পরের পর মৃত্যু সয়েছেন।
তবু এক বার চেয়েছিলেন মেয়ের অপঘাতে প্রাণ যাক! কিন্তু কেন?
মারা যেতে পারতেন অকালে।
এক সময় ভেবেছিলেন ‘শেষ’ করে দেবেন নিজেকে!
কবির জীবনে মরণের যে কী নিরবচ্ছিন্ন বিধ্বংসী খেলা!
ডুবেই যেতেন নদীতে
পূর্ববঙ্গের পান্টি থেকে বোটের পাল তুলে আসছিলেন। গোরাই ব্রিজের নীচে এসে বোটের মাস্তুল আটকে গেল ব্রিজে।
এক দিকে নদীর স্রোত প্রবল ধাক্কা মারছে নৌকাকে, অন্য দিকে ব্রিজে-আটকানো মাস্তুল টেনে ধরে রেখেছে তাকে।
মড়মড় করে মাস্তুল যখন হেলতে শুরু করেছে, কোত্থেকে একটা খেয়া নৌকো এসে উদ্ধার করে রবীন্দ্রনাথকে!
বোটের কাছি নিয়ে দু’জন মাল্লা জলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে ডাঙায় উঠে টেনে আনল খেয়া।
২০ জুলাই, ১৮৯২। শিলাইদহ থেকে স্ত্রী মৃণালিনীকে রবীন্দ্রনাথ সেই দুর্ঘটনার কথা জানিয়ে লিখলেন, ‘‘ভাগ্যি সেই নৌকো এবং ডাঙ্গায় অনেক লোক উপস্থিত ছিল, তাই আমরা উদ্ধার পেলুম, নইলে আমাদের বাঁচার কোন উপায় ছিল না।’’
আর লিখলেন, ‘‘মাঝিরা বলচে এ বার অযাত্রা হয়েচে।’’
গনতকার রায় দিয়েছিলেন অকালমৃত্যুর
১৮৯২-এর জুন।
জমিদারি দেখাশোনার কাজে পরিবার থেকে দূরে সেই পূর্ববঙ্গে সাহাজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ।
স্ত্রী মৃণালিনীকে মাঝে মাঝেই চিঠি লেখেন। উত্তর না পেলে অভিমান করেন।
একদিন লিখেছিলেন এক গনতকারের কথা। এলাকার প্রধান গনতকার। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নিজের জীবনে কবি মোটে সঞ্চয়ী হবেন না, তাঁর স্ত্রী-টি বেশ ভালো, যাঁদের উপকার করেছেন তাঁরাই তাঁর অপকার করবে। আর শেষে মোক্ষম ভবিষ্যদ্বাণী— কবির আয়ু বড়জোর ষাট অথবা বাষট্টি বছর।
কোনও মতে সে-বয়স কাটিয়ে দিতে পারলেও জীবন নাকি কিছুতেই পেরোবে না সত্তরের গণ্ডি।
তাতে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মৃণালিনীকে লিখেছিলেন, ‘‘শুনে ত আমার ভারী ভাবনা ধরিয়ে দিয়েছে। এই ত সব ব্যাপার। যা হোক তুমি তাই নিয়ে যেন বেশি ভেবো না. এখনো কিছু না হোক, ত্রিশ চল্লিশ বছর আমার সংসর্গ পেতে পারবে।’’
এই চিঠি লেখার এগারো বছরের মাথায় নভেম্বর মাসের একদিন।
কী আশ্চর্য! চলে গেলেন মৃণালিনী! মৃত্যু কত অনিশ্চিত।
শোকে পাথর রবীন্দ্রনাথ। দর্শনার্থীদের ভিড় ফিকে হয়ে গেলে মৃণালিনীর সব সময় ব্যবহারের চটিজুতো-জোড়া তুলে দিলেন রথীন্দ্রনাথের হাতে।
বললেন, ‘‘এটা তোর কাছে রেখে দিস, তোকে দিলুম।’’
আর বাইশ বছর পর, ২ নভেম্বর ১৯২৪। মৃণালিনীকে স্মরণ করে আন্দেজ জাহাজে বসে লিখলেন, "...তোমার আঁখির আলো. তোমার পরশ নাহি আর,/ কিন্তু কী পরশমণি রেখে গেছ অন্তরে আমার—/ ...সঙ্গীহীন এ জীবন শূন্যঘরে হয়েছে শ্রীহীন,/ সব মানি— সবচেয়ে মানি, তুমি ছিলে একদিন।’’
শোকের দহন যেন তখনও তাঁর ভিতরে।
