশপাশে জোড়ায় জোড়ায় হাত ঊর্ধ্বমুখী এবং দেখতে কিছুটা ফুটতে-চাওয়া ফুলের পাপড়ির মতো।
বৈষ্ণব পদাবলীর পদে শোভিত আরও একটি ছবি এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে, যেটি রঙিন লিথোগ্রাফ। অবয়বহীন রাধাভাবের একটি সুন্দর ছাপাই ছবি।
এ ছাড়াও আছে রঙিন একটি নারীমূর্তির এচিং বা ছাপাই ছবি। তার ভাবে বা ভঙ্গিমাতেই সম্ভবত সে নারী, অবয়বে নয়।
শিল্পী সনৎ করের সমস্ত ছবিতেই, সে ছাপাই কাজ হোক বা কালি-তুলি, টেম্পারা প্যাস্টেল বা অন্য যে কোনও ধরনের ছবিই হোক, প্রথমত অসামান্য বিমূর্তকরণ দেখা যায়। এ ছাড়া ছাপাই কাজে তাঁর পরীক্ষানিরীক্ষা অক্লান্ত তো ছিলই এবং তাতে যে চরম সিদ্ধিলাভ করেছিলেন শিল্পী, এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।