অথচ এই তিনিই আবার ১৯০০ সালের নভেম্বরে কলকাতা থেকে মৃণালিনীকে লিখেছিলেন, ‘‘বেঁচে থাকতে গেলেই মৃত্যু কতবার আমাদের দ্বারে এসে কত জায়গায় আঘাত করবে— মৃত্যুর চেয়ে নিশ্চিত ঘটনা ত নেই— শোকের বিপদের মুখে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ বন্ধু জেনে যদি নির্ভর করতে না শেখ তাহলে তোমার শোকের অন্ত নেই।’’
মা আর কোনও দিন ফিরবেন না
ছোটভাই বুধেন্দ্রনাথ যখন মারা যান রবীন্দ্রনাথ তখন এতই ছোট যে সেই মৃত্যু তাঁর স্মৃতিতে দাগই কাটেনি কোনও।
রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন চোদ্দো, একদিন গভীর রাতে বাড়ির পুরনো এক দাসীর সর্বনাশা চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল তাঁর।
তিনতলার ঘরে মা সারদাদেবী তখন প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী, রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠান কাদম্বরী, বিদ্যুৎ-গতিতে সরিয়ে নিয়ে গেলেন সেই দাসীকে।
অত রাত্রে, টিমটিমে প্রদীপের আলোয় ঘুম-চোখে, রবীন্দ্রনাথ কিছুই বুঝলেন না, শুধু বুকটা যেন হঠাৎ একটু দমে গেল তাঁর।
পরদিন শুনলেন মায়ের মৃত্যুসংবাদ।
কিন্তু সেটা যে ঠিক কী, ভাল বুঝে উঠতে পারলেন না। বাইরে বারান্দায় এসে দেখলেন, সুন্দরভাবে সাজানো মায়ের দেহ প্রাঙ্গণে শোয়ানো। সকালের আলোয় তাঁর মুখ দেখে মনেই হল না মৃত্যু ভয়ংকর!
বরং মনে হল সেই মৃত্যু ‘সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর’, এক জীবন থেকে মা যে আর এক জীৱনে চলে গেলেন, তাতে যে একটা বিচ্ছেদের শূন্যতা তৈরি হল— এমন কিছুই কিন্তু মনে হল না রবীন্দ্রনাথের।
শুধু মায়ের দেহ যখন বাড়ির সদর দরজার বাইরে নিয়ে যাওয়া হল, পিছন পিছন শ্মশানের উদ্দেশে সবাই চললেন, তখন যেন দমকা এক বাতাসের মতো হু হু করে উঠল রবীন্দ্রনাথের মন।
জীবনস্মৃতি-তে আছে সেই মুহূর্তের কথা, ‘‘এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘর করনার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না।’’
বেলা হলে শ্মশান থেকে ফিরে দেখলেন তেতলায় নিজের ঘরের সামনে বারান্দায় ধ্যানস্থ তাঁর বাবা।
ঘোড়ায় বসা শমীন্দ্রনাথ
কাদম্বরীর চলে যাওয়া
১৮৮৪। চারপাশের গাছপালা, মাটিজল, চন্দ্রসূর্য, গ্রহতারা সব যেমন ছিল তেমনই। কিন্তু তাদের থেকেও সত্যি হয়ে দেহ-প্রাণ-হৃদয়-মনের হাজার রকম ছোঁওয়ায় যিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভুবন জুড়ে, সেই নতুন বৌঠান কাদম্বরী, অভিমানে আফিম খেয়ে মারা গেলেন ঠাকুরবাড়ির এক বিমর্ষ, করুণ ঘরে।
এত কাছের, এত হাসিখেলার সাথী এক নিমেষে স্বপ্নের মতো মিলিয়েই যেন গেলেন না শুধু, রবীন্দ্রনাথের জন্য রেখে গেলেন নিকষ কালো এক-জীবন অন্ধকার।
এই অন্ধকারই তার পর যেন তৈরি করে দিল সর্বকালের সেরা এক কবিকে।
আড়ালে একটা চারাগাছকে রাখলে, যেমন সে আলোর খোঁজে মাথা তোলে, কাদম্বরীর না-থাকার অন্ধকারের বেড়া ঠেলে রবীন্দ্রনাথ তেমনই যেন খুঁজে বেড়ালেন এক আলোর পথ।
লিখলেন: ‘‘... সেই অন্ধকারকে অতিক্রম করিবার পথ অন্ধকারের মধ্যে যখন দেখা যায় না তখন তাহার মতো দুঃখ আর কী আছে!’’
ছেলেবেলা থেকে ব্রহ্মদর্শনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় করিয়েছিলেন তাঁর বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছাড়াও, এই দর্শনে দীক্ষিত হয়েই জীবন আর মৃত্যু নিয়ে তাঁর নিজের একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল।
জীবনের মধ্যে থেকে মৃত্যুকে আর দুঃখকে সহজে বরণ করার কথা তিনি বারবার বলেছেন।
উপনিষদ থেকে তাঁর ভাবানুবাদ করা এই শ্লোক যেন তাঁর নিজের মৃত্যু চিন্তারই প্রতিধ্বনি: ‘‘শোনো বিশ্বজন, শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ/ দিব্যধামবাসী। আমি জেনেছি তাঁহারে মহান্ত পুরুষ যিনি/ আঁধারের পারে জ্যোতির্ময়।/ তাঁরে জেনে তাঁর পানে চাহি/ মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পার, অন্য পথ নাহি।’’
আত্মহননের প্রবণতা
একে অস্বাভাবিক অকালমৃত্যু, তার উপর সেই মৃত্যু নিয়ে অস্বস্তিকর সব কাটাছেঁড়া।
কাদম্বরী মারা যাওয়ার কিছু দিন পর ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, যার নাম দিয়েছিলেন ‘আত্মা’।
বোঝাই গেল, নাম না করেও কাদম্বরীর মৃত্যু নিয়েই নিজের মতামত লিখেছেন সেখানে।
লিখলেন, ‘‘যে-আত্মবিসর্জন করতে পারে, আত্মার উপর শ্রেষ্ঠ অধিকার শুধু তারই জন্মাতে পারে।’’
‘আত্মা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যেন ইঙ্গিত দিলেন, কাদম্বরীর মারা যাওয়া আসলে এক জরুরি ‘আত্মবিসর্জন’।
আত্মহত্যাকে যদি ‘আত্মবিসর্জন’ বলে ধরে নেওয়া যায়, তাহলে তেমন একটা ইচ্ছে জীবনে অন্তত একবার কিন্তু তাড়া করেছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও। মৃত্যুর আগেই মৃত্যুর গভীর আকাঙ্ক্ষা একবার গ্রাস করেছিল তাঁকেও।
২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯১৪।
শ্রীনিকেতন থেকে রথীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ইউনানি ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে তাঁর শারীরিক সমস্যা দূর হলেও কিছু মানসিক উপসর্গ দেখা দিয়েছে।
‘মেটিরিয়া মেডিকা’ পড়ে নিজের সেই সব উপসর্গ চিহ্নিত করলেন রবীন্দ্রনাথ: অবসাদ, মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা, কান্নার তাগিদ, হতাশা, আত্মহত্যার প্রবণতা, আক্রোশ ইত্যাদি।
রথীকে লিখলেন, ‘‘দিনরাত্রি মরবার কথা এবং মরবার ইচ্ছা আমাকে তাড়না করেছে. মনে হয়েছে আমার দ্বারা কিছুই হয়নি এবং হবেনা। আমার জীবনটা যেন আগাগোড়া ব্যর্থ...।’’
২৯ জানুয়ারি ১৯১৫। বন্ধু সিএফ অ্যান্ড্রুজকে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন প্রায় একই কথা: "I feel that I am on the brink of a breakdown".
লিখলেন পদ্মার নির্জনতায়, প্রকৃতির কোলে তিনি চান ছুটি।
অথচ এর দিন কয়েক বাদেই উধাও গভীর অবসাদের সেই পলাতকা-ছায়া!
২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৫।
রথীন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রনাথ জানালেন, শিলাইদহে এসে তাঁর ক্লান্তি আর দুর্বলতা দূর হয়ে গেছে। লিখলেন, ‘‘কিছুকাল থেকে মনে হচ্ছিল মৃত্যু আমাকে তার শেষ বান মেরেছে এবং সংসার থেকে আমার বিদায়ের সময় এসেছে-- কিন্তু তস্য ছায়ামৃতং তস্য মৃত্যু— মৃত্যু যাঁর ছায়া অমৃতও তাঁরি ছায়া-- এতদিনে আবার সেই অমৃতেরই পরিচয় পাচ্চি।’’
জীবন কী বৈচিত্রময়!
বিদায় মৃণালিনী
আবার সেই দোলাচলের ছোঁয়া!
‘ছিন্নপত্রাবলী’-তে রবীন্দ্রনাথকে বলতে শোনা যায় যে, ব্যক্তি হিসেবে দেখতে গেলে মৃত্যুটা কত উৎকট, যার মধ্যে কোনও সান্ত্বনা নেই।
কিন্তু ‘‘বিশ্বজগতের হিসেবে দেখতে গেলে মৃত্যুটা অতি সুন্দর ও মানবাত্মার সান্ত্বনাস্থল।’’
অথচ মৃত্যুর সেই ‘সুন্দর’, ‘প্রশান্ত’ মুখ তাঁর নিজের সন্তানদের মায়ের মৃত্যুর সময় তিনি দেখতে দিলেন না কেন, তার যেন কোনও উত্তর নেই।
মাধুরীলতা, রথীন্দ্র, রেণুকা, মীরা, শমীন্দ্র— পাঁচ সন্তানের মা মৃণালিনীর শরীর তখন সংসার আর শান্তিনিকেতনে কবির আশ্রম-বিদ্যালয় সামলিয়ে একেবারে ভেঙে গেছে। শান্তিনিকেতন থেকে তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছে জোড়াসাঁকোয়। ডাক্তারদের সঙ্গেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করছেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই।
শান্তিনিকেতন থেকে রথী এসে থেকে গেলেন মায়ের সঙ্গে। মীরা আর শমী তখন খুবই ছোট। শমী রইল শান্তিনিকেতনেই।
অসুখের কষ্ট থেকে একটু নিস্তার পেতে মৃণালিনীকে মাঝেমাঝেই ঘুমোতে বলেন রবীন্দ্রনাথ।
তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় মৃণালিনী তখন বলেন, ‘‘শমীকে রেখে এলেন, আমি কি ঘুমতে পারি তাকে ছেড়ে! বোঝেননা সেটা।’’
এর পর একদিন।
মৃণালিনীর তখন বাকরোধ হয়েছে। রথীন্দ্রনাথকে ডেকে মায়ের বিছানার পাশে বসালেন রবীন্দ্রনাথ। মৃণালিনীর চোখ দিয়ে তখন শুধুই অঝোর জলের ধারা।
সে-রাতে রথী আর ছোটদের পুরনো বাড়ির তেতলায় পাঠিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ।
কোনও এক অনির্দিষ্ট আশংকায় তাঁদের সারা রাত কাটল নির্ঘুম।
পরদিন ২৩ নভেম্বর, ১৯০২।
ভোররাতে রথী গিয়ে দাঁড়ালেন বারান্দায়। তাকালেন লাল-বাড়ির দিকে।
বাড়িটা তখন অন্ধকারে ঢাকা। নিস্তব্ধ, নিঃঝুম, সাড়াশব্দহীন।
রথী বুঝলেন, তাঁদের মা আর নেই, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
চেয়েছিলেন মেয়ের অপঘাতে মৃত্যু
মৃত্যুর আগে যেমন কখনও চেয়েছিলেন নিজের অকালপ্রয়াণ। তেমনই অসম্ভব কষ্ট পেয়ে, সংসারের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে, চেয়েছিলেন নিজের মেয়ের অপঘাতে মৃত্যু।
অপঘাতে মৃত্যুকে নিজে খুবই ভয় পেতেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৯-এ কুমার জয়ন্তনাথ রায়কে রবীন্দ্রনাথ তেমন মৃত্যুর প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘শান্তিপূর্ণ মৃত্যুকে বিন্দুমাত্র ভয় করিনি। ভয় করি অপঘাত মৃত্যুকে। যদি মৃত্যুর পূর্বে হাসিমুখে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারি, তবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে মুহূর্তের জন্যও দ্বিধা করবো না।’’
ছোট মেয়ে মীরার সঙ্গে ‘না ভেবে না বুঝে’ নগেন্দ্রনাথের তখন বিয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
লক্ষ করেছেন, নগেনের ‘দুর্দ্দাম বর্ব্বরতা’-য় আতঙ্কগ্রস্ত মীরা। পারছে না তার স্বামীকে ভালবাসতে।
বাবা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ভাবছেন, তাঁর চাপিয়ে দেওয়া সম্পর্কের জেরে ছারখার হয়ে গেল তাঁর মেয়ের জীবন।
এমনই এক শোচনীয় উপলব্ধির মধ্যে রথীন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘‘বিয়ের রাত্রে মীরা যখন নাবার ঘরে ঢুকছিল তখন একটা গোখরো সাপ ফস করে ফনা ধরে উঠেছিল— আজ আমার মনে হয় সে সাপ যদি তখনই ওকে কাটত তাহলে ও পরিত্রাণ পেত।’’
কাদম্বরী ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
ঝরে গেল আদরের বেলি
রবীন্দ্রনাথের মেজ মেয়ে রেণুকা তখন খুবই অসুস্থ।
জোড়াসাঁকোয়, রবীন্দ্রনাথের বন্ধু রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মাঝেমধ্যেই খোঁজ নিয়ে যান রেণুকার।
তেমনই একদিন।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লম্বা আলাপের শেষে রামেন্দ্রসুন্দর জানতে চাইলেন, রেণুকার শরীর কেমন আছে।
রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘‘আজ সকালে সে মারা গিয়েছে।’’
রবীন্দ্রনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেলেন রামেন্দ্রসুন্দর। তার পর নিঃশব্দে নেমে এলেন সিঁড়ি বেয়ে।
দৌহিত্র নীতিন্দ্রনাথ মারা গেলে মেয়ে মীরাকে একটি চিঠি লেখেন কবি। সে-চিঠিতে ছিল ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথের মৃত্যুর প্রসঙ্গ।
লিখেছিলেন, ‘‘যে রাত্রে শমী গিয়েছিল সে রাত্রে সমস্ত মন দিয়ে বলেছিলুম বিরাট বিশ্বসত্ত্বার মধ্যে তার অবাধ গতি হোক, আমার শোক তাকে একটুও পিছনে না টানে।’’
আরও লিখেছিলেন, মৃত্যুর পর সবাই যেখানে যায়, সেখানে মানুষের সেবা পৌছয় না কিন্তু ভালবাসা হয়ত বা পৌঁছয়— ‘‘নইলে ভালবাসা এখনো টিঁকে থাকে কেন?’’
১৯১২ সালে বিলেত যাওয়ার আগে রবীন্দ্রনাথ বাংলায় লিখে গেলেন তাঁর উইল।
মাধুরীলতা আর মীরার জন্য বরাদ্দ করে গেলেন যথাক্রমে প্রতি মাসে পঞ্চাশ এবং একশো টাকা।
যদি মেয়েরা হঠাৎ বিধবা হয়ে পড়ে, সেই কথা ভেবে ব্যবস্থা করে গেলেন আরও পঞ্চাশ টাকা করে অতিরিক্ত মাসোহারার।
রেণুকার মতোই যক্ষ্মায় শয্যাশায়ী হলেন মাধুরীলতা, রবীন্দ্রনাথের ‘বেলি’। মাধুরীলতা ফুল ভালবাসতেন। ১৬ মে, ১৯১৮। ফুলে ঢেকে মোটরকারে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় শ্মশানে।
প্রতিমাদেবী বলেছিলেন, সে দিন যেন আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল বেলাকে।
রথীন্দ্রনাথ তাঁর ইংরেজি দিনলিপিতে লিখেছিলেন, দিদিকে দেখতে যাওয়ার আগে সে দিন বাড়ির ডাক্তারকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন মৃত্যুভয় তাঁর আর নেই, তিনি তৈরি আছেন।
মেয়েকে দেখতে গিয়ে, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে বুঝে, ডিহি-শ্রীরামপুর রোডে মেয়ের বাড়ির সামনে থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন সেই রবীন্দ্রনাথই।
পরলোকে বিশ্বাস নেই, তবু...
১৯২০। আমেরিকার ‘ওয়াশিংটন’ কাগজে মৃত্যুর পর সত্তার অস্তিত্ব নির্ধারণে সক্ষম ‘এডিসন-এর মেশিন’ বলে এক বিচিত্র যন্ত্রের কথা ছাপা হল।
মৃত্যুর পর আত্মার অস্তিত্ব আর ওই আশ্চর্য যন্ত্রের বিষয়ে প্রশ্ন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে এলেন মার্গারি রেক্স বলে একজন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বললেন, ‘‘মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে আমার আশা আর বিশ্বাসের শেষ নেই। তবে মানুষের কাছে তার প্রমাণের জন্য আমি কোনও যন্ত্রের প্রয়োজন দেখি না।’’
জন্মান্তর আর পরলোক বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আরও অনেকের মতো আলোচনা হয় আইরিশ কবি স্টপফোর্ড ব্রুকের।
‘পথের সঞ্চয়’-এ রবীন্দ্রনাথ সেই কথোপকথন মনে রেখে লিখেছেন, ‘‘আমার জীবনধারার মাঝখানে এই মানবজন্মটা একেবারেই খাপছাড়া জিনিস। ইহার আগেও এমন কখনো ছিল না, ইহার পরেও এমন কখনো হইবে না।’’
জন্মান্তরে অবিশ্বাসের কথা বলেও পরলোক-জীবনের দুর্দম কৌতূহলের টানে পড়ে বন্ধুকন্যা বুলার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ডেকে এনে কথা বলেছিলেন তাঁর পরলোকগত আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে।
একবার প্ল্যানচেটে নেমে আসে অকালে হারানো কনিষ্ঠপুত্র শমীন্দ্রনাথের আত্মা। অকপটে শমী তার বাবাকে বললেন, তার বাবার একটা কবিতা ‘বিশ্রী’ ঠেকেছে। শমী আরও বলেন, পরলোকে তিনি গড়ে তুলেছেন এক ভুবন, যার নাম দিয়েছেন ‘শমীর পৃথিবী’।
রবীন্দ্রনাথ তখন শমীকে বললেন, তিনি পরলোকে যখন যাবেন দুজনে গড়বেন ‘শমীর পৃথিবী’।
অন্য আত্মাদের সঙ্গে আলাপে রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, সেই ‘শমীর পৃথিবী’ আসলে কী রকম!
অস্তাচলের রবি
মংপুতে একবার মৈত্রেয়ীদেবীকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘আমার জীবনে যতবার মৃত্যু এসেছে, যখন দেখেছি কোনও আশাই নেই, তখন আমি প্রাণপণে সমস্ত শক্তি একত্র করে মনে করেছি, ‘তোমাকে আমি ছেড়ে দিলাম, যাও তুমি তোমার নির্দিষ্ট পথে।’
১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৭।
ছিয়াত্তর বছরে বড় অসুখে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ। এরিসিপেলেস তাঁকে অজ্ঞান করে রাখল টানা পঞ্চাশ ঘণ্টা। খবর পেয়ে কলকাতা থেকে ছুটে এলেন ডাক্তার। কিছু দিন পর হেমন্তবালাদেবীকে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘‘কিছুকালের জন্য মৃত্যুদণ্ড এসে আমার ছুটির পাওনা পাকা করে গিয়েছে।’’
গেল আরও কিছু দিন।
সত্যজিৎ রায় তখন শান্তিনিকেতনে। উপস্থিত এক বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথকে মনে করিয়ে দিলেন সামনে কবির আশি বছরের জন্মদিন।
রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘‘হ্যাঁ, এবার আশি, আর তার মানেই আসি।’’
প্রায় একই সময়, সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় একদিন দেখলেন উত্তরায়ণ-এ একটা প্রকাণ্ড টেবিলে বসে রবীন্দ্রনাথ বেশ ঝুঁকে পড়ে কিছু লিখছেন। বলাইচাঁদ জিজ্ঞেস করলেন, এত রকম আসবাব থাকতে অত ঝুঁকে পড়ে লিখতে রবীন্দ্রনাথের কষ্ট হচ্ছে কি না। উত্তরে বললেন, ‘‘সব রকম চেয়ারই আমার আছে. কিন্তু ঝুঁকে না লিখলে লেখা বেরোয় না। কুঁজোর জল কমে গেছে তো, তাই উপুড় করতে হয়।’’
২৫ জুলাই, ১৯৪১।
অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে শান্তিনিকেতন থেকে নিয়ে যাওয়া হবে কলকাতায়। যাওয়ার আগে আশ্রমের ছোট বড় সবাইকে দেখতে চাইলেন তিনি।
গাড়িতে শুইয়ে তাঁকে ঘোরানো হল আশ্রম। তখন নতুন আলোর জন্য চার দিকে বসানো হচ্ছিল ল্যাম্প পোস্ট। তাই দেখে বললেন, ‘‘এখন বুঝি পুরনো আলো গিয়ে নতুন আলো আসবে।’’
আশ্রমের ডাক্তার শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে ইশারায় কাছে ডেকে নিলেন। তাঁর দুটো হাত নিজের হাতে ধরে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘‘ডাক্তার, আমার আশ্রম রইল আর আশ্রমবাসীরা রইলেন, তাঁদের তুমি দেখো।’’
রবীন্দ্রনাথের চোখে তখন জল। কাঁদছেন শচীন্দ্রনাথও। ৩০ জুলাই কলকাতায় তাঁর অপারেশন। ভয় পাচ্ছিলেন ব্যথার কথা ভেবে। তার মধ্যেই মুখে মুখে বললেন নতুন দুটো কবিতা। টুকে রাখলেন উপস্থিত সেবিকারা। আদরের বৌমা প্রতিমার জন্য সে ভাবেই মুখে মুখে বলে লেখালেন একটা চিঠি। কাঁপা কাঁপা হাতের লেখায় অতি কষ্টে শুধু নিজে হাতে সই করলেন ‘বাবামশায়’।
সেই তাঁর শেষ লেখা।
৬ অগস্ট সন্ধে ৬টায় খেলেন দেড় আউন্স আখের রস। রাত সাড়ে ন'টায় আধ আউন্স বার্লি।
৭ আগস্ট ১৯৪১।
বেলা ১২ টা ১০, আলোর ভুবনে ভেসে গেলেন মরণবিজয়ী রবীন্দ্রনাথ।
স্বজনহারা রবি
১৮৭৫সারদাসুন্দরী দেবী, মা
১৮৮১গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভ্রাতুষ্পুত্র
১৮৮৩ সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়, জামাইবাবু, রবীন্দ্রনাথের বিয়ের রাতে মারা যান
১৮৮৪হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সেজদাদা
১৮৮৪কাদম্বরী দেবী, বৌদি, আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন
১৮৯৪ বিহারীলাল চক্রবর্তী, আদর্শ কবি, মৃত্যুর পরে রবীন্দ্রনাথের বেয়াই
১৮৯৫অভিজ্ঞা চট্টোপাধ্যায়, ভ্রাতুষ্পুত্রী
১৮৯৭সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ভগ্নিপতি, ক্যানসারে মৃত
১৮৯৯ উষাবতী চট্টোপাধ্যায়, ভ্রাতুষ্পুত্রী
১৮৯৯বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভ্রাতুষ্পুত্র, যক্ষ্মায় মৃত
১৯০১নীতীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভ্রাতুষ্পুত্র
১৯০২মৃণালিনী দেবী, স্ত্রী, মারা যাবার সময় বয়েস ঊনত্রিশ
১৯০৩ বিমানেন্দ্রনাথ রায়, বাবার শ্যালকের ছেলে
১৯০৩দ্বিতীয় কন্যা রেণুকা ভট্টাচার্য, যক্ষ্মায় মৃত
১৯০৫মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাবা
১৯০৭শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর,কনিষ্ঠ পুত্র, কলেরায় মৃত
১৯০৮সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, জামাতা, দ্বিতীয় কন্যা রেণুকার স্বামী
১৯০৮হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভ্রাতুষ্পুত্র
১৯১০ নীপময়ী ঠাকুর, বৌদি, স্ত্রী মৃণালিনীর শিক্ষিকা
১৯১৩ জানকীনাথ ঘোষাল, ভগ্নিপতি, ‘ভারতী’-র সম্পাদক
১৯১৫ বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দাদা
১৯১৬ শান্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, ভাগ্নের মেয়ে
১৯১৮ ইরাবতী মুখোপাধ্যায়, ভাগ্নি, বাল্যসখী
১৯১৮ মাধুরীলতা চক্রবর্তী, জ্যেষ্ঠ কন্যা, যক্ষ্মায় মৃত
১৯১৯ জ্যোতিঃপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়, দাদার মেয়ের ছেলে, শৈশবে কবিতার দীক্ষাদাতা
১৯১৯ সুকেশী ঠাকুর, ভ্রাতুস্পুত্রের স্ত্রী
১৯২০শরৎকুমারী মুখোপাধ্যায়, দিদি
১৯২০সৌদামিনী গঙ্গোপাধ্যায়, দিদি
১৯২২ তিভাসুন্দরী চৌধুরী, ভাগ্নি
১৯২২ সোমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দাদা
১৯২৩ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দাদা
১৯২৪ আশুতোষ চৌধুরী, বন্ধু, ভাগ্নির স্বামী
১৯২৪ বিনয়িনী চট্টোপাধ্যায়, বেয়াই, পুত্র রথীন্দ্রের শাশুড়ি
১৯২৫ হিরণ্ময়ী মুখোপাধ্যায়, ভ্রাতুষ্পুত্রী
১৯২৫ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘নতুন দাদা’
১৯২৬ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বড় দাদা
১৯২৯ অরুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভ্রাতুষ্পুত্র
১৯২৯ মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, অবনীন্দ্রনাথের জামাতা, কবির প্রিয়পাত্র
১৯২৯ সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভ্রাতুষ্পুত্র
১৯৩২নীতীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, দৌহিত্র
১৯৩২স্বর্ণকুমারী দেবী, দিদি
১৯৩৩ সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়, ভাগ্নে
১৯৩৫কৃতীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভ্রাতুষ্পুত্র
১৯৩৫দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভ্রাতুষ্পুত্র
১৯৩৭ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভ্রাতুষ্পুত্র
১৯৩৮গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাকার ছেলে
১৯৪০সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভ্রাতুষ্পুত্